leadT1ad

বাজেট সংশোধন: অর্থনীতির চাপ সামাল না ভোটের প্রস্তুতি?

সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে বাজেট সংশোধন করা হলেও, চলতি অর্থবছরে আগেভাগেই অর্থাৎ ডিসেম্বরে বাজেট সংশোধনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। অপ্রত্যাশিত এই ঘোষণা দেশের গভীর অর্থনৈতিক সংকটকেই নির্দেশ করে। ক্রমবর্ধমান ব্যয়, রাজস্ব আয়ের স্থবিরতা, ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মতো বহুমুখী চাপ অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। এমন সময় এই তড়িঘড়ি সংশোধন কি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের একটি নিখাদ প্রচেষ্টা, নাকি আসন্ন নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক কৌশল তা নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন…

স্ট্রিম গ্রাফিক

ডিসেম্বরে বাজেট সংশোধনের ঘোষণা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আপাতদৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত মনে হতে পারে। সাধারণত বাজেট সংশোধন মার্চ বা এপ্রিলের দিকে হয়, যখন রাজস্ব প্রবাহ ও ব্যয়ের হিসাব কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এবারে ডিসেম্বরেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অর্থনৈতিক বাস্তবতা এতটাই চাপে রয়েছে যে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হিসাব পুনর্গঠনের প্রয়োজন পড়ছে।

সরকারি অর্থব্যবস্থার বর্তমান চিত্র মোটেও সরল নয়। ব্যয় বাড়ছে, রাজস্ব আয় কমছে, ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে, আর মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের সঞ্চয় ও আয়ের প্রকৃত মূল্যকে ক্রমাগত ক্ষয় করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাজেট সংশোধন কেবল আর্থিক হিসাবের সমন্বয় নয়, এটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের একটি প্রতিফলনও বটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংশোধন কি অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের পদক্ষেপ, নাকি নির্বাচনের আগে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার একটি রাজনৈতিক প্রয়াস?

নতুন বেতন কাঠামো: সুযোগ নাকি বোঝা

ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর হতে যাচ্ছে নতুন বেতন কাঠামো। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির খবর। তবে জাতীয় অর্থনীতির জন্য এটি নতুন এক চাপের নাম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, নতুন কাঠামো কার্যকর হলে শুধু বেতন ও ভাতা খাতে প্রায় ৮০ থেকে ৮৪ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ লাগতে পারে। চূড়ান্ত অঙ্ক সরকারিভাবে নিশ্চিত না হলেও সংশোধিত বাজেটে তা স্পষ্ট হতে পারে।

সরকার যদি নতুন বেতন-ভাতা ও অন্যান্য প্রশাসনিক খরচ যুক্ত করে, তাহলে ২০২৪ অর্থবছরে সরকারি ব্যয় প্রায় ২,০৬৯ বিলিয়ন টাকায় পৌঁছেছে। এটি ‘ট্রেডিং ইকনমিক্স’-এর সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রতিবেদনের তথ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এমপিওভুক্ত নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার ব্যয়। সব মিলিয়ে বাজেটের ওপর চাপ বেড়েছে বহুগুণে। এখন প্রশ্ন হলো, এই বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব সংগ্রহ মাত্র ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, বৈদেশিক সাহায্যও প্রত্যাশার তুলনায় ধীরগতিতে আসছে। ফলে আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য, অর্থাৎ ‘ফিসকাল গ্যাপ’, অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বাস্তবে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫৮২ কোটি টাকার বেশি কম হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর জানিয়েছে।

অর্থাৎ, আয় স্থবির অথচ ব্যয় ক্রমবর্ধমান। এই অবস্থায় সরকারের হাতে দুটি পথ থাকে: রাজস্ব বাড়ানো বা ঋণ নেওয়া। কিন্তু কর কাঠামো সংস্কারে তেমন অগ্রগতি না থাকায়, সরকার আবারও অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে ঝুঁকবে বলে ধারণা করা যায়। এটি স্বল্পমেয়াদে ব্যয় মেটাতে সাহায্য করলেও দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়াবে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত করবে।

রাজস্বের স্থবিরতা: কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিফলন

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন, মাত্র ৮ দশমিক ৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ দেশের মোট আয়ের তুলনায় কর আদায়ের হার খুবই কম। অথচ এই কর কাঠামোর সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে বহু বছর ধরে। বড় করদাতাদের কর ফাঁকি, আমদানি শুল্কের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, এবং কর প্রশাসনের জটিলতা সব মিলিয়ে রাজস্ব ব্যবস্থা কাঠামোগত দুর্বলতায় ভুগছে।

২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার যে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা প্রায় ৫,৬৪,০০০ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে কর-জিডিপি হার ৯ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে (উৎস: উইকিপিডিয়া)। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারের ব্যয় বাড়লেও রাজস্ব প্রবাহ সে হারে বাড়ছে না। উন্নয়ন বাজেট বা এডিপির অনেক প্রকল্পই অর্থের অভাবে ধীরগতিতে চলছে। অন্যদিকে চলতি ব্যয়, বিশেষ করে বেতন, ভাতা ও ভর্তুকি ক্রমশ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ কমে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়ছে, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে।

নির্বাচনের আগে ব্যয়ের রাজনীতি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডিসেম্বরেই কেন এই বাজেট সংশোধন? অনেকের মতে, এটি নির্বাচনের আগে ব্যয়ের অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাসের কৌশল। সরকারি কর্মচারী ও প্রশাসনিক মহল দেশের ভোট-রাজনীতিতে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই তাদের বেতন বৃদ্ধি একধরনের রাজনৈতিক বার্তা, চাকরিজীবী শ্রেণিকে সন্তুষ্ট রাখা।

তবে এই সিদ্ধান্তের আর্থিক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। কারণ, বেতন একবার বাড়লে তা আর কমানো যায় না। প্রতি বছর নতুন পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা যুক্ত হয়। ফলে এই বাড়তি ব্যয়ের ভার ভবিষ্যৎ সরকারের কাঁধেই এসে পড়বে। আমার মতে, এই নীতির মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ঝুঁকি আছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় যদি ধারাবাহিকভাবে প্রশাসনিক খাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তাহলে উৎপাদনমুখী খাতগুলো পিছিয়ে পড়বে। কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কিংবা রপ্তানিমুখী খাতে বরাদ্দ কমে গেলে কর্মসংস্থান ও আয় উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আরও নাজুক হয়ে পড়বে।

সামাজিক ন্যায্যতার প্রশ্ন

অর্থনীতি কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি ন্যায্যতারও প্রশ্ন। যেখানে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে, সেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ বা তিনগুণ বাড়ানো কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গ্রামীণ দরিদ্র, বেকার যুবক এবং বেসরকারি খাতের কর্মীদের আয় স্থবির থাকায় কেবল এক শ্রেণির মানুষের আর্থিক উন্নতি সামাজিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই বৈষম্য রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণও হতে পারে। তাই বাজেটের নীতিগত প্রশ্নটি এখন কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিকও।

মুদ্রাস্ফীতি ও ঋণের ফাঁদ

বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ বাস্তব আয় কমে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সরকার যদি আবার বড় আকারে ব্যয় বাড়ায়, বিশেষ করে বেতন ও ভর্তুকির খাতে, তাহলে বাজারে অতিরিক্ত অর্থ প্রবাহিত হবে। এর ফল হতে পারে আরও তীব্র মুদ্রাস্ফীতি।

তাছাড়া, ব্যয় মেটাতে সরকার যদি অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। বিনিয়োগ কমবে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, এবং প্রবৃদ্ধি ধীর হবে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ডলারের সংকটের কারণে ঋণ পরিশোধের চাপও বেড়েছে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধের দায় মিলিয়ে দুই দিক থেকেই অর্থনীতি চাপে পড়ছে।

২০২৫–২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে আগস্ট সময়কালে এনবিআর কর সংগ্রহে ২১ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে, যেখানে সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে ৫৪,৪২৩ কোটি টাকায় (তথ্যসূত্র: দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড)। এই সামান্য উন্নতি ইতিবাচক হলেও, তা ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।

কাঠামোগত সংস্কার: একমাত্র টেকসই সমাধান

এই অবস্থায় প্রয়োজন কেবল বাজেট সংশোধন নয়, বরং আর্থিক শাসনের কাঠামোগত সংস্কার। কর প্রশাসনকে সহজ করা, কর-ভিত্তি সম্প্রসারণ, এবং ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে কর সংগ্রহ বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে ব্যয়কে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে।

যেসব প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হলেও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় দক্ষ ব্যয়ের মাধ্যমে জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযম এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা না আনলে অর্থনীতির ভারসাম্য ফিরবে না।

দায়িত্বশীল আর্থিক শাসনের সূচনা হোক

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। রাজস্ব আয়ের ধীরগতি, মুদ্রাস্ফীতির চাপ, রিজার্ভ সংকট এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সহ সব মিলিয়ে আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ডিসেম্বরের বাজেট সংশোধন তাই কেবল হিসাবের পুনর্লিখন নয়, এটি হতে পারে রাষ্ট্রের আর্থিক শাসনব্যবস্থায় দায়িত্বশীলতার সূচনা।

সরকার যদি এই সুযোগে ব্যয়ের কাঠামোতে স্বচ্ছতা আনে, করনীতিতে সংস্কার শুরু করে এবং জনকল্যাণমূলক খাতে বাস্তব ব্যয় বাড়ায়, তাহলে এই সংশোধন অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। অন্যথায়, এটি কেবল স্বল্পমেয়াদি আর্থিক মেকআপ হিসেবেই থেকে যাবে।

বাজেট আসলে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের কাগুজে হিসাব নয়, এটি বলে দেয় আমরা কোথায় যাচ্ছি। তাই আজ যে সংশোধনের কথা হচ্ছে, তা যেন শুধুই ‘বেতন বাড়ানো’র গল্পে সীমাবদ্ধ না থেকে উন্নত হোক রাষ্ট্রীয় নীতির নতুন দিকনির্দেশনায়, যেখানে ব্যয়ের উল্লম্ফন নয়, দায়িত্বশীল অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসই হবে মূল প্রতিপাদ্য।

Ad 300x250

সম্পর্কিত