বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন চলছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড়। এতে নারী প্রার্থীর সংখ্যা এমনিতেই কম। তার ওপরে গণমাধ্যমগুলোতে এসব নারী প্রর্থীকে সীমিত আকারেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। নারী প্রার্থীদের উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে আমাদের দেশের গণমাধ্যমের মনস্তত্ত্বটি কেমন?
নাজিয়া আফরিন
আমার সাড়ে ১২ বছরের ‘প্রি-টিন’ ছেলে প্রায়ই আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করে ধরাশায়ী করে। অতিসম্প্রতি তার সঙ্গে আমার যে বিষয় নিয়ে বাকযুদ্ধের অবতারণা হয় তা হলো, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব। একজন ছেলে সন্তানের মা হিসেবে আমি সক্রিয়ভাবেই তাকে ‘মিসোজিনি’ বা নারী বিদ্বেষমূলক ধারণা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। কাজেই তার মুখে পুরুষবন্দনা শুনে আমার ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়। কেন সে এমন বোধ করছে, তা জানতেই চাইলে উত্তর এল, সব সিনেমায়, টিভি সিরিজ বা কন্টেন্টে নায়ক ও কেন্দ্রীয় চরিত্র পুরুষ, মেয়েরা তাদের আশপাশে ঘোরে, এমনকি খেলাতেও পুরুষেরই দৌরাত্ম। আমি যখন বললাম, কেন? মেয়েরাও তো ফুটবল, ক্রিকেট খেলছে।
তখন আমার ছেলে কাঁধ ঝাকিয়ে জবাব দিল, ওগুলো কেউ দেখে না। আজীবন কর্মজীবী সচেতন মায়ের সন্তান হয়েও সে যে এই বৈষম্যমূলক বয়ান গ্রহণ করছে, এর কারণ কী?
কারণ খোঁজার আগে যে বিষয় বোঝা দরকার, তা হলো বয়ান কী?
একেবারে সহজ ভাষায় বললে, বয়ান বা ‘ন্যারেটিভ’ হলো যে উপায়ে একটি গল্প বলা হয়। ঘটনা, চরিত্র ও ধারণাকে সুতো দিয়ে গাঁথা হয়। তবে কৌশলগতভাবে বয়ানের ব্যবহার হয় মানুষের মতামত গঠনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করার জন্য। এ পৃথিবী কীভাবে পরিচালিত হয়, সে বিষয়ে মানুষের বিশ্বাস কী হবে, তা নির্ধারণ করে দেয় বয়ান। কাজেই ক্ষমতা কাঠামোর বিন্যাসে বয়ান খু্বই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আধিপত্য বজায় রাখার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারও তাই এই বয়ান। আর বয়ান নির্মাণে বড় ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম।
২.
সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট হলের ‘রেপ্রেজেন্টেশন থিওরি’ বা প্রতিনিধিত্বতার তত্ত্ব বলে, মিনিং বা অর্থ কোনো বিষয়ের ভেতরে থাকা একেবারেই সহজাত কোনো ব্যাপার নয়। অর্থ গড়ে ওঠে সামাজিক পটভূমিতে ভাষা, ছবি বা প্রতীকের মাধ্যমে। এভাবে দেখলে বলা যায়, গণমাধ্যম সরলভাবে শুধু বাস্তবের প্রতিফলন ঘটায় না। গণমাধ্যম যে বয়ান নির্মাণ করে, বেশির ভাগ সময়ই তা দাপুটে মতাদর্শের প্রতিনিধিত্বই তৈরি করে। সেই মতাদর্শ অনুয়ায়ীই গণমাধ্যম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে আকার দেয়। জন্ম দেয় ‘স্টেরিওটাইপ’ বা গৎবাঁধা চিন্তার। যেমন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজ মানসে এমন ধারণা আছে যে পুরুষ যা পরে, অনেক ক্ষেত্রে নারী তা পারে না। বলা বাহুল্য, এটি পুরুষ-মানসিকতার তৈরি একটি গৎবাঁধা ধারণা।
তবে এ ধারণা নির্মাণের প্রক্রিয়াটি একেবারেই সহজ নয়। স্টুয়ার্ট হল বলছেন, যেকোনো বার্তা প্রদান ও গ্রহণের পরিক্রমা সম্পন্ন হয় ‘এনকোডিং’ ও ‘ডিকোডিং’--এই দুইয়ের মাধ্যমে। এনকোডিং হলো বার্তা উৎপাদন--অর্থাৎ সাংকেতিক অর্থের একটি ব্যবস্থা। এই অর্থ সৃষ্টি করতে যিনি বার্তা দেবেন, তাঁকে বুঝতে হবে বার্তাটি যিনি গ্রহণ করবেন, তাঁর কাছে দুনিয়াটি কেমন। তবে অনেক সময় বার্তার উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে কীভাবে তা ‘এনকোডেড’ হবে।
আর আর ‘ডিকোডিং’ হলো, যিনি বার্তা গ্রহণ করছেন, তিনি সেটি কীভাবে বুঝবেন এবং ব্যাখ্যা করবেন। বার্তাটি যিনি গ্রহণ করেন, তিনি বার্তায় থাকা সংকেতগুলোর নিজের মতো অর্থ তৈরির চেষ্টা করেন। এর ফলে যে বার্তা আসে, তা নতুন অর্থ তৈরির চেষ্টার মাধ্যমে পুননির্মিত হয়। আর কোনো কার্যকর যোগাযোগ তখনই সম্পন্ন হয়, যখন কাঙ্ক্ষিত উপায়ে বার্তাটি গ্রহণ করা যায় এবং তা বোধগম্য হয়। তবে বার্তাটি যিনি গ্রহণ করেন, তিনি ওই বার্তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়েও ব্যাখ্যা করতে পারেন। হলের মতে, এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে ‘বিকৃতি’ বা ‘ভুল বোঝাবুঝি’রও সৃষ্টি হতে পারে।
৩.
এবার আসি বর্তমানে গণমাধ্যমের অন্যতম ট্রেন্ডিং ইস্যুতে। দেশজুড়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি এখন আলোচনায়। পত্রিকা থেকে টেলিভিশন চ্যানেল, ওয়েবসাইট থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম--সবখানেই বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের একের পর এক খবর, সাক্ষাৎকার ও মন্তব্য-মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। দুদিন আগেই দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চোখে পড়ল ডাকসুর অন্যতম পাঁচ জিএস পদপ্রার্থীকে নিয়ে টক শো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠে পাঁচজন পুরুষ প্রতিনিধিত্ব করছেন দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের। বলা ভালো, টক শোটি যিনি সঞ্চালনা করছিলেন, তিনিও পুরুষ। এখানে গণমাধ্যমটি কোন বার্তা এনকোড করার চেষ্টা করছেন, তা অনুমান করার পথে আমরা আপাতত হাঁটছি না। তবে আমার সাড়ে ১২ বছরের ছেলে। স্মার্টফোন পকেটে নিয়ে জন্মানো প্রজন্মের অংশ। পৃথিবী সম্পর্কে তার জানা-বোঝার অনেকটাই ডিজিটাল মাধ্যমনির্ভর। সে যখন এই কন্টেন্ট দেখবে, তখন কী বার্তা পাবে? কীভাবে সে এই কন্টেন্টকে ডিকোড করবে? কন্টেন্টের মধ্যে নারীর অনুপস্থিতিকে কি সে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেবে না? সে কি মনে করবে না পুরুষই আধিপত্যশীল, দাপুটে?
৪.
‘নারীবাদ কী?’ ১৯১৬ সালে এ প্রশ্নের জবাবে মার্কিন লেখিকা ও মানবতাবাদী শার্লট পারকিন্স গিলম্যান লিখেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থে নারীবাদ হলো দুনিয়ার সব নারীর এক সামাজিক জাগরণ। এটা সেই মহান আন্দোলন, যা আংশিক সচেতন এবং বৃহত্তর অংশে অবচেতন। মানবজীবনে মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র পাল্টে দিচ্ছে এই আন্দোলন। এত দিন আমরা একটি পুরুষনির্মিত দুনিয়ায় বাস করছিলাম, যেখানে নারী লিঙ্গ হিসেবে ভালোবাসা, মা হিসেবে স্বীকৃতি এবং চাকর হিসেবে শোষিত হয়েছে। ভালোবাসা, স্বীকৃতি ও শোষণের বাইরে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না…“নারীবাদ” হলো তাদেরই উত্থান।’
কিন্তু নারীবাদের চতুর্থ ঢেউ পার করেও নারী এখনো সেই পুরুষনির্মিত বিশ্বের আধিপত্যশীল বয়ানেরই অধীন। আর এখন তারই প্রতিফলন ঘটছে দেশের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কভারেজেও। হররোজ সমতা ও বৈষম্যহীনতার তাগিদ সত্ত্বেও নারীকে আলঙ্কারিকভাবে দেখানোর প্রবণাতা বারবারই চোখে পড়ে।
এ বাস্তবতায় দীর্ঘদিনের এই বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করতে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবয়ান নির্মাণের সক্রিয়তা এখন খুব প্রয়োজন। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না।
৫.
দেশের স্বায়ত্তশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ছাত্র সংসদগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা কোনো পদ রাখা হয়নি। এদিক থেকে ব্যতিক্রম শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বা নির্দিষ্ট কোনো পদ রাখা হয়নি। এ ছাড়া নেই একই পদের বিপরীতে আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতার সু্যোগ। এদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (রাকসু) নির্দিষ্টভাবে নারীবিষয়ক সম্পাদক পদ থাকলেও অন্য পদগুলোতে ছাত্রীদের আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ নেই। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম জাকসুতে শীর্ষ তিন পদের একটি এজিএস পদে নারীদের আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অন্য কয়েকটি পদেও নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ দেখা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে যা দেখা যায় তা হলো, নারী প্রার্থীদের সংখ্যা খুবই নগন্য। বিশেষত বড় পদগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। আফসোসের ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নারী শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি নিয়ে ততটা সরব নন। এমনও হতে পারে, অনেকে হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে সেভাবে জানেনও না। কিন্তু এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমেরও তো কিছুটা ভূমিকা রয়েছে।
সব কিছু মিলিয়ে নারীকে অগ্রসর বা নেতৃত্বশীল ভূমিকায় দেখাটা সাধারণ নয়, বরং ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ততা তৈরি হওয়ার ফলে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান এখনো অটুট। বৈষম্যের এই বয়ানের প্রতিবয়ান তৈরির জন্য তাই গণমাধ্যমের বার্তার ‘এনকোডিং’-এ এখন পরিবর্তন আসা কি খুব প্রয়োজনীয় নয়? সময় তো বহিয়া যায়…।
আমার সাড়ে ১২ বছরের ‘প্রি-টিন’ ছেলে প্রায়ই আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করে ধরাশায়ী করে। অতিসম্প্রতি তার সঙ্গে আমার যে বিষয় নিয়ে বাকযুদ্ধের অবতারণা হয় তা হলো, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব। একজন ছেলে সন্তানের মা হিসেবে আমি সক্রিয়ভাবেই তাকে ‘মিসোজিনি’ বা নারী বিদ্বেষমূলক ধারণা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। কাজেই তার মুখে পুরুষবন্দনা শুনে আমার ভিমড়ি খাওয়ার যোগাড়। কেন সে এমন বোধ করছে, তা জানতেই চাইলে উত্তর এল, সব সিনেমায়, টিভি সিরিজ বা কন্টেন্টে নায়ক ও কেন্দ্রীয় চরিত্র পুরুষ, মেয়েরা তাদের আশপাশে ঘোরে, এমনকি খেলাতেও পুরুষেরই দৌরাত্ম। আমি যখন বললাম, কেন? মেয়েরাও তো ফুটবল, ক্রিকেট খেলছে।
তখন আমার ছেলে কাঁধ ঝাকিয়ে জবাব দিল, ওগুলো কেউ দেখে না। আজীবন কর্মজীবী সচেতন মায়ের সন্তান হয়েও সে যে এই বৈষম্যমূলক বয়ান গ্রহণ করছে, এর কারণ কী?
কারণ খোঁজার আগে যে বিষয় বোঝা দরকার, তা হলো বয়ান কী?
একেবারে সহজ ভাষায় বললে, বয়ান বা ‘ন্যারেটিভ’ হলো যে উপায়ে একটি গল্প বলা হয়। ঘটনা, চরিত্র ও ধারণাকে সুতো দিয়ে গাঁথা হয়। তবে কৌশলগতভাবে বয়ানের ব্যবহার হয় মানুষের মতামত গঠনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করার জন্য। এ পৃথিবী কীভাবে পরিচালিত হয়, সে বিষয়ে মানুষের বিশ্বাস কী হবে, তা নির্ধারণ করে দেয় বয়ান। কাজেই ক্ষমতা কাঠামোর বিন্যাসে বয়ান খু্বই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আধিপত্য বজায় রাখার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারও তাই এই বয়ান। আর বয়ান নির্মাণে বড় ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম।
২.
সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট হলের ‘রেপ্রেজেন্টেশন থিওরি’ বা প্রতিনিধিত্বতার তত্ত্ব বলে, মিনিং বা অর্থ কোনো বিষয়ের ভেতরে থাকা একেবারেই সহজাত কোনো ব্যাপার নয়। অর্থ গড়ে ওঠে সামাজিক পটভূমিতে ভাষা, ছবি বা প্রতীকের মাধ্যমে। এভাবে দেখলে বলা যায়, গণমাধ্যম সরলভাবে শুধু বাস্তবের প্রতিফলন ঘটায় না। গণমাধ্যম যে বয়ান নির্মাণ করে, বেশির ভাগ সময়ই তা দাপুটে মতাদর্শের প্রতিনিধিত্বই তৈরি করে। সেই মতাদর্শ অনুয়ায়ীই গণমাধ্যম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে আকার দেয়। জন্ম দেয় ‘স্টেরিওটাইপ’ বা গৎবাঁধা চিন্তার। যেমন দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজ মানসে এমন ধারণা আছে যে পুরুষ যা পরে, অনেক ক্ষেত্রে নারী তা পারে না। বলা বাহুল্য, এটি পুরুষ-মানসিকতার তৈরি একটি গৎবাঁধা ধারণা।
তবে এ ধারণা নির্মাণের প্রক্রিয়াটি একেবারেই সহজ নয়। স্টুয়ার্ট হল বলছেন, যেকোনো বার্তা প্রদান ও গ্রহণের পরিক্রমা সম্পন্ন হয় ‘এনকোডিং’ ও ‘ডিকোডিং’--এই দুইয়ের মাধ্যমে। এনকোডিং হলো বার্তা উৎপাদন--অর্থাৎ সাংকেতিক অর্থের একটি ব্যবস্থা। এই অর্থ সৃষ্টি করতে যিনি বার্তা দেবেন, তাঁকে বুঝতে হবে বার্তাটি যিনি গ্রহণ করবেন, তাঁর কাছে দুনিয়াটি কেমন। তবে অনেক সময় বার্তার উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে কীভাবে তা ‘এনকোডেড’ হবে।
আর আর ‘ডিকোডিং’ হলো, যিনি বার্তা গ্রহণ করছেন, তিনি সেটি কীভাবে বুঝবেন এবং ব্যাখ্যা করবেন। বার্তাটি যিনি গ্রহণ করেন, তিনি বার্তায় থাকা সংকেতগুলোর নিজের মতো অর্থ তৈরির চেষ্টা করেন। এর ফলে যে বার্তা আসে, তা নতুন অর্থ তৈরির চেষ্টার মাধ্যমে পুননির্মিত হয়। আর কোনো কার্যকর যোগাযোগ তখনই সম্পন্ন হয়, যখন কাঙ্ক্ষিত উপায়ে বার্তাটি গ্রহণ করা যায় এবং তা বোধগম্য হয়। তবে বার্তাটি যিনি গ্রহণ করেন, তিনি ওই বার্তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়েও ব্যাখ্যা করতে পারেন। হলের মতে, এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে ‘বিকৃতি’ বা ‘ভুল বোঝাবুঝি’রও সৃষ্টি হতে পারে।
৩.
এবার আসি বর্তমানে গণমাধ্যমের অন্যতম ট্রেন্ডিং ইস্যুতে। দেশজুড়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি এখন আলোচনায়। পত্রিকা থেকে টেলিভিশন চ্যানেল, ওয়েবসাইট থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম--সবখানেই বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীদের একের পর এক খবর, সাক্ষাৎকার ও মন্তব্য-মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। দুদিন আগেই দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চোখে পড়ল ডাকসুর অন্যতম পাঁচ জিএস পদপ্রার্থীকে নিয়ে টক শো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠে পাঁচজন পুরুষ প্রতিনিধিত্ব করছেন দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের। বলা ভালো, টক শোটি যিনি সঞ্চালনা করছিলেন, তিনিও পুরুষ। এখানে গণমাধ্যমটি কোন বার্তা এনকোড করার চেষ্টা করছেন, তা অনুমান করার পথে আমরা আপাতত হাঁটছি না। তবে আমার সাড়ে ১২ বছরের ছেলে। স্মার্টফোন পকেটে নিয়ে জন্মানো প্রজন্মের অংশ। পৃথিবী সম্পর্কে তার জানা-বোঝার অনেকটাই ডিজিটাল মাধ্যমনির্ভর। সে যখন এই কন্টেন্ট দেখবে, তখন কী বার্তা পাবে? কীভাবে সে এই কন্টেন্টকে ডিকোড করবে? কন্টেন্টের মধ্যে নারীর অনুপস্থিতিকে কি সে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ধরে নেবে না? সে কি মনে করবে না পুরুষই আধিপত্যশীল, দাপুটে?
৪.
‘নারীবাদ কী?’ ১৯১৬ সালে এ প্রশ্নের জবাবে মার্কিন লেখিকা ও মানবতাবাদী শার্লট পারকিন্স গিলম্যান লিখেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থে নারীবাদ হলো দুনিয়ার সব নারীর এক সামাজিক জাগরণ। এটা সেই মহান আন্দোলন, যা আংশিক সচেতন এবং বৃহত্তর অংশে অবচেতন। মানবজীবনে মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র পাল্টে দিচ্ছে এই আন্দোলন। এত দিন আমরা একটি পুরুষনির্মিত দুনিয়ায় বাস করছিলাম, যেখানে নারী লিঙ্গ হিসেবে ভালোবাসা, মা হিসেবে স্বীকৃতি এবং চাকর হিসেবে শোষিত হয়েছে। ভালোবাসা, স্বীকৃতি ও শোষণের বাইরে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না…“নারীবাদ” হলো তাদেরই উত্থান।’
কিন্তু নারীবাদের চতুর্থ ঢেউ পার করেও নারী এখনো সেই পুরুষনির্মিত বিশ্বের আধিপত্যশীল বয়ানেরই অধীন। আর এখন তারই প্রতিফলন ঘটছে দেশের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কভারেজেও। হররোজ সমতা ও বৈষম্যহীনতার তাগিদ সত্ত্বেও নারীকে আলঙ্কারিকভাবে দেখানোর প্রবণাতা বারবারই চোখে পড়ে।
এ বাস্তবতায় দীর্ঘদিনের এই বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করতে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবয়ান নির্মাণের সক্রিয়তা এখন খুব প্রয়োজন। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না।
৫.
দেশের স্বায়ত্তশাসিত চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ছাত্র সংসদগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা কোনো পদ রাখা হয়নি। এদিক থেকে ব্যতিক্রম শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বা নির্দিষ্ট কোনো পদ রাখা হয়নি। এ ছাড়া নেই একই পদের বিপরীতে আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতার সু্যোগ। এদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (রাকসু) নির্দিষ্টভাবে নারীবিষয়ক সম্পাদক পদ থাকলেও অন্য পদগুলোতে ছাত্রীদের আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ নেই। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম জাকসুতে শীর্ষ তিন পদের একটি এজিএস পদে নারীদের আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অন্য কয়েকটি পদেও নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ দেখা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছাত্রসংসদ নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে যা দেখা যায় তা হলো, নারী প্রার্থীদের সংখ্যা খুবই নগন্য। বিশেষত বড় পদগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। আফসোসের ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নারী শিক্ষার্থীরাও বিষয়টি নিয়ে ততটা সরব নন। এমনও হতে পারে, অনেকে হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে সেভাবে জানেনও না। কিন্তু এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমেরও তো কিছুটা ভূমিকা রয়েছে।
সব কিছু মিলিয়ে নারীকে অগ্রসর বা নেতৃত্বশীল ভূমিকায় দেখাটা সাধারণ নয়, বরং ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ততা তৈরি হওয়ার ফলে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান এখনো অটুট। বৈষম্যের এই বয়ানের প্রতিবয়ান তৈরির জন্য তাই গণমাধ্যমের বার্তার ‘এনকোডিং’-এ এখন পরিবর্তন আসা কি খুব প্রয়োজনীয় নয়? সময় তো বহিয়া যায়…।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রগতিশীল চিন্তার ‘বাতিঘর’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ সেখানেই সম্প্রতি এক ছাত্রীকে দলবদ্ধধ র্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এক তিক্ত সত্যকে সামনে এনেছে।
১৯ ঘণ্টা আগেনতুন শাসক দল আসা মানেই গণতান্ত্রিক পরিবর্তন হবে, বিষয়টি অতটা সহজ নয়। আসল প্রশ্ন হলো, সত্যিই রাজনৈতিক স্থিতি আসবে, নাকি কেবল এক পঙ্গু চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটবে?
১ দিন আগে‘মুসলমান’ ও ‘বাংলা’ ভাষা বিষয়ে হাল আমলের বাইনারি ছাপিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনাপরিস্থিতির কথা বলে তমদ্দুন মজলিস। ইতিহাসে ব্যক্তি বা সংগঠনের ভূমিকা একমাত্রিক থাকে না। তমদ্দুন মজলিসও তার সময় ও পরিস্থিতির বহুমাত্রিক বাস্তবতার মধ্যে তার ক্রিয়াশীলতাকে জারি রেখেছিল; হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ইতিহাসের জরুরি অ
৩ দিন আগে১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি একজন সৈনিক।’ ১৯৭৬ সালের মে মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন শ্রমিক।’ ১৯৭৭ সালের ২২ মে ‘আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ জিয়া ঘোষণা করেন ১৯ দফা কর্মসূচি।
৪ দিন আগে