leadT1ad

তমদ্দুন মজলিসকে আমরা কীভাবে পাঠ করবো?

তমুদ্দন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর (বদরুদ্দীন উমরের মতে ২ সেপ্টেম্বর) ঢাকায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ব্যক্তি পর্যায়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পরে তমদ্দুন মজলিসই প্রথম সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করে। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ তমুদ্দন মজলিস প্রকাশ করে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা—না উর্দু?’ ৭৮ বছর পর ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের সেই পর্ব।

রাফাত আলম
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ৩৫
আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ৫৭
তমদ্দুন মজলিসকে আমরা কীভাবে পাঠ করবো। স্ট্রিম গ্রাফিক

পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস ছিল প্রথমত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। কিন্তু অপরাপর ‘সংস্কৃতি-চর্চামূলক’ সংগঠনের বৈশিষ্ট্য দিয়ে তমদ্দুন মজলিসকে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব না। ইতিহাসের গতিপথ নির্মাণে কখনো ব্যক্তি, আবার কখনো সংগঠন দিকনির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের পরম্পরায় তেমনি একটি সংগঠন তমদ্দুন মজলিস।

তমুদ্দন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর (বদরুদ্দীন উমরের মতে ২ সেপ্টেম্বর) ঢাকায়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেম (১৯২০-১৯৯২)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে রশীদ ভবনে ছিল এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ছিলো নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে ইসলামি আদর্শ ও আধুনিক জীবনচেতনার মিথস্ক্রিয়ায় নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন। এই ইসলামি আদর্শকে কেবল ধর্মতত্ত্ব বা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যথেষ্ট নয়; বরং এর তাৎপর্য বোঝার জন্য আমাদের তাকাতে হবে তৎকালীন বাংলাভাষী মুসলমান জনগোষ্ঠীর জীবনতৃষ্ণা ও আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও তমুদ্দিন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম। সংগৃহীত ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও তমুদ্দিন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেম। সংগৃহীত ছবি

চল্লিশের দশক জুড়ে বাংলা জনাঞ্চলের বৃহৎ অংশ অর্থাৎ মুসলমান জনগোষ্ঠী যুক্ত ছিলো যে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আত্মপরিচয় অর্জনে আন্দোলনে, সাতচল্লিশের পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিলো সেই বহুমাত্রিক ধারণার একটি দৃশ্যমান অবয়ব। ফলে কাঙ্ক্ষিত পাকিস্তানকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র-কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করাটাই ছিলো জনমানুষের জন্য স্বাভাবিক বিষয়। এই পাকিস্তানে তারা আশা করেছিল ‘কুসংস্কার, গতানুগতিকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা’-মুক্ত ‘সুস্থ ও সুন্দর সংস্কৃতি’। সেই লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয় তমদ্দুন মজলিস।

তমদ্দুন মজলিসের গঠনতন্ত্র থেকে জানা যায়, যুক্তিবাদ, ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদ, মানবীয় মূল্যবোধ ও গণজীবনে ‘নিখুঁত চরিত্র গঠনে’র ওপর ভিত্তি করে তারা গঠন করতে চায় পাকিস্তান রাষ্ট্র। এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায় তমদ্দুন মজলিসের পূর্বসূরি মুসলিম সাহিত্য সমাজ (১৯২৬), পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি (১৯৪০), পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য-সংসদ (১৯৪২) প্রভৃতি সংগঠনের কর্মতৎপরতাকে। তাই ধর্মীয় মূল্যবোধ মাত্রই রক্ষণশীলতা—এই ধরনের ধারণা দিয়ে ওই সময়কে ব্যাখ্যা করা যায় না।

ধর্মীয় আদর্শের চেয়েও ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবনায়ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সঙ্গী করেও যে ‘আধুনিক’ জীবনের দিকে তাকানো যায়, তমদ্দুন মজলিস তেমনি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। এর অব্যবহিত দৃষ্টান্ত—রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার পক্ষে তার সক্রিয় অবস্থান।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ব্যক্তি পর্যায়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পরে তমদ্দুন মজলিসই প্রথম সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করে। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ তমুদ্দন মজলিস প্রকাশ করে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা—না উর্দু?’ শীর্ষক পুস্তিকা। এখানে লিখেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ। এই পুস্তিকার প্রথম অংশ সংযোজিত ছিল তমদ্দুন মজলিসের পক্ষে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব, তার প্রথম দফাই ছিল—‘বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন; পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা; পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা’।

ওই বছরের অক্টোবর মাসে আবুল কাসেমের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বিবেচনার উদ্দেশ্যে সাহিত্যসভার আয়োজন করা হয়, যেখানে বক্তৃতা করেছিলেন মন্ত্রী হবিবুল্লাহ্ বাহার, কবি জসীমউদ্দীন, সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল (প্রাদেশিক মন্ত্রী), কাজী মোহাতার হোসেন। কিন্তু এই বাংলা কোন বাংলা ভাষা?

ভাষা সংগ্রামীর বাংলাদেশ নামক বই থেকে নেওয়া ছবি
ভাষা সংগ্রামীর বাংলাদেশ নামক বই থেকে নেওয়া ছবি

চল্লিশের দশকে ভাষা ও সাহিত্যের বিনির্মাণ-প্রশ্নে যে মুসলিম ও বাংলাভাষী সংস্কৃতির স্বতন্ত্র স্বর নির্মাণের চেষ্টা দেখা গেছে, সাতচল্লিশ-পরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার আওতায় ‘পাকিস্তানি’ আদর্শের পরিসরেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করেছিলেন তমদ্দুন মজলিসের ‘অ্যাক্টিভিস্ট’রা। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে তাঁরা আবেগের জায়গা থেকে দেখেননি; দেখেছেন প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী যে কার্যকর ধর্মঘট পালিত হয়েছিল, সেখোনেও তমদ্দুন মজলিসের ছিল সক্রিয় অবস্থান।

তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, এএসএম নূরুল হক ভূঁইয়া, আবদুল গফুর, একেএম আহসান, শাহেদ আলী, হাসান ইকবাল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমরসহ অনেকে। মূলত পরবর্তীকালে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ডিসকোর্সে ‘প্রগতিশীল’ ধারার প্রায় সবাই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে ওই কালপর্বে একই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তখন ইসলাম ও বাংলা বা মুসলমানিত্ব ও বাঙালিত্ব কোনো দ্বিমূলক (binary) অবস্থানে বিবেচিত হয়নি—বরং দুইয়ের স্বাভাবিক ও সহজাত সমন্বয় ঘটেছিলো। ‘তমুদ্দন’ নাম গ্রহণের মধ্যেও এর ইঙ্গিত আছে। ‘সংস্কৃতি’ বা ‘সভ্যতা’ না বলে ‘তমদ্দুন’ বলার মধ্যে বাংলা ভাষায় মুসলমানি অনুষঙ্গ গ্রহণের স্বীকৃতি আছে। ১৯৫২ সালের ১৭-২০ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ‘ইসলামী সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ আয়োজন ছিল তমদ্দুন মজলিসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

তমদ্দুন মজলিস প্রকাশনার দিক থেকেও ছিল সক্রিয়। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত সংগঠনটির মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এর সদস্যদের রচিত ও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচশোর বেশি। তবে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে একসময়ের প্রবল সক্রিয় তমদ্দুন মজলিসের তৎপরতার মাত্রা কমতে থাকে; ১৯৫৭ এরপর প্রায় নির্জীব হয়ে যায়।

অনেক গবেষক মনে করেন, ১৯৫৪ সালে তমদ্দুন মজলিসের অনেক সদস্যের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়লাভ তাদেরকে ক্ষমতার রাজনীতির দিকে ধাবিত করে। ফলে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে এর সংগ্রামশীল চারিত্র্য ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে। তবে তমদ্দুন মজলিসের গুরুত্ব এইখানে যে, একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রাপ্তি ও গঠনের সূচনালগ্নে একটি সংগঠন কীভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়, তার পাঠ গ্রহণ। এই পাঠ আমাদের ওই কালের বাস্তবতার কার্যকারণ সম্পর্কে জানিয়ে দেয়।

‘মুসলমান’ ও ‘বাংলা’ ভাষা বিষয়ে হাল আমলের বাইনারি ছাপিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনাপরিস্থিতির কথা বলে তমদ্দুন মজলিস। ইতিহাসে ব্যক্তি বা সংগঠনের ভূমিকা একমাত্রিক থাকে না। তমদ্দুন মজলিসও তার সময় ও পরিস্থিতির বহুমাত্রিক বাস্তবতার মধ্যে তার ক্রিয়াশীলতাকে জারি রেখেছিল; হয়ে ওঠে বাংলাদেশের ইতিহাসের জরুরি অনুষঙ্গে। এই ক্রিয়াশীলতা ও প্রায়োগিকতাই তমদ্দুন মজলিসের শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের জায়গা; এখানেই বর্তমানে দাঁড়িয়ে তমদ্দুন মজলিস পাঠের গুরুত্ব।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক

Ad 300x250

‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা হয় গণভবনে: রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুন

রিটকারীকে গণধর্ষণের হুমকি: শিবিরের দিকে আঙুল তুলছে সবাই

নির্বাচন বানচালের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সতর্ক হতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা

হিউম্যান রাইটস ডিউ ডিলিজেন্স বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিল বিলস

তাহারির স্কয়ারের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অনেক মিল আছে

সম্পর্কিত