পীযুষ অধিকারী
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নেপালে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জেনজি বিপ্লব ঘটে। সারা দেশে প্রশ্ন উঠেছিল—‘তাদের নেতা কে?’ কিন্তু আসল প্রশ্ন ছিল ভিন্ন। অতীতে কোনো বিপ্লব শত্রুর কারণে ধ্বংস হয়নি। ধ্বংস হয়েছে সেইসব নেতাদের কারণে যারা বিপ্লবের নামে ক্ষমতা দখল করেছিল। এবার কোনো নেতা না থাকাটাই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি।
বিক্ষোভ শেষে একটি নাম সামনে আসে—সুদান গুরুং। তিনি তরুণ সংগঠন ‘হামি নেপাল’-এর প্রধান। তবে তিনি আন্দোলনের নেতা ছিলেন না। তিনি কেবল পরবর্তীতে মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। এটাই প্রমাণ করে এই বিপ্লব ছিল ভিন্ন। ক্ষমতা কিছু লোকের হাতে নয়, বরং সবার সম্মিলিত শক্তিতে গড়ে উঠেছিল।
তবে এই পরিবর্তনের জন্য দিতে হয়েছে বিশাল মানবিক ও অর্থনৈতিক মূল্য। ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। ২ হাজার ১১৩ জন আহত হয়েছেন। সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট ও সিংহ দরবার আগুনে পুড়ে যায়। রাজধানীর বাইরে কমপক্ষে ৩০০টি স্থানীয় সরকারি কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণমাধ্যমও রক্ষা পায়নি। নেপালের সবচেয়ে বড় বেসরকারি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ‘কান্তিপুর মিডিয়া হাউস’ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি নেপালি রুপি (প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এর মধ্যে শুধু সরকারি অবকাঠামোর ক্ষতি এক লাখ কোটির কাছাকাছি যা নেপালের বার্ষিক জিডিপির প্রায় অর্ধেক।
১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত ভেঙে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। সংসদ ধ্বংস হয়। একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
এই শূন্যতার ভেতরেই আন্দোলনের বিকেন্দ্রীকৃত চরিত্র স্পষ্ট হয়। সংগঠকেরা ‘ইউথস এগেইনস্ট করাপশন’ নামের ডিসকর্ড চ্যানেলকে ভার্চুয়াল জনসমাবেশে রূপ দেন। সেখানে হাজারো মানুষ দিকনির্দেশনা নিয়ে বিতর্ক করে। অবশেষে ৭ হাজার ৫০০ জন ভোট দেন। তারা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেন।
তবে শুধু এই কয়েকটি ঘটনার ভিত্তিতে এই বিপ্লবকে বিচার করা ইতিহাসের প্রতি অন্যায় হবে। এই আন্দোলন পরিকল্পিত ছিল না। এটি ছিল প্রতিক্রিয়া। আমরা তখন শুধুই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করছিলাম। প্রথম দিনেই ১৯ জন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে কেউ কেউ তখনো ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। এই হত্যাকাণ্ড শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে জাতীয় বিক্ষোভে রূপ দেয়। যে রাষ্ট্র নিজের সন্তানদের হত্যা করে, তার প্রতীকগুলো অনিবার্যভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
এখন বিশৃঙ্খলা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নেপালিদের নতুন আশা দিয়েছে। তবে এই আশার সঙ্গে একটি চ্যালেঞ্জও এসেছে— আমরা কি পুরনো অভ্যাসের মতো ক্ষমতা আবার নেতাদের হাতে তুলে দেব, নাকি এবার তাদের নতুন মানদণ্ডে বিচার করব? টানা ৪৮ ঘণ্টা নেপালের জনগণ বিশ্বাস করেছিল যে ক্ষমতা তাদের হাতেই। আর তা কেবল বিশ্বাস ছিল না; বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে জনগণ যে সত্য আবিষ্কার করেছিল, সেটিই ছিল বাস্তবতা।
সামনে এগিয়ে যেতে হলে নেপালিদের, বিশেষত জেন-জি প্রজন্মকে, এই বিপ্লবের পাঠ কখনো ভুলে যাওয়া চলবে না। ইতিহাস ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনাগুলো ভুলবে না। কিন্তু আমাদের জানতে হবে, কেন এবং কীভাবে তা ঘটেছিল।
এটি বোঝার জন্য নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন ঘটনার ধারা হিসেবে নয়, বরং পুনরাবৃত্ত চক্র হিসেবে দেখতে হবে। ২০২৫ সালের গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ হয়নি। এটি ছিল বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার দীর্ঘচক্রের সর্বশেষ বিস্ফোরণ। এখানে মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ কাজে আসতে পারে। এটাকে আদর্শ হিসেবে নয়, বরং একটি কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
মার্ক্সবাদের ‘ভিত্তিকাঠামো’ ও ‘উপরিকাঠামো’ ধারণা দুটি ধার করে আমরা রাজনীতিতে প্রয়োগ করতে পারি। নেপালের ‘রাজনৈতিক ভিত্তি’ হলো ক্ষমতার দৃঢ় কাঠামো—পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও শাসনের নেটওয়ার্ক যা স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। আর ‘রাজনৈতিক উপরিকাঠামো’ হলো সেই শক্তি যা এর বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায়। কখনো তা সংগঠিত দল, কখনো বা জেন-জির মতো অসংগঠিত জনগণ। এই কাঠামো একটি ট্র্যাজিক সত্য প্রকাশ করে—নেপালে প্রতিটি নতুন উপরিকাঠামো সাফল্যের পর শেষ পর্যন্ত নতুন ভিত্তিকাঠামোতে পরিণত হয়।
১৯৫১ সালের প্রথম বিপ্লবকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। তখনকার উপরিকাঠামো ক্ষেপে উঠেছিল পুরনো রানা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বিপ্লবের নায়ক হয়ে ওঠেন বি. পি. কৈরালা, রাজা ত্রিভুবন ও পাঁচ শহীদ। তবে ভূমিকা ছিল নির্বাসিত রাজনৈতিক দল, উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং পুনর্বাসিত রাজতন্ত্রেরও। তখন জনগণের মধ্যে প্রবল আশা তৈরি হয়। বিশেষ করে কৈরালা সেই আশার মুখপাত্রে পরিণত হন এবং পরবর্তীতে নেপালের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন।
কিন্তু সেই আশাগুলো পূর্ণ হয়নি। মাত্র এক দশক পর রাজা মহেন্দ্র সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করেন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করেন। এতে সার্বভৌমত্ব রাজতন্ত্রের হাতে চলে যায়। যদিও কেউ কেউ এই যুগকে ‘সোনালি সময়’ বলে থাকেন, তবুও এর অসন্তোষ ১৯৮০ সালের আন্দোলনের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে রূপ নেয়—যা আধুনিক নেপালের দ্বিতীয় বৃহৎ বিপ্লব হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।
সেই বিপ্লবও পরিচিত ধারাই অনুসরণ করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। রাজনৈতিক ভিত্তি আবার পরিবর্তিত হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, যারা একসময় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিল, তারা পৃষ্ঠপোষকতা ও সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো ভাঙতে ব্যর্থ হয়। বরং তারাই নতুন রাজনৈতিক ভিত্তিতে পরিণত হয়। তারা একটি লুণ্ঠনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। বহু বছর ধরে প্রস্তুত হওয়া মাওবাদী বিদ্রোহ তার প্রথম হামলার মধ্য দিয়ে আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করে।
মাওবাদী আন্দোলন যা দ্বিতীয় গণআন্দোলনে গিয়ে মিলে। কিন্তু আদর্শিক আবরণের পরও তারা নেপালের সেই ট্র্যাজিক চক্রেরই পুনরাবৃত্তি করে। মাওবাদী নেতৃত্ব নতুন রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপন না করে পুরোনো ভিত্তিতে যোগ দেয়। যেসব কমান্ডার একসময় দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার নিন্দা করত, তারাই মন্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। তারা উত্তরাধিকারসূত্রে পুরনো পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ক দখল করে নেয়, একই লুণ্ঠনকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে এবং বিপ্লবের মূল অর্থনৈতিক বৈপরীত্য উপেক্ষা করে। স্লোগান বদলেছে, কিন্তু কাঠামো একই থেকেছে।
পরে বোঝা যায়, সব বিপ্লবের মূল ব্যর্থতা ছিল নেতৃত্বে। রাজনৈতিক পরিসরের সব প্রান্তে নেতারা সুযোগসন্ধানীতে পরিণত হয়। তারা এমন এক লুণ্ঠনকেন্দ্রিক শাসন চালায়, যা বাইরে থেকে গণতন্ত্র আর ভেতরে ‘জনআন্দোলন’ নামে আড়াল করা হয়। জনগণের জন্য প্রত্যাশিত ফল কখনো বাস্তব হয়নি। এই আলোকে, নেতৃত্বহীনতার কারণে সাম্প্রতিক জেন-জি বিপ্লব দুর্বল হয়নি। বরং নেতৃত্বহীনতাই ছিল এর সবচেয়ে বড় কৌশলগত শক্তি।
এই ইতিহাস আমাদের দেখায় যে ২০২৫ সালের জেন-জি বিপ্লব হঠাৎ হয়নি। এটি ছিল বহু দশকের চাপের বিস্ফোরণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ ছিল। প্রতিটি ‘ব্যর্থ’ বিপ্লব রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর চাপ বাড়িয়েছে, যা নেপালের অর্থনৈতিক বৈপরীত্যে অন্ধ ছিল। জনগণও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহের প্রয়োজনীয়তা মনের ভেতর সঞ্চয় করে রেখেছিল।
এখন নেপালের তরুণ বিপ্লবীদের সামনে দায়িত্ব স্পষ্ট। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার চক্র ভেঙে ফেলা—স্বচ্ছভাবে ও অবিরামভাবে। লক্ষ্য আর কেবল কে ক্ষমতায় থাকবে তা বদলানো নয়; বরং ক্ষমতার অর্থকেই পরিবর্তন করা। আশা, উদ্যোগ ও সমালোচনাশক্তি কোনো স্বঘোষিত ত্রাণকর্তার হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। সেপ্টেম্বর বিপ্লবের পাঠ হলো—আমাদের একমাত্র ভরসা আমরা নিজেরাই। সবসময় আমরাই। রাজা নয়, প্রধানমন্ত্রী নয়, প্রেসিডেন্ট নয়, মেয়রও নয়। আর কোনো নেতাকে জনগণের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে দেওয়া যাবে না। নেপালের নাগরিক জীবনের মৌলিক অংশ হতে হবে জবাবদিহিতা। তবেই গড়ে উঠবে সতর্ক, সংগঠিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ।
সেপ্টেম্বরের ৮ ও ৯ তারিখের দিনগুলো কখনো ভুলে যাওয়া যাবে না। সেই দিনগুলো যেন আর কখনো পুনরাবৃত্ত না হয়। ক্ষমতা যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছিল, সেখানেই থাকতে হবে—জনগণের হাতে।
লেখক: নেপালের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নেপালে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জেনজি বিপ্লব ঘটে। সারা দেশে প্রশ্ন উঠেছিল—‘তাদের নেতা কে?’ কিন্তু আসল প্রশ্ন ছিল ভিন্ন। অতীতে কোনো বিপ্লব শত্রুর কারণে ধ্বংস হয়নি। ধ্বংস হয়েছে সেইসব নেতাদের কারণে যারা বিপ্লবের নামে ক্ষমতা দখল করেছিল। এবার কোনো নেতা না থাকাটাই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি।
বিক্ষোভ শেষে একটি নাম সামনে আসে—সুদান গুরুং। তিনি তরুণ সংগঠন ‘হামি নেপাল’-এর প্রধান। তবে তিনি আন্দোলনের নেতা ছিলেন না। তিনি কেবল পরবর্তীতে মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। এটাই প্রমাণ করে এই বিপ্লব ছিল ভিন্ন। ক্ষমতা কিছু লোকের হাতে নয়, বরং সবার সম্মিলিত শক্তিতে গড়ে উঠেছিল।
তবে এই পরিবর্তনের জন্য দিতে হয়েছে বিশাল মানবিক ও অর্থনৈতিক মূল্য। ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। ২ হাজার ১১৩ জন আহত হয়েছেন। সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট ও সিংহ দরবার আগুনে পুড়ে যায়। রাজধানীর বাইরে কমপক্ষে ৩০০টি স্থানীয় সরকারি কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণমাধ্যমও রক্ষা পায়নি। নেপালের সবচেয়ে বড় বেসরকারি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ‘কান্তিপুর মিডিয়া হাউস’ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ কোটি নেপালি রুপি (প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এর মধ্যে শুধু সরকারি অবকাঠামোর ক্ষতি এক লাখ কোটির কাছাকাছি যা নেপালের বার্ষিক জিডিপির প্রায় অর্ধেক।
১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত ভেঙে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। সংসদ ধ্বংস হয়। একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
এই শূন্যতার ভেতরেই আন্দোলনের বিকেন্দ্রীকৃত চরিত্র স্পষ্ট হয়। সংগঠকেরা ‘ইউথস এগেইনস্ট করাপশন’ নামের ডিসকর্ড চ্যানেলকে ভার্চুয়াল জনসমাবেশে রূপ দেন। সেখানে হাজারো মানুষ দিকনির্দেশনা নিয়ে বিতর্ক করে। অবশেষে ৭ হাজার ৫০০ জন ভোট দেন। তারা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেন।
তবে শুধু এই কয়েকটি ঘটনার ভিত্তিতে এই বিপ্লবকে বিচার করা ইতিহাসের প্রতি অন্যায় হবে। এই আন্দোলন পরিকল্পিত ছিল না। এটি ছিল প্রতিক্রিয়া। আমরা তখন শুধুই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করছিলাম। প্রথম দিনেই ১৯ জন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে কেউ কেউ তখনো ইউনিফর্ম পরিহিত ছিল। এই হত্যাকাণ্ড শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে জাতীয় বিক্ষোভে রূপ দেয়। যে রাষ্ট্র নিজের সন্তানদের হত্যা করে, তার প্রতীকগুলো অনিবার্যভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
এখন বিশৃঙ্খলা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নেপালিদের নতুন আশা দিয়েছে। তবে এই আশার সঙ্গে একটি চ্যালেঞ্জও এসেছে— আমরা কি পুরনো অভ্যাসের মতো ক্ষমতা আবার নেতাদের হাতে তুলে দেব, নাকি এবার তাদের নতুন মানদণ্ডে বিচার করব? টানা ৪৮ ঘণ্টা নেপালের জনগণ বিশ্বাস করেছিল যে ক্ষমতা তাদের হাতেই। আর তা কেবল বিশ্বাস ছিল না; বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে জনগণ যে সত্য আবিষ্কার করেছিল, সেটিই ছিল বাস্তবতা।
সামনে এগিয়ে যেতে হলে নেপালিদের, বিশেষত জেন-জি প্রজন্মকে, এই বিপ্লবের পাঠ কখনো ভুলে যাওয়া চলবে না। ইতিহাস ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনাগুলো ভুলবে না। কিন্তু আমাদের জানতে হবে, কেন এবং কীভাবে তা ঘটেছিল।
এটি বোঝার জন্য নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন ঘটনার ধারা হিসেবে নয়, বরং পুনরাবৃত্ত চক্র হিসেবে দেখতে হবে। ২০২৫ সালের গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ হয়নি। এটি ছিল বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার দীর্ঘচক্রের সর্বশেষ বিস্ফোরণ। এখানে মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ কাজে আসতে পারে। এটাকে আদর্শ হিসেবে নয়, বরং একটি কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
মার্ক্সবাদের ‘ভিত্তিকাঠামো’ ও ‘উপরিকাঠামো’ ধারণা দুটি ধার করে আমরা রাজনীতিতে প্রয়োগ করতে পারি। নেপালের ‘রাজনৈতিক ভিত্তি’ হলো ক্ষমতার দৃঢ় কাঠামো—পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও শাসনের নেটওয়ার্ক যা স্থিতাবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। আর ‘রাজনৈতিক উপরিকাঠামো’ হলো সেই শক্তি যা এর বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায়। কখনো তা সংগঠিত দল, কখনো বা জেন-জির মতো অসংগঠিত জনগণ। এই কাঠামো একটি ট্র্যাজিক সত্য প্রকাশ করে—নেপালে প্রতিটি নতুন উপরিকাঠামো সাফল্যের পর শেষ পর্যন্ত নতুন ভিত্তিকাঠামোতে পরিণত হয়।
১৯৫১ সালের প্রথম বিপ্লবকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। তখনকার উপরিকাঠামো ক্ষেপে উঠেছিল পুরনো রানা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বিপ্লবের নায়ক হয়ে ওঠেন বি. পি. কৈরালা, রাজা ত্রিভুবন ও পাঁচ শহীদ। তবে ভূমিকা ছিল নির্বাসিত রাজনৈতিক দল, উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং পুনর্বাসিত রাজতন্ত্রেরও। তখন জনগণের মধ্যে প্রবল আশা তৈরি হয়। বিশেষ করে কৈরালা সেই আশার মুখপাত্রে পরিণত হন এবং পরবর্তীতে নেপালের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন।
কিন্তু সেই আশাগুলো পূর্ণ হয়নি। মাত্র এক দশক পর রাজা মহেন্দ্র সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করেন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করেন। এতে সার্বভৌমত্ব রাজতন্ত্রের হাতে চলে যায়। যদিও কেউ কেউ এই যুগকে ‘সোনালি সময়’ বলে থাকেন, তবুও এর অসন্তোষ ১৯৮০ সালের আন্দোলনের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে রূপ নেয়—যা আধুনিক নেপালের দ্বিতীয় বৃহৎ বিপ্লব হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।
সেই বিপ্লবও পরিচিত ধারাই অনুসরণ করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। রাজনৈতিক ভিত্তি আবার পরিবর্তিত হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, যারা একসময় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিল, তারা পৃষ্ঠপোষকতা ও সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো ভাঙতে ব্যর্থ হয়। বরং তারাই নতুন রাজনৈতিক ভিত্তিতে পরিণত হয়। তারা একটি লুণ্ঠনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। বহু বছর ধরে প্রস্তুত হওয়া মাওবাদী বিদ্রোহ তার প্রথম হামলার মধ্য দিয়ে আরেকটি অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করে।
মাওবাদী আন্দোলন যা দ্বিতীয় গণআন্দোলনে গিয়ে মিলে। কিন্তু আদর্শিক আবরণের পরও তারা নেপালের সেই ট্র্যাজিক চক্রেরই পুনরাবৃত্তি করে। মাওবাদী নেতৃত্ব নতুন রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপন না করে পুরোনো ভিত্তিতে যোগ দেয়। যেসব কমান্ডার একসময় দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার নিন্দা করত, তারাই মন্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। তারা উত্তরাধিকারসূত্রে পুরনো পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ক দখল করে নেয়, একই লুণ্ঠনকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে এবং বিপ্লবের মূল অর্থনৈতিক বৈপরীত্য উপেক্ষা করে। স্লোগান বদলেছে, কিন্তু কাঠামো একই থেকেছে।
পরে বোঝা যায়, সব বিপ্লবের মূল ব্যর্থতা ছিল নেতৃত্বে। রাজনৈতিক পরিসরের সব প্রান্তে নেতারা সুযোগসন্ধানীতে পরিণত হয়। তারা এমন এক লুণ্ঠনকেন্দ্রিক শাসন চালায়, যা বাইরে থেকে গণতন্ত্র আর ভেতরে ‘জনআন্দোলন’ নামে আড়াল করা হয়। জনগণের জন্য প্রত্যাশিত ফল কখনো বাস্তব হয়নি। এই আলোকে, নেতৃত্বহীনতার কারণে সাম্প্রতিক জেন-জি বিপ্লব দুর্বল হয়নি। বরং নেতৃত্বহীনতাই ছিল এর সবচেয়ে বড় কৌশলগত শক্তি।
এই ইতিহাস আমাদের দেখায় যে ২০২৫ সালের জেন-জি বিপ্লব হঠাৎ হয়নি। এটি ছিল বহু দশকের চাপের বিস্ফোরণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ ছিল। প্রতিটি ‘ব্যর্থ’ বিপ্লব রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর চাপ বাড়িয়েছে, যা নেপালের অর্থনৈতিক বৈপরীত্যে অন্ধ ছিল। জনগণও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহের প্রয়োজনীয়তা মনের ভেতর সঞ্চয় করে রেখেছিল।
এখন নেপালের তরুণ বিপ্লবীদের সামনে দায়িত্ব স্পষ্ট। তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার চক্র ভেঙে ফেলা—স্বচ্ছভাবে ও অবিরামভাবে। লক্ষ্য আর কেবল কে ক্ষমতায় থাকবে তা বদলানো নয়; বরং ক্ষমতার অর্থকেই পরিবর্তন করা। আশা, উদ্যোগ ও সমালোচনাশক্তি কোনো স্বঘোষিত ত্রাণকর্তার হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। সেপ্টেম্বর বিপ্লবের পাঠ হলো—আমাদের একমাত্র ভরসা আমরা নিজেরাই। সবসময় আমরাই। রাজা নয়, প্রধানমন্ত্রী নয়, প্রেসিডেন্ট নয়, মেয়রও নয়। আর কোনো নেতাকে জনগণের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে দেওয়া যাবে না। নেপালের নাগরিক জীবনের মৌলিক অংশ হতে হবে জবাবদিহিতা। তবেই গড়ে উঠবে সতর্ক, সংগঠিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ।
সেপ্টেম্বরের ৮ ও ৯ তারিখের দিনগুলো কখনো ভুলে যাওয়া যাবে না। সেই দিনগুলো যেন আর কখনো পুনরাবৃত্ত না হয়। ক্ষমতা যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছিল, সেখানেই থাকতে হবে—জনগণের হাতে।
লেখক: নেপালের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এটি খুবই ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। জুলাই সনদ দেশের ভবিষ্যতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে বিচার প্রক্রিয়া এবং নতুন বাংলাদেশ গঠনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।
১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ ক্রিকেটের আকাশে আবারও নির্বাচন নামের এক ভোর ফুটছে। অথচ এই ভোরের আলোয় ঝলমল করছে না কোনো নতুন সূর্য; বরং ধোঁয়াটে এক কুয়াশা, যেখানে আলোও যেন পথ হারায়।
৩ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক। তবে এই তর্ক এখন আর শুধু একজন লেখককে ঘিরে নয়, এটি বরং হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানুষের মনোভঙ্গী বোঝারও আয়না। কিন্তু কেন?
১ দিন আগেউত্তর প্রজন্মের নারীদের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান প্রায় চল্লিশ বছর কিংবা তারও আগের একটি গার্হস্থ্য নিপীড়নের ঘটনা সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে দারুণ হইচই।
১ দিন আগে