leadT1ad

আমেরিকার প্রথম ‘সৎ’ প্রেসিডেন্ট

এরিক রেইনহার্ট
এরিক রেইনহার্ট

এআই দ্বারা নির্মিত প্রতীকী ছবি

আমেরিকার ইতিহাসে প্রতিটি যুগের সরকারই কোনো না কোনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুনত্ব হলো, তিনি কেলেঙ্কারিকেই তার সরকার চালানোর নীতি বানিয়ে ফেলেছেন। অনেকের কাছে ট্রাম্প প্রশাসনের দুর্নীতি, খোলাখুলিভাবে নিজেদের লাভ খোঁজা এবং রাষ্ট্রকে প্রতিশোধ ও ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা আমেরিকান গণতন্ত্রের বিকৃতি। কিন্তু সত্যিটা হলো, এটি আসলে আমেরিকারই প্রতিচ্ছবি।

ট্রাম্পের যুগ ও তার আগের যুগগুলোর মধ্যে পার্থক্য হলো, এখন দুর্নীতি সবার চোখের সামনে ঘটছে, কিন্তু জাতিগতভাবে মার্কিনিরা আর আগের মতো লজ্জিত বোধ করছে না।

কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতিকে উপস্থাপন করা হয়েছে একধরনের ‘নৈতিক বিচ্যুতি’ হিসেবে। মূল ব্যবস্থা ঠিক আছে, মাঝেমধ্যে কিছু লোক পথভ্রষ্ট হয়ে দুর্নীতি করেছে—এমনভাবে।

উনিশ শতকের রেল ব্যবসায়ী ও কোম্পানি শাসিত শহরগুলো থেকে শুরু করে বিশ ও একুশ শতকে ওয়াল স্ট্রিট এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে আবর্তিত ক্ষমতার খেলা পর্যন্ত—আমেরিকান পুঁজিবাদ বরাবরই সরকারি পদকে ব্যক্তিগত লাভের যন্ত্রে পরিণত করেছে।

যখন রাজনীতিবিদেরা লবিস্টে পরিণত হয়েছেন, নিয়মিত অভ্যন্তরীণ তথ্য ব্যবহার করে শেয়ার ব্যবসা করেছেন; যখন করপোরেশন নিজেরাই আইন লিখেছে; যখন সাধারণ মানুষের টাকায় ধনী ব্যাংক মালিক ও রাজনৈতিক দাতাদের ভুলের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে; যখন হাসপাতাল পরিচালকরা সরকারি অর্থে ধনী হচ্ছেন, অথচ তাদের কর্মী ও রোগীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে—তখন ‘পেশাদারিত্ব’, ‘দক্ষতা’ বা ‘দক্ষ ব্যবস্থাপনা’ নামে এসব দুর্নীতিকে আড়াল করা হয়েছে।

নব্য উদারনীতি (নিও-লিবারেল) ব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে সাফল্য মানেই নৈতিকতা, আর বাজারমূল্য মানেই মানবিক মূল্য। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় এলেন, ততদিনে দুর্নীতিকে ‘এটাই বাস্তবতা’ বলে মেনে নেওয়াটা একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল।

ট্রাম্প কেবল এর ভদ্রতার মুখোশটি খুলে দিয়েছেন—শুধু দেশের রাজনীতিতেই নয়, পররাষ্ট্রনীতিতেও। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে নিজেদের সহিংসতাকে আড়াল করে এসেছে।

উদাহরণস্বরূপ, লাতিন আমেরিকার ক্যারিবীয় সাগর এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে একতরফা সামরিক হামলা চালিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ট্রাম্পের কোনো নতুন প্রথা নয়, বরং এটি আমেরিকান ঐতিহ্যের সবচেয়ে নগ্ন রূপ। অতীতের প্রশাসনগুলো যা অস্বীকার এবং সুভাষণের আড়ালে করত, ট্রাম্প তা প্রকাশ্যে করছেন।

একইভাবে, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা ট্রাম্পের আমলে বেড়ে গেলেও এর শিকড় বারাক ওবামার আমলেই তৈরি হয়েছিল। ওবামার আমলে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী বিতাড়িত করা হয়েছিল বলে ওবামাকে ‘ডেপোর্টার ইন চিফ’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্পের নীতি ওবামার সেই কাজের নাটকীয়, টিভি-উপযোগী সংস্করণ।

ট্রাম্পের সীমান্ত নীতির প্রধান টম হোমেনের ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন খোদ ওবামা। অভিবাসীদের ধরে আনা, শিশুকে তাদের বাবা-মা থেকে আলাদা করা এবং মানুষকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী এই টম হোমেনকে ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল র‍্যাঙ্ক অ্যাওয়ার্ড ফর ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস সম্মানে ভূষিত করেছিলেন বারাক ওবামা।

ট্রাম্প প্রশাসনের স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের ব্যবহার, সরকারি চুক্তির খোলামেলা বেচাকেনা—এসব আমাদের আর অবাক করে না। কারণ আমরা জানি আমেরিকার সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে ধনীদের হাতে, ধনীদের জন্যই পরিচালিত হয়। তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দাতা, লবিস্ট, ঘুষ, প্রভাবের নেটওয়ার্ক বা চাঁদাবাজির মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। যে ক্ষোভ একসময় দেখা দিত, এখন তা কেবল ‘সব সময়ই তো এমনই ছিল’ এই ক্লান্ত উপলব্ধিতে রূপ নিয়েছে।

এই দিক থেকে দেখলে, ট্রাম্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নন, বরং তিনি আসল সত্যটাকেই সামনে এনেছেন। আগের সরকারগুলো পুঁজিবাদকে ‘যোগ্যরাই পুরস্কৃত হবে’—এই সুন্দর কথা বলে চালাত। ট্রাম্প এসে সেই মুখোশটি ছিঁড়ে ফেলে এর ভেতরের লাগামহীন লোভ আর অহংকারের কদর্য চেহারাটা সবার সামনে তুলে ধরেছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের দুর্নীতিতে কোনো রোগের প্রকাশ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত ব্যবস্থার (সিস্টেম) আসল রূপ। যুক্তরাষ্ট্রে আইন ব্যবস্থা ধসে পড়েনি, ধসে পড়েছে মানবিক বোধ। ধসে পড়েছে অপরাধকে অপরাধ ভাবার নৈতিক আদর্শ। যা একসময় অপরাধ মনে হতো, এখন ‘সত্যকথন’ বলে উপভোগ করা হয়। সমাজে শক্তি ও ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শনকে আমরা উপভোগ করতে শিখেছি এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজেরা তার সহযোগীও হয়েছি।

যে সমাজে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র হোক তা চিকিৎসা কিংবা শিক্ষা—মুনাফা দ্বারা পরিচালিত, সেখানে দুর্নীতি প্রকাশ পেলেও তা নৈতিক নবজাগরণ ঘটায় না। বরং রক্ষার করার মতো কোনো মানবিক ও নৈতিক কাঠামো অবশিষ্ট নেই, এই সন্দেহকে নিশ্চিত করে।

ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরনের রাজনৈতিক পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস)। আমরা দুর্নীতিকে চিনতে পারি, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারি না। কারণ তা করতে হলে সেই ব্যবস্থাকেই সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করতে শিখে গেছি, এই ব্যবস্থা অনিবার্য, এই ব্যবস্থা অপরিহার্য। এই ব্যবস্থার ওপরই আমাদের সমাজ টিকে আছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে উদারনৈতিক প্রতিক্রিয়াগুলোও একই কারণে ব্যর্থ হয়। লিবারেলরা (উদারনীতিবাদী) সততা, ন্যায্যতা ও শালীনতার মতো নৈতিকতার কথা বলে, কিন্তু এটা ভুলে যায় যে, এই মূল্যবোধগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংস্কৃতিক—কোনো শক্ত ভিত্তিই আর অবশিষ্ট নেই।

অন্যদিকে, ডানপন্থীরা এই শূন্যতাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে শিখেছে। ট্রাম্পের প্রতিভা হলো দুর্নীতিকে প্রদর্শনীতে পরিণত করার ক্ষমতা। ট্রাম্পের নির্লজ্জতা তাই অনেকের কাছে ‘সত্যতা’ আর ট্রাম্প প্রশাসনের সহিংসতা অনেকের কাছে ‘স্বাধীনতা’। ট্রাম্পের অনুসারীরা ঠিকই বোঝে যে অভিজাতদের জীবনের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তাঁরা দুর্নীতির জন্য কোটিপতিদের নয়, বরং দায়ী করে আমলাদের, অভিবাসীদের।

দুর্নীতি কিংবা এ ধরনের কেলেঙ্কারি এখন আর জনরোষ জাগায় না, কারণ ‘প্রতিবাদ’ নিজেই এক ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। ক্ষোভ এখন এক ধরনের জীবনধারা, নৈরাশ্য এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্যাশন। রাজনৈতিক সমালোচনা এখন পণ্য—মিডিয়া ও প্রকাশনা শিল্প মানুষের ক্ষোভকে বই, ডকুমেন্টারি, বা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে রূপ দিচ্ছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে বুলি এখন নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার, আর তার পাশেই স্থান পায় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের আত্মজীবনী।

রাজনীতি যখন বিনোদনে পরিণত হয়, আর ক্ষোভ হয়ে যায় করপোরেট নান্দনিকতা, তখন ফ্যাসিবাদকে আর ‘নৈতিকতার মুখোশ’ পরতে হয় না, কেবল প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো ‘শো’ দিতে হয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের অবাধ দুর্নীতি সাধারণ মানুষ দেখছে না এমন নয়। মানুষ আসলে এর চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে, এই বিশ্বাসই আর করতে পারছে না। কোনো ঘটনায় আশ্চর্য কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ তখনই করা সম্ভব, যখন কেউ বিশ্বাস করে একটা আদর্শ বা স্ট্যান্ডার্ড আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখন এমন সমাজে বাস করি যেখানে মানুষ আর মুক্তি কিংবা সংশোধনের সম্ভাবনাতেও বিশ্বাস করে না।

মানুষের মধ্যে মানবিক বোধ ও নৈতিকতা পুনর্নির্মাণের জন্য দুর্নীতির উন্মোচনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন বাস্তব জনস্বার্থনির্ভর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এমন প্রতিষ্ঠান যা ধনিক শ্রেণির স্বার্থ নয়, বরং শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজন পূরণ করবে।

লেখক: রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী ও মনোবিশ্লেষক।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত