বর্তমানে বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্প নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখে। সরকারি প্রকল্প সীমিত, আউটসোর্সিং কাজ এবং স্টার্টআপে বিনিয়োগ কমছে। দেশীয় সফটওয়্যার কেনার মানসিকতাও বেসরকারি খাতে তৈরি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সফটওয়্যার শিল্প বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সরকারের উচিত যথাযথ বিবেচনায় অটোমেশন উদ্যোগ নেওয়া। বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত ৩০০০ কোটি টাকার এসআইটিএ (স্ট্রেংদেনিং ইনস্টিটিউশনস ফর ট্রান্সপ্যারেন্সি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি) প্রকল্প (একনেকে শর্তযুক্তভাবে অনুমোদিত, ঋণচুক্তি বাকি) ছিল এমন একটি সুযোগ। এর আওতায় দেশীয় কোম্পানিগুলোকে দুর্নীতিমুক্তভাবে নির্বাচন করে ৫০টির বেশি গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার তৈরি করা যেত, যাতে ৪০০০ সফটওয়্যার প্রকৌশলীর ৫ বছরের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হতো। আমাদের বিবেচনায়, ভুল প্রকল্প-পরিকল্পনার কারণে ৩০০০ কোটি টাকার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হবে, যার সিংহভাগ চলে যাবে বিদেশে। অহেতুক বিদেশি সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ক্রয়, বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে কেনা বিদেশি সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার অবকাঠামোতে আবদ্ধ হয়ে রক্ষণাবেক্ষণে বছরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিদেশি কোম্পানিকে অযথা দিয়ে যেতে হবে বহু বছর।
তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশিয় যে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তার প্রয়োগ জরুরি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করায় অটোমেশনের বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, রেলওয়ে, রাজউক, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মতো সংস্থার স্বচ্ছতা আনা, জন্ম নিবন্ধন, নামজারির মতো জনসেবার উন্নয়ন করা দেশিয় জনবল আর উন্মুক্ত প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই সম্ভব। উচ্চমূল্যে কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে আবদ্ধ বিদেশি সফটওয়্যারগুলো দেশে তৈরির উদ্যোগ নেয়া যেত। এনবিআরের বর্তমান এসএপি ভিত্তিক আইভাসের (ইন্টিগ্রেটেড ভ্যাট অটোমেশন সিস্টেম) পরিবর্তে দেশেই এই সফটওয়্যার তৈরি করা জরুরি। ট্যাক্স এসেসমেন্ট ও অডিট প্রক্রিয়াকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় করে ২ লক্ষাধিক কোটি টাকার ট্যাক্স ফাঁকি উদ্ঘাটন করা আরেকটি অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজ।
অথচ এসআইটিএ প্রকল্পে অহেতুক বিদেশ ভ্রমণ (৩১৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৫ কোটি টাকার বৈদেশিক প্রশিক্ষণ), অপ্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার কেনা (২০০ কোটি টাকা, যা প্রয়োজনের প্রায় পাঁচ গুণ বেশি) ইত্যাদি পরিকল্পনায় আছে। ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ব্যর্থ ইভিএএস (এনবিআর ভ্যাট অটোমেশন)-এর জন্য ৩৭০ কোটি টাকা পুনরায় বরাদ্দ করা হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে দেশের অনুপযোগী এসএপি প্রযুক্তির আপগ্রেডেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের (ডেটা গোপনীয়তাকে অগ্রাহ্য করে) জন্য।
এছাড়া, বর্তমানে চালু কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ ইজিপি আপগ্রেডেশনে বরাদ্দ ২৩৫ কোটি টাকা। এ ধরনের তুলনামূলকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারে বিপুল বরাদ্দ অপ্রয়োজনে বিদেশি কোম্পানি ও পরামর্শকদের যুক্ত করার ইঙ্গিত দেয়।
ঐতিহাসিকভাবেই বিদেশি কোম্পানি বহুগুণ বেশি খরচ করেও এদেশে সফটওয়্যার প্রচলনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ (উদাহরণ: বাংলাদেশ রেলওয়ে, ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডেটাবেজ, জিটিসিএল)। তবু বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে ও নীতিনির্ধারকদের খামখেয়ালীতে অন্তত ২০০০ কোটি টাকা অপচয়ের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে এসআইটিএ প্রকল্পে।
গত জুনে বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটির অপচয় ও ব্যর্থতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। প্রধান উপদেষ্টার ২ বিশেষ সহকারী ও ৫টি সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১০ জুলাইয়ের সভায়ও তাঁরা উদ্বেগ জানান। সভায় প্রকল্পটি বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে পরিমার্জনের সুপারিশ করা হলেও তার কোনো লক্ষণ নেই। ১৩ জন অধ্যাপক ও ইন্ডাস্ট্রি বিশেষজ্ঞ উদ্বেগ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের চিঠিও দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরের আমন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ দল সফল প্রকল্পের দৃষ্টান্তসহ উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করে। বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে প্রকল্প প্রস্তাবনায় তাঁদের পক্ষ থেকে মানসম্মত আইটি বিশেষজ্ঞের সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং সরকারের চাইলে ঋণ প্রস্তাব পরিবর্তন করা সম্ভব।
আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, পরিকল্পনা ও অর্থ উপদেষ্টার কাছে আহ্বান জানাই, দেশের স্বার্থ ও সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ অগ্রাধিকার দিয়ে অপচয় ও ব্যর্থতার আশঙ্কাপূর্ণ এসআইটিএ প্রকল্পটি নতুন করে সাজান। দেশবাসীর ওপর ৩০০০ কোটি টাকার ঋণের বোঝা না চাপিয়ে ঋণের পরিবর্তে নিজস্ব অর্থায়নে জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষজ্ঞ, ভোক্তা, উদ্যোক্তা ও অন্যান্য সকল পক্ষের সাথে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্প পরিকল্পনার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।
স্বাক্ষরকারীদের তালিকা
১. অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবার, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২. ড. সুমন নাথ, পার্টনার রিসার্চ ম্যানেজার, মাইক্রোসফট
৩. রেজওয়ান আল বখতিয়ার, সি আই টি ও, সোনালী ব্যাংক
৪. ড. অনিন্দ্য ইকবাল, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৫. ড. এ. বি. এম. আলিম আল ইসলাম, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৬. ড. রিফাত শাহরিয়ার, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৭. ড. মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৮. ড. মুহাম্মদ মাসরুর আলী, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৯. ড. মো. মোনিরুল ইসলাম, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
১০. রাইসুল কবির, সিইও, ব্রেইন স্টেশন ২৩
১১. শামীম হাসনাত, সিইও, রিদমিক ল্যাব
১২. মো. আল-আমিন সরকার তাইয়েফ, সিইও, বারিকয় টেকনোলজিস লিমিটেড
১৩. জুবেরুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার, স্যামসাং রিসার্চ, বাংলাদেশ
১৪. ড. আমিরুল আহসান, স্কুল অব বিজনেস, ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া
১৫. ড. স্বাক্ষর শতাব্দ, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব সি এস ই, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
১৬. ড. মুহাম্মদ নূর ইয়ানহাওনা, সহযোগী অধ্যাপক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
১৭. ড. ফারিয ইউসুফ সাদেক, সহযোগী অধ্যাপক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
১৮. ড. মাহমুদা নাজনিন, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
১৯. ড. সাদিয়া শারমিন, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২০. শেখ আজিজুল হাকিম, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২১. মো. শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া, সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ডইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২২. ড. আতিফ হাসান রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৩. ইশরাত জাহান, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৪. সাঈম হাসান, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৫. মো. আশরাফুল ইসলাম, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৬. আব্দুর রশিদ তুষার, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৭. আনোয়ারুল বাশির শোয়াইব, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৮. কৌশিক রায়, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
২৯. আব্দুর রাফি, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৩০. মো. ইমামুল হক প্রান্ত, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৩১. মো. নুরুল মুত্তাকিন, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট
৩২. এ. কে. এম. মেহেদী হাসান, প্রভাষক, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট