leadT1ad

কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস আজ

আমার লেখা

আজ ১ নভেম্বর। ১৯৫০ সালের এই দিনে প্রয়াত হয় কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে মানুষ ও প্রকৃতির সুগভীর সম্পর্কের বয়ান। স্ট্রিমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যেপাধ্যায়ের লেখক হয়ে ওঠার গল্প।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভূতিভূষণ বন্দ্যেপাধ্যায়। স্ট্রিম গ্রাফিক

আমি কেমন করে লেখক হলাম, এ আমার জীবনের, আমার নিজের কাছেই, একটা অদ্ভুত ঘটনা। অবশ্য হয়তো একথা ঠিক, নিজের জীবনের অতি তুচ্ছতম অভিজ্ঞতাও নিজের কাছে অতি অপূর্ব! তা যদি না হত, তবে জগতে লেখক জাতটারই সৃষ্টি হত না। নিজের অভিজ্ঞতাতে এরা মুগ্ধ হয়ে যায়-আকাশ প্রতিদিনের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে কত কল্পলোক রচনা করছে যুগে যুগে—তার তলে কত শত শতাব্দী ধরে মানুষ নানা তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজের দিন কাটিয়ে চলেছে; মানুষের জন্ম-মৃত্যু, আশা-নৈরাশ্য, হর্ষ-বিষাদ, ঋতুর পরিবর্তন, বনপুষ্পের আবির্ভাব ও তিরোভাব-কতছোট বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে-কে এসব দেখে, এসব দেখে মুগ্ধ হয়?

এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের চোখে কল্পনা সবসময়েই মোহ-অঞ্জন মাখিয়ে দিয়ে রেখেছে। অতি সাধারণ পাখির অতি সাধারণ সুরও তাদের মনে আনন্দের ঢেউ তোলে, অস্তদিগন্তের রক্তমেঘস্তূপ স্বপ্ন জাগায়, আবার হয়তো তারা অতি দুঃখে ভেঙে পড়ে। এরাই হয় লেখক, কবি, সাহিত্যিক। এরা জীবনের সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক। এক যুগের দুঃখবেদনা আশা-আনন্দ অন্য যুগে পৌঁছে দিয়ে যায়।

আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতা তাই চিরদিনই আমার কাছে অভিনব, অমূল্য, দুর্লভ হয়ে রইল। যে ঘটনা আমারজীবনের স্রোতকে সম্পূর্ণ অন্য দিকে বাঁক ফিরিয়ে দিয়েছে—আমার জীবনে তার মূল্য অনেকখানি।

১৯২২ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি নিয়ে ডায়মন্ড হারবার লাইনে একটা পল্লীগ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারির চাকুরি নিয়ে গেলুম আষাঢ় মাসে।

বর্ষাকাল, নতুন জায়গায় গিয়েছি। অপরিচিতের মহল নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করছি। বৈঠকখানা ঘরের সামনে ছোট একটু ঢাকা বারান্দাতে একলা বসে সামনে সদর রাস্তার দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় একটি ষোল-সতেরো বছর বয়সের ছেলেকে একখানা বই হাতে যেতে দেখে তাকে ডাকলাম কাছে। আমার উদ্দেশ্য, তার হাতে কি বই দেখব এবং যদি সম্ভব হয় পড়বার জন্যে চেয়ে নেব একদিনের জন্যে।

বাংলা সাহিত্যকে ভালোবাসতাম বটে, কিন্তু নিজে কলমধরে বই লিখব এ ছিল সম্পূর্ণ দুরাশা আমার কাছে। অবিশ্যি পাঠ্যাবস্থায় অন্য অনেক ছাত্রের মতো কলেজ ম্যাগাজিনে দু-একটা প্রবন্ধ, এক-আধটা কবিতা যে না লিখেছি তা নয়, বা প্রতিবেশীর অনুরোধে বিবাহের প্রীতি-উপহারে কবিতাযে দু-পাঁচটা না লিখেছিলাম তাও নয়। সে কে না লিখে থাকে?

বইখানা দেখেছিলাম, একখানা উপন্যাস। তার কাছে চাইতে সে বললে, এ লাইব্রেরির বই, আজ ফেরত দেওয়ার দিন। আপনাকে তো দিতে পারছি নে, তবে লাইব্রেরি থেকে বই বদলে এনে দেব এখন।

-লাইব্রেরি আছে এখানে?

-বেশ ভালো লাইব্রেরি, অনেক বই। দু আনা চাঁদা।

-আচ্ছা চাঁদা দেব, আমায় বই এনে দিয়ো।

ছোকরা চলে গেল এবং ফেরবার পথে আমাকে একখানা বই দিয়েও গেল। আমি তাঁকে বললাম—তোমার নামটি কি হে?

সে বললে—আমার নাম পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী, কিন্তু এগ্রামে আমাকে সবাই বালক-কবি বলে জানে।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম—বালক-কবি বলে কেন? কবিতা-টবিতা লেখো নাকি?

ছেলেটি উৎসাহের সঙ্গে বললে—লিখি বই কি। না লিখলে কি আমাকে বালক-কবি নাম দিয়েচে? আচ্ছা কাল এনে দেখাব আপনাকে।

পরদিন সে সকাল বেলাতেই এসে হাজির হল। সঙ্গেএকখানা ছাপানো গ্রাম্য মাসিক পত্রিকা গোছের। আমাকেদেখিয়ে বললে—এই দেখুন, এই কাগজখানা আমাদের গাঁথেকে বেরোয়। এর নাম 'বিশ্ব'। এই দেখুন প্রথমেই 'মানুষ' বলে কবিতাটি আমার। এই আমার নাম ছাপার অক্ষরেলেখা আছে কবিতার ওপরে—বলেই ছোকরা সগর্বে কাগজখানা আমার নাকের কাছে ধরে নিজের নামটি আঙুলদিয়ে দেখিয়ে দিলে। হ্যাঁ সত্যিই। লেখা আছে বটে, কবি পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী। তাহলে তো নিতান্ত মিথ্যে বলেনি দেখছি।

কবিতাটি সেই আমায় পড়ে শোনালে। বিশ্বের মধ্যে মানুষের স্থান খুব বড়-ইত্যাদি কথা নানা ছাঁদে তার মধ্যে বলা হয়েছে।

অবশ্য কাগজখানা দেখে আমার খুব ভক্তি হল না। স্টেশনের কাছে একটা ছোট প্রেস আছে এখানে, সেই প্রেসেই ছাপানো,অতি পাতলা জিল-জিলে কাগজ। পত্রিকাখানিকে 'মাসিক', 'পাক্ষিক' ইত্যাদি না বলে 'ঐকিক' বললেই এর স্বরূপ ঠিক বোঝানো হয়। অর্থাৎ যে শ্রেণীর পত্রিকা গ্রামের উৎসাহী লেখা-বাতিকগ্রস্ত ছেলে-ছোকরার দল চাঁদা তুলে একটিবার মাত্র বার করে, কিন্তু পরের বারে উৎসাহ মন্দীভূত হওয়ার দরুন আশানুরূপ চাঁদা না ওঠাতে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়—এ সেই শ্রেণীর পত্রিকা।

একদিন একটা ঘটনা থেকে মনে একটা ছোটগল্পের উপাদান দানা বাঁধল। সেই পল্লীগ্রামে একটি ছায়াবহুলনিভৃত পথ দিয়ে শরতের পরিপূর্ণ আলো ও অজস্রবিহঙ্গকাকলীর মধ্যে প্রতিদিন স্কুলে যাই, আর একটি গ্রাম্যবধূকে দেখি পথপার্শ্বের একটি পুকুর থেকে জল নিয়ে কলসি কক্ষে প্রতিদিন স্নান করে ফেরেন। প্রায়ই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়-কিন্তু দেখা ওই পর্যন্ত। তাঁর পরিচয় আমার অজ্ঞাত এবং বোধ হয় অজ্ঞাত বলেই একটি রহস্যময়ী মূর্তিতে তিনি আমার মানসপটে একটা সাময়িক রেখা অঙ্কিত করেছিলেন।

তবু আমার ঈর্ষা না হয়ে পারল না। আমি লিখি না, বা লেখার কথা কখনো চিন্তাও করি না। অথচ এতটুকু ছেলে এর নাম দিব্যি ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে গেল। এর ওপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হল, মনে ভাবলাম, বেশ ছোকরা তো! অক্ষর মিলিয়ে কেমন কবিতা লিখেছে! সাহিত্যের সমঝদারিত্ব তার মধ্যে ছিল তা আমি জানি। তখনকার আমলের একজন বিশেষ লেখকের বই না থাকলে পল্লীগ্রামের কোনো লাইব্রেরি চলত না। সেই লেখকের একখানা বই-এর তিন-চারকপি পর্যন্ত রাখতে হত কোনো-কোনো বড় লাইব্রেরিতে।

ছেলেটি বলত—ওসব ট্র্যাশ-ট্র্যাশ! দেখবেন ওসব টিকবে না।

এক এক দিন পাঁচুগোপাল আমাকে নিয়ে গ্রামের বাইরে মাঠে বেড়াতে যেত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখও তার বেশ ছিল।মাঝে মাঝে মুখে মুখে কবিতা তৈরি করে আমাকে শোনাত। অনেকগুলো কবিতা হলে পর একটা কবিতার বই ছাপাবে এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করত। সেই সময় কলকাতার কোনো 'পাবলিশিং হাউস' ছয়-আনা গ্রন্থাবলী প্রকাশ শুরু করে দিল-তার প্রথম বই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের বইখানি স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে পাঁচুগোপাল আমায় এনে দিয়ে বললে— “এ বই নিতে ভিড় নেই। নতুন এসেছে, এক আধ জন নিয়েছিল, কালই ফেরত দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু দেখুনগে যান অমুকের বই-এর জন্যে কি যে মারামারি। ডিটেকটিভ উপন্যাস না রাখলে লাইব্রেরি উঠে যাবে। কেউ চাঁদা দেবে না।" পরের মাসে আর একখানা বই বেরুল। সেখানা আমার কাছে নিয়ে এসে সেবললে—"আমি একটা কথা ভাবছি, আসুন আপনাতে আমাতে এইরকম উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক। খুব বিক্রি হবে, আর একটা নামও থেকে যাবে। আপনি যদি ভরসা দেন, আমি উঠে পড়ে লাগি।" আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম- "তুমি আর আমি দুজনে মিলে বই-এর কারবার করব, এ কখনো সম্ভব? এ ব্যবসার আমরা কিই বা জানি? তা ছাড়া বই লিখবেই বা কে? এতে লেখকদের পারিশ্রমিক দিতে হবে, সে পয়সাই বা দেবে কে?"

সে হেসে বললে-"বাঃ তা কেন, বই লিখবেন আপনি, আমিও দু-একখানা লিখব। পরকে টাকা দিতে যাব কেন।"

বাংলা সাহিত্যকে ভালোবাসতাম বটে, কিন্তু নিজে কলমধরে বই লিখব এ ছিল সম্পূর্ণ দুরাশা আমার কাছে। অবিশ্যি পাঠ্যাবস্থায় অন্য অনেক ছাত্রের মতো কলেজ ম্যাগাজিনে দু-একটা প্রবন্ধ, এক-আধটা কবিতা যে না লিখেছি তা নয়, বা প্রতিবেশীর অনুরোধে বিবাহের প্রীতি-উপহারে কবিতাযে দু-পাঁচটা না লিখেছিলাম তাও নয়। সে কে না লিখে থাকে?

সুতরাং আমি তাঁকে বললাম—"লেখা কি ছেলেখেলা হে যে কলম নিয়ে বসলেই হল? ওসব খামখেয়ালি ছাড়। আমি কখনো লিখিনি, লিখতে পারবও না। তুমি হয়তো পারবে। আমার দ্বারা ওসব হবে না।"

সে বললে—"খুব হবে। আপনি যখন বি.এ. পাস, তখন আপনার কাছে এমন কিছু কঠিন হবে না। একটু চেষ্টা করুন, তাহলেই হয়ে যাবে।"

সাতপাঁচ ভেবে একদিন স্থির করলাম—এক কাজ করা যাক। সে এক টাকা সিরিজের বই কোনোদিনই বের করতে পারবে না। ওর টাকা কোথায় যে বই ছাপাবে? বরং আমি একখানা খাতায় যা হয় একটা কিছু লিখে রাখি—লোকে যদি দেখতে চায়, খাতাখানা দেখিয়ে বলা যাবে, আমারতো লেখাই রয়েছে, ছাপা না হলে আমি কি করব।

তখন বয়েস অল্প, বুদ্ধিসুদ্ধি পাকেনি, তবুও আমার মনে হল, বি.এ. পাস তো অনেকেই করে, তাদের মধ্যে সকলেই লেখক হয় না কেন? অথচ বি.এ. পাস করা লোকেদের ওপর পাঁচুগোপালের এই অহেতুক শ্রদ্ধা ভেঙে দিতেও মন চাইল না। এ নিয়ে কোনো তর্ক আমি আর তাঁর সঙ্গে করিনি।

কিন্তু করলেই ভালো হত, কারণ এর ফল হয়ে দাঁড়াল বিপরীত। দিন দশেক পরে একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সেখানে নোটিশ-বোর্ডে, দেওয়ালের গায়ে, নারকেল গাছের গুঁড়িতে সর্বত্র ছাপানো কাগজ টাঙানো। তাতে লেখা আছে— বাহির হইল ! বাহির হইল!! বাহির হইল!!! এক টাকা মূল্যের গ্রন্থমালার প্রথম উপন্যাস।

লেখকের নামের স্থানে আমার নাম দেখলাম।

আমার তো চক্ষুস্থির। এ নিশ্চয় সেই পাঁচুগোপালের কীর্তি। এমন ছেলেমানুষি সে করে বসবে জানলে কি তার সঙ্গে মিশি! বিপদের ওপর বিপদ, স্কুলে ঢুকতেই শিক্ষকছাত্রবৃন্দ সবাই জিজ্ঞেস করে, —"আপনি লেখক তা তোএতদিন জানতাম না মশাই? বেশ! তা বইখানা কি বেরিয়েছে নাকি? আমাদের একবার দেখিয়ে যাবেন।" হেডমাস্টার ডেকে বললেন, তাঁর স্কুলের লাইব্রেরিতে একখানা বই দিতে হবে। সকলের নানারূপ সকৌতূহল প্রশ্ন এড়িয়ে চলি সারাদিন—কবে থেকে আমি লিখছি, আর আর কি বই আছে, ইত্যাদি। স্কুলের ছুটির পরে বাইরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। এমন বিপদেও মানুষ পড়ে!

তাকে খুঁজে বার করলাম বাসায় এসে। দস্তুর মতো তিরস্কার করলাম তাকে, এ তার কি কাণ্ড! কথার কথা একবার একটা হয়েছিল বলে একেবারে নাম ছাপিয়ে এরকমভাবে বার করে, লোকে কি ভাবে!

সে নির্বাক হয়ে দাঁত বার করে হাসতে হাসতেবললে- "তাতে কি হয়েছে? আপনি তো একরকম রাজিই হয়েছেন লিখতে। লিখুন না কেন!"

আমি বললাম—"বেশ ছেলে বটে তুমি! কোথায় কি তার ঠিক নেই, তুমি নাম ছাপিয়ে দিলে কি বলে, আর দিলে দিলে একেবারে স্কুলের দেওয়ালে, নোটিশ বোর্ডে সর্বত্রছ ড়িয়ে দিয়েছ, এ কেমন কাণ্ড? নামই বা পেলে কোথায়? কে তোমাকে বলেছিল ও নামে আমি কিছু লিখেছি বা লিখব?"

যাক—পাঁচুগোপাল তো চলে গেল হাসতে হাসতে। এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে সকলের প্রশ্নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হল—বই বেরুচ্চে কবে? কত দেরি আছে আর বই বেরুবার? মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। সে যা ছেলেমানুষি করে ফেলেছে তার আর চারা নেই। আমিএখন নিজের মান বজায় রাখি কেমন করে? লোকের অত্যাচারের চোটে তো অস্থির হয়ে পড়তে হয়েচে।

সাতপাঁচ ভেবে একদিন স্থির করলাম—এক কাজ করা যাক। সে এক টাকা সিরিজের বই কোনোদিনই বের করতে পারবে না। ওর টাকা কোথায় যে বই ছাপাবে? বরং আমি একখানা খাতায় যা হয় একটা কিছু লিখে রাখি—লোকে যদি দেখতে চায়, খাতাখানা দেখিয়ে বলা যাবে, আমারতো লেখাই রয়েছে, ছাপা না হলে আমি কি করব। কিন্তু লিখি কি? জীবনে কখনো গল্প লিখিনি, কি করে লিখতে হয় তাও জানা নেই। কি ভাবে প্লট জোগাড় করে, কি কৌশলে তা থেকে গল্প ফাঁদে-কে বলে দেবে?প্ল টই বা পাই কোথায়? আকাশ-পাতাল ভাবি প্রতিদিন, কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নে। গল্প লেখার চেষ্টা কোনোদিন করিনি। পাঠ্যাবস্থায় সুরেন বাঁডুজ্যে ও বিপিন পালের বক্তৃতা শুনে সাধ হত, লেখক হতে পারি আর না পারি, একজন বড় বক্তা হতে হবেই।

এক এক দিন পাঁচুগোপাল আমাকে নিয়ে গ্রামের বাইরে মাঠে বেড়াতে যেত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখও তার বেশ ছিল।মাঝে মাঝে মুখে মুখে কবিতা তৈরি করে আমাকে শোনাত। অনেকগুলো কবিতা হলে পর একটা কবিতার বই ছাপাবে এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করত। সেই সময় কলকাতার কোনো 'পাবলিশিং হাউস' ছয়-আনা গ্রন্থাবলী প্রকাশ শুরু করে দিল-তার প্রথম বই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ।

কিন্তু লেখক হবার কোনো আগ্রহই কোনোদিন ছিল না, সে চেষ্টাও করিনি। কাজেই প্রথমে মুশকিলে পড়ে গেলাম। সাত-পাঁচ ভেবে প্লট সংগ্রহ করতে পারি না কিছুতেই। মন তখন বিশ্লেষণমুখী অভিব্যক্তির পথ খুঁজে পায়নি। সব কিছুতেই সন্দেহ, সব কিছুতেই ভয়।

অবশেষে একদিন একটা ঘটনা থেকে মনে একটা ছোটগল্পের উপাদান দানা বাঁধল। সেই পল্লীগ্রামে একটি ছায়াবহুলনিভৃত পথ দিয়ে শরতের পরিপূর্ণ আলো ও অজস্রবিহঙ্গকাকলীর মধ্যে প্রতিদিন স্কুলে যাই, আর একটি গ্রাম্যবধূকে দেখি পথপার্শ্বের একটি পুকুর থেকে জল নিয়ে কলসি কক্ষে প্রতিদিন স্নান করে ফেরেন। প্রায়ই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়-কিন্তু দেখা ওই পর্যন্ত। তাঁর পরিচয় আমার অজ্ঞাত এবং বোধ হয় অজ্ঞাত বলেই একটি রহস্যময়ী মূর্তিতে তিনি আমার মানসপটে একটা সাময়িক রেখা অঙ্কিত করেছিলেন। মনে মনে ভাবলাম এই প্রতিদিনের দেখা অথচ সম্পূর্ণ অপরিচিত বধূটিকে কেন্দ্র করে একটি গল্প আরম্ভ করা যাক তো, কি হয় দেখি! গল্পশেষ করে সেই গ্রামের দু-একজনকে পড়ে শোনালাম—পাঁচুকেও। কেউ বলে ভালো হয়েচে, কেউ বলে মন্দ হয়নি। আমার একটি বন্ধুকে কলকাতা থেকে নিমন্ত্রণ করে গল্পটি শুনিয়েদিলাম। সে-ও বললে ভালোহয়েচে। আমি তখন একেবারে কাঁচা লেখক; নিজের ক্ষমতার ওপর কোনো বিশ্বাস আদৌ জন্মায়নি। যে আত্মপ্রত্যয় লেখকের একটি বড় পুঁজি, আমি তখন তা থেকে বহু দূরে, সুতরাং অপরের মতামতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কি। আমার কলকাতার বন্ধুটির সমঝদারিত্বের ওপর আমার শ্রদ্ধা ছিল—তার মত শুনে খুশি হলাম।

পাড়াগাঁয়ে স্কুলমাস্টারি করি। কলকাতার কোনো সাহিত্যিক বা পত্রিকা-সম্পাদককেই চিনি না। সুতরাং লেখা ছাপানো সম্বন্ধে আমায় একপ্রকার হতাশ হতে হল। এইভাবে পূজার অবকাশ এসে গেল, ছুটিতে দেশে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম। পুনরায় ফিরে এসে কাগজপত্রের মধ্যে থেকে আমার সেই লেখাটি একদিন বার করে ভাবলাম, আজ এটি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।

ঘুরতে ঘুরতে একটা পত্রিকা আপিসের সামনে এসে পড়া গেল। আমার মতো অজ্ঞাত অখ্যাত নতুন লেখকের রচনা তারা ছাপবে এ দুরাশা আমার ছিল না, তবু সাহস করে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। দেখা যাক না কি হয়, কেউ খেয়ে তো ফেলবে না, না হয় লেখা না-ই ছাপবে। ঘরে ঢুকেই একটি ছোট টেবিলের সামনে যাঁকে কর্মরত দেখলাম, তাঁকে নমস্কার করে ভয়ে ভয়ে বলি—"একটা লেখাএনেছিলাম"। ভদ্রলোক মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, "আর কোথাও আপনার লেখা কি বেরিয়েছিল? আচ্ছা রেখে যান, মনোনীত না হলে ফেরত যাবে। ঠিকানাটা রেখে যাবেন।"

লেখা দিয়ে এসে স্কুলের সহকর্মী ও গ্রামের আলাপী বন্ধুদের বলি—"লেখাটা নিয়ে বলেছে শিগগির ছাপবে।" চুপি চুপি ডাকঘরে গিয়ে বলে এলাম, আমার নামে যদি বুকপোস্ট গোছের কিছু আসে, তবে আমাকে স্কুলে বিলি না করা হয়। কারণ লেখা ফেরত এসেছে এটা তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে সহকর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে। দিন গুনি, একদিন সত্যিই ডাকপিয়ন স্কুলে আমায় বললে—আপনার নামে একটা বুকপোস্ট এসেচে, কিন্তু গিয়ে নিয়ে আসবেন। আমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। নবজাত রচনার প্রতি অপরিসীম দরদ যাঁরা অনুভব করেছেন তাঁরা বুঝবেন আমার দুঃখ। এতদিনের আকাশকুসুম চয়ন তবে ব্যর্থ হল, লেখা ফেরত দিয়েচে।

কিন্তু পরদিন ডাকঘর থেকে বুকপোস্ট নিয়ে খুলে দেখি যে, আমার রচনাই বটে, কিন্তু তার সঙ্গে পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের চিঠি। তাতে লেখা আছে, রচনাটি তাঁরা মনোনীত করেচেন, তবে সামান্য একটু-আধটু অদল-বদলের জন্যে ফেরত পাঠানো হল, সেটুকু করে আমি যেন লেখাটি তাঁদের ফেরত পাঠাই, সামনের মাসেই ওটা ছাপা হবে।

অপূর্ব আনন্দ আর দিগ্বিজয়ীর গর্ব নিয়ে ডাকঘর থেকে ফিরি। সগর্বে নিয়ে গিয়ে চিঠিখানা দেখাতেই সবাই বললেন—"কারুর সঙ্গে আপনার আলাপ আছে বুঝি ওখানে? আজকাল আলাপ না থাকলে কিছু হবার জো-টি নেই। সব খোশামোদ, জানেনই তো।" তাঁদের আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, যাঁর হাতে লেখা দিয়ে এসেছিলাম, তাঁর নাম পর্যন্ত আমার জানা নেই! তারপর সে গ্রামের এমন কোনো লোক রইল না যে আমার চিঠিখানা না একবার দেখলে। কারো সঙ্গে দেখা হলে পথে তাকে আটকাই এবং সম্পূর্ণ অকারণে চিঠিখানা আমার পকেট থেকে বেরিয়ে আসে, এবং বিপন্ন মুখে তাকে বলি—তাই তো, ওরা আবার একখানা চিঠি দিয়েচে, একটা লেখা চায়-সময়ই বা তেমন কই। হায়, সে সব লেখকজীবনের প্রথম দিনগুলি! সে আনন্দ, সে উৎসাহ, ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার বিস্ময় আজও স্মরণে আছে, ভুলিনি। নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে গৌরব এবং আত্মপ্রসাদ নিহিত, লেখকজীবনের বড় পুরস্কার সবচেয়ে তাই-ই। স্বচ্ছ সরল ভাবানুভূতির যে বাণীরূপ কবি ও কথাশিল্পী তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে যান-তা সার্থক হয়তখনই, যখন পাঠক সেই ভাব নিজের মধ্যে অনুভব করেন। এইজন্য লেখক ও পাঠকের সহানুভূতি ভিন্ন কখনই কোনো রচনাই সার্থকতা লাভ করতে পারে না।

বালক-কবির নিকট আমি কৃতজ্ঞ। সে-ই একরকম জোর করে আমাকে সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে নামিয়েছিল।

পাঁচুগোপালের সঙ্গে মাঝে দেখা হয়েছিল। সে তখন চব্বিশ পরগণার কাছে কি একটা গ্রামের উচ্চ প্রাথমিকপাঠশালার হেডমাস্টার। এখনো সে কবিতা লেখে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত