leadT1ad

গাজায় যুদ্ধবিরতি কেন ‘ভুয়া’

জোনাথন কুক
জোনাথন কুক

গাজায় যুদ্ধবিরতি কেন ভুয়া। স্ট্রিম গ্রাফিক

যেকোনো যুদ্ধবিরতি সাধারণত তখনই টেকে যখন সংঘাতরত দুই পক্ষ সামরিকভাবে অচলাবস্থায় পৌঁছে যায়। অথবা যখন উভয় পক্ষের কাছে যুদ্ধ থামানো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি লাভজনক মনে হয়। কিন্তু গাজার বাস্তবতায় এর কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। গত দুই বছরের ভয়াবহতা যুদ্ধ নয়, বরং গণহত্যা। পশ্চিমা দেশ ও গণমাধ্যমগুলো একে ‘গাজা যুদ্ধ’ বলে প্রচার করলেও এটা ছিল নিধনযজ্ঞ। ফলে আজকের ‘যুদ্ধবিরতি’র কথাও আসলে সেই একই মিথ্যার ধারাবাহিকতা। এখনো ইসরায়েলের অব্যাহত সহিংসতা, বেসামরিক হত্যাযজ্ঞ ও সাহায্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি প্রমাণ করে গাজায় শান্তিচুক্তি বলতে কিছুর অস্তিত্বই নেই।

প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে তা বুঝতে হলে প্রথমে বোঝা দরকার, তথাকথিত ‘যুদ্ধ’ কথার আড়ালে কী গোপন করা হয়েছিল। গত দুই বছরে বিশ্ব দেখেছে, কীভাবে এক অবরুদ্ধ অঞ্চলের সাধারণ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক দৈত্য ইসরায়েল ও তার পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র মিলিতভাবে নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। গাজার প্রায় প্রতিটি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে অস্থায়ী তাঁবুতে। তারা শুধু বাস্তুচ্যুত নয়; তাদের নিঃশ্বাসে মিশেছে ধ্বংসস্তূপের ধুলো আর অসংখ্য বোমার বিষাক্ত ধাতু।

মাসের পর মাস ধরে গাজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও ত্রাণ সরবরাহে ‘পরিকল্পিত বাধা’ দিয়ে আসছে ইসরায়েল। গাজাবাসীকে না খাইয়ে রাখার এই নীতি আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ। এর দায়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মামলা করছে। অপুষ্টি এতটাই ভয়াবহ যে শিশুদের শরীরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে এমন জিনগত ক্ষতি ঘটেছে। হাসপাতালগুলো পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, ফলে আহত ও অপুষ্ট শিশুদের চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গাজাবাসীকে তথাকথিত ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ পাঠিয়ে পরে সেই অঞ্চলগুলোই বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির অনেক আগেই গাজা সিটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরায়েল।

জাতিসংঘ, বিশ্বের প্রধান মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি ইসরায়েলি সংগঠন বেতসেলেম এবং গণহত্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেছেন এটি কোনো যুদ্ধ নয়, বরং জাতিগত নিধন। তবুও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো গাজায় চলমান গণহত্যাকে বৈধ ও ন্যায্য যুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করতে ‘যুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে প্রমাণ করতে যুদ্ধবিরতির ভুয়া গল্পও তৈরি করা হয়েছে। বাস্তবে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। যুদ্ধবিরতির মাঝে যখন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহ বিনিময় হচ্ছিল, ইসরায়েল তখনও নতুন করে ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছিল। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসসহ অন্যান্য গণমাধ্যম রিপোর্ট করছে যে, ইসরায়েলি সৈন্যরা যুদ্ধবিরতির দিনেও ‘বেশ কয়েকজন’ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এর আগে, ইসরায়েলি সৈন্যরা গাজা শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাড়িঘর, খাদ্য সরবরাহ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়ার ভিডিও পোস্ট করেছিল।

এই ধারা নতুন নয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া আগের এক যুদ্ধবিরতির সময়ও ইসরায়েল ১৭০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল। ইসরায়েলের গুলি চালানো বন্ধ করার কোনো ইচ্ছাই কখনো ছিল না। গাজার এই ‘যুদ্ধবিরতি’ ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী দখলদার নীতিকে আটকাতে পারেনি। দখল অব্যাহত আছে, যেমন আছে ফিলিস্তিনিদের ওপর আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত ‘বর্ণবৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থা’।

গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ইসরায়েলকে গাজাসহ সব দখলকৃত এলাকা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েল তা উপেক্ষা করেছে। বরং তারা এখনো গাজার অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন রেখেছে এবং ড্রোন, যুদ্ধবিমান ও অবরোধের মাধ্যমে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।

একটি রাষ্ট্র যদি গণহত্যায় নিবেদিতপ্রাণ হয়, তবে তাকে থামানোর একমাত্র উপায় হলো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চাপ। কিন্তু ট্রাম্পের তথাকথিত মধ্যস্থতা আসলে ছলনা। এই যুদ্ধবিরতি কখনোই শান্তির জন্য নয়, বরং ইসরায়েলকে নতুনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ছুটি দেওয়ার জন্য সাজানো হয়েছিল।

আরও বিপজ্জনক হলো, ট্রাম্পের শর্তানুসারে ‘শান্তি’র জন্য হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে। কিন্তু হামাস অস্ত্র ছেড়ে দিলে শান্তি আসবে এমনটা ভাবা নিছক বোকামি। কারণ তখন গাজার মানুষ পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়বে। ইতিহাস বলছে, কোনো দখলদার শাসন কখনো স্বেচ্ছায় সহিংসতা থামায়নি। হামাসের লড়াইয়ের ফলে ইসরায়েলি সেনাদের কিছুটা হলেও মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। হামাস নিরস্ত্র হলে সেটিও হারিয়ে যাবে।

অন্যদিকে, খোদ ইসরায়েলের ভেতরে যে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে, তারও মূল কারণ মানবিক নয়; বরং ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি ও সৈন্যদের মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা। ফলে হামাস নিরস্ত্র হলে ইসরায়েলি সমাজে গণহত্যা চালানোর রাজনৈতিক বাধাও আরও কমে যাবে। ট্রাম্প এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছেন। তিনি একদিকে বলছেন, হামাস নিরস্ত্র না হলে ইসরায়েল আবার হামলা শুরু করবে, অন্যদিকে হুমকি দিচ্ছেন, ‘আমেরিকা নিজেই গিয়ে হামাসকে ধ্বংস করবে।’ ট্রাম্পের এই কথা স্পষ্ট করে, এই পুরো প্রক্রিয়া আসলে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে ফাঁদে ফেলার কৌশল।

যদি হামাস আত্মসমর্পণ করে তাতেও ইসরায়েল থামবে না। ইসরায়েল গাজায় কোনো ফিলিস্তিনি প্রশাসন চায় না—এমনকি মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ সরকারকেও নয়। একই সঙ্গে তারা ফিলিস্তিনের ঐক্যের প্রতীক মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছে। যদি সত্যিই ইসরায়েল শান্তি চাইত, তাহলে বারঘুতিকেই আলোচনায় আনত। বরং এখন খবর পাওয়া গেছে, বারঘুতিকে কারাগারে নির্যাতন করা হচ্ছে।

ট্রাম্পের ‘শান্তি পরিকল্পনা’ আসলে এক ঔপনিবেশিক প্রকল্প। ইরাক ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে ‘বোর্ড অব পিস’ নামে একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে চান ট্রাম্প। এই বোর্ড গাজায় নয়, মিশরে বসবে, আর মাঠে থাকবে তথাকথিত ‘স্থিতিশীলতা বাহিনী’। কিন্তু লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা যেমন ইসরায়েলি আগ্রাসন ঠেকাতে পারেনি, এখানেও তারা কিছুই করতে পারবে না। ইসরায়েল ড্রোন হামলা, খাদ্য ও ওষুধে নিষেধাজ্ঞা এবং সমুদ্র অবরোধের মাধ্যমে গাজাকে কার্যত দমবন্ধ অবস্থায় রাখবে।

এই ‘শান্তি' আসলে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসস্তূপে ইসরায়েলের নজরদার ড্রোনের নিচে, বঞ্চিত ও নিঃস্ব অবস্থায় বেঁচে থাকার অনুমতি মাত্র। ইউরো-মেডিটেরানিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের চেয়ারম্যান রামি আবদু এই সপ্তাহে দ্য ইন্টারসেপ্টকে বলেছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ ও মাসে ইসরায়েলের নির্বিচার গণহত্যা থেকে সরে গিয়ে এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত গণহত্যা’ বা ‘নিয়ন্ত্রিত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি’র দিকে অগ্রসর হবে।

গাজার পুনর্গঠন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে ইসরায়েল নিঃস্ব ফিলিস্তিনিদের প্রতি স্পষ্ট বার্তা পাঠাবে যে, তাদের মুক্তি বা রক্ষা গাজায় কখনোই সম্ভব নয়। পশ্চিম তীরের ভবিষ্যৎও শান্তির হবে না। বরং সেখানে ইসরায়েল আরও ভয়াবহ নির্যাতন বাড়াবে ও যেভাবে ফিলিস্তিনিদের ক্রমে ছোট ছোট শহর-সংরক্ষণে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে ‘ক্ষুদ্র গাজা’য় পরিণত করবে।

তবুও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ শেষ হবে না। ইতিহাসে কোনো জাতি স্থায়ী দাসত্ব মেনে নেয়নি। ফিলিস্তিনিরাও নেবে না। আবারও বলছি, গাজায় যুদ্ধ নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ হত্যাযজ্ঞ চলছে। তথাকথিত যুদ্ধবিরতি কেবল হত্যার বিরতিতে আরেকটি পর্বের সূচনা মাত্র।

(মিডিল ইস্ট আইয়ে প্রকাশিত মতামতের সংক্ষেপিত অনুবাদ)

লেখক: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশেষজ্ঞ এবং মার্থা গেলহর্ন স্পেশাল প্রাইজ ফর জার্নালিজম পুরস্কারপ্রাপ্ত।

Ad 300x250

সম্পর্কিত