ইনবক্সের বাইরে-১
মারুফ ইসলাম
কর্মব্যস্ত বিকেল। মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটছি।
রাজধানীর রাস্তাগুলোতে দিনের পর দিন একইভাবে ক্লান্তিকর যানজটে আটকে থাকার অভ্যাসটা বদলে দিয়েছে এই মেট্রো রেল। যান্ত্রিক কাঠামোয় চাপলে মনে হয় যেন একটা গতিদানবের পিঠে সওয়ার হয়েছি। এই গতি শুধু বাহ্যিক গতি নয়, যেন দেশটার এগিয়ে চলার একটা প্রতীকী গতিও অনুভব করি।
অফিস শেষে দ্রুত বাড়ি ফেরার তাগিদে মেট্রো স্টেশনের এসকেলেটরে উঠেছি। নিচে তাকিয়ে দেখি সারি সারি মানুষ উঠে আসছে। সবারই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া।
এসকেলেটরে আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। একজনের পরনে ছাই রঙের শার্ট, আরেকজনের পিঠে কালচে ব্যাগ, সম্ভবত কোনো বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা। এসকেলেটর ওপরে ওঠার সময় সাধারণত মানুষ নীরবে থাকে। কিন্তু সেদিন কেন যেন তাঁদের মধ্যে একটি মৃদু আলাপ শুরু হলো। প্রথমে তা ছিল ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে, তারপর সেটি মোড় নিলো দেশের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। আমিও কান খাড়া করে তাঁদের আলোচনা শুনতে শুরু করলাম।
কালো ব্যাগধারী ভদ্রলোক (ধরা যাক তাঁর নাম ‘রহিম সাহেব’) বললেন, ‘মেট্রো হয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। দ্রুত গতিতে বাসায় ফেরা যায়। কিন্তু জিনিসপত্রের দামের গতিতে তো লাগাম টানা গেল না, ভাই!’
পাশে দাঁড়ানো ছাই শার্টের ভদ্রলোক (করিম সাহেব) মোবাইল ফোন স্ক্রল করতে করতে বললেন, ‘আমাদের তো অনেক ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো হলো। এবার মনে হয় বাজারের দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার। বাজার করতে গেলেই হিট স্ট্রোক হওয়ার জোগাড় হয়। ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা দেব কী, তিনবেলা খাবার জোগাতেই জান হাসফাঁস হয়ে যাচ্ছে!’
একটা দীর্ঘশ্বাস উড়তে লাগল মেট্রোর হাওয়ায়। তাঁদের এই ছোট কথোপকথন যেন আজকের মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের এক নিখুঁত চিত্র। চোখে দেখা যায় এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো রেল, কিন্তু পেটের ক্ষুধা মেটানোর চ্যালেঞ্জটা থেকে যায়। অর্থনীতিবিদরা জিডিপির হিসাব দেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে অর্থনীতি হলো, চাল-ডাল-তেলের দাম আর সন্তানের টিউশন ফির অঙ্ক।
রহিম সাহেব বলছিলেন, ‘আমাদের বেতন বেড়েছে দুই পয়সা, কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে পাঁচ গুণ। মনে হচ্ছে যেন একটা চলমান এসকেলেটরে উল্টো দিকে হাঁটছি। দৌড়াচ্ছি, কিন্তু জায়গা মতো পৌঁছাতে পারছি না।’
ভদ্রলোকদের কথোপকথন শুনতে শুনতে আমার কাছে এসকেলেটরকে মনে হলো গ্রিক পুরাণের সিসিফাস। আর নিজেদের মনে হলো সিসিফাসের ‘পাথর’। মেট্রো আমাদের ঠেলে তুলে দেয় উন্নয়নের মহাসড়কে, আর একটু পরই আমরা আবার গড়িয়ে পড়ি বাজারের খাদে!
আলোচনার মোড় ঘুরল রাজনীতিতে। এসকেলেটরটা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আমরা সবাই প্ল্যাটফর্মে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। রহিম সাহেব চাপা গলায় প্রশ্ন তুললেন, ‘আচ্ছা, দেশ কি এভাবেই চলবে? সামনে তো ভোট আসছে, কী মনে হচ্ছে আপনার? আদৌ কি শান্তিপূর্ণ একটা নির্বাচন দেখব আমরা?’
করিম সাহেব একটু ইতস্তত করে চারপাশে তাকালেন, যেন দেয়ালেরও কান আছে। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘পরিবর্তন চায় সবাই। কিন্তু পরিবর্তন তো মুখের কথায় আসে না, ভাই। গণতন্ত্রের মূল কাঠামোটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। মানুষ ভোট দিতে যাবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। একটা ভয় কাজ করে, একটা অনিশ্চয়তা।’
তাদের কথায় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আগের সরকারের মতোই দমন-পীড়ন এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। মেট্রো রেলের দ্রুততা বা আধুনিকতা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মন্থরতা বা পুরোনো সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে পারছে না। মানুষের মনে প্রশ্ন, এত বড় একটি গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল, এর প্রভাব কি দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে পড়বে না?
একজন তরুণ আমাদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এবার আলোচনায় যোগ দিলেন। (পরে জেনেছি, তাঁর নাম ‘তন্ময়’)। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চোখে স্বপ্ন আর কণ্ঠে ক্ষোভ।
তন্ময় দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘দেখুন, আমাদের প্রজন্মের কাছে উন্নয়ন মানে কেবল অবকাঠামো নয়। উন্নয়ন মানে বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, চাকরির বাজারে মেধার মূল্য এবং একটি জবাবদিহিমূলক সরকার। আমরা একটা নির্দিষ্ট দলের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই না। আমরা চাই, দেশের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটা যেন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, যেখানে মানুষ নির্ভয়ে তার মতামত দিতে পারবে।’
আমরা ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে নেমে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। আলোচনার বিষয়বস্তু এবার জুলাই সনদ, একের পর এক আগুন লাগা এবং সমাজের অন্যান্য প্রসঙ্গে গড়াল। রহিম সাহেব বললেন, ‘জুলাই সনদ নামে একটা পর্বতের মুসিক প্রসব হলো, দেখলেন তো!’
করিম সাহেব একটু ইতস্তত করলেন, ‘এভাবে বলছেন কেন?’
ক্ষুব্ধ রহিম সাহেব চোখ-মুখ-ভুরু-কপাল সব কুঁচকে বললেন, ‘আট-নয় মাস ধরে দেন-দরবার করে কয়েক পাতার গালভরা বুলি তৈরি করেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, উচ্চকক্ষ… আরে ভাই, সরকার নিরপেক্ষ হবে কী উপায়ে, সে ব্যাপারে কিছু বলা আছে? এসব কিচ্ছু বলা নাই সনদে।’
কথা অবশ্য মিথ্যা নয়। এত দীর্ঘ সময় নিয়ে ঐকমত্য কমিশন যে সনদ তৈরি করল, তা আসলে পর্বতের মুসিক প্রসবের মতোই। যারা সবার আগে এই সনদের দাবি জানিয়েছিল, সেই এনসিপিই শেষ পর্যন্ত সনদে সই করেনি। এই সনদে সত্যিকার অর্থেই অনেক কিছুর ব্যাখ্যা নেই।
যেমন ব্যাখ্যা নেই গত পাঁচ দিনে তিনটি বড় বড় আগুন লাগার ঘটনারও। মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে এবং গতকাল শাহজালাল এয়ার পোর্টে। কীভাবে এসব আগুন লাগছে, কেউ লাগিয়ে দিচ্ছে কি না, এসব নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাতাসে উড়ছে।
প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতিতে ‘মৎস্যন্যায়’ বলে এক ধারণা আছে। এর অর্থ হচ্ছে বড় মাছ ছোট মাছকে গিয়ে ফেলে। এখানেও যেন তাই ঘটছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই মাত্র এক বছর আগে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে অভ্যুত্থান আনলো, তাদেরকে এখন গিয়ে ফেলেছে ক্ষমতার রাঘব-বোয়ালেরা। এখন কোথাও জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারী শিক্ষার্থীদের হিস্যা নেই, শ্রমিক-মজুর-রিকশা চালক.. তাদের জন্য কোথাও কোনো সংস্কার কমিশন নেই।
পরিবেশটা হঠাৎই গুমট হয়ে উঠল। তন্ময় নামের তরুণটি মোবাইলের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে আছেন। ট্রেন হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই সাঁ সাঁ করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়বে। করিম সাহেব গম্ভির গলায় বললেন, ‘এই যে আমরা সবাই ছুটছি... সবাই যেন রেসের ঘোড়া। এই আধুনিকতা আমাদের গতিশীল করেছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নও করেছে। দেখেন, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না, সবাই মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকে।’
কথাটা ভীষণভাবে নাড়া দিল। সত্যিই তো। মেট্রোর কল্যাণে মানুষ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পথের মাঝের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, যা একটা শহরের প্রাণ, তা যেন কমে যাচ্ছে।
আমার মনে পড়ল ফরাসি দার্শনিক পল ভিরিলিওর কথা। তিনি এই বর্তমান পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘দ্রুততার দাসত্ব’। তিনি বলেছেন, ‘আধুনিক সমাজ গতিকে উপাস্য বানিয়েছে। আমরা দ্রুত হতে গিয়ে নিজেদের পারস্পরিক সংযোগ ও মানবিকতা হারিয়ে ফেলছি। মেট্রো আমাদের শরীরকে দ্রুত গন্তব্যে নিয়ে যায়, কিন্তু আমাদের আত্মাকে করে তোলে আরও বিচ্ছিন্ন, আরও একা।’
রহিম সাহেব বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আগে বাসে বসে কত অচেনা মানুষের সঙ্গে দেশের হাল-হকিকত নিয়ে আলোচনা হতো। এখন সবাই শুধু ছুটছে, সবাই একা।’
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে দাঁড়াল। তন্ময় মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ উঠিয়ে বিদায় নেওয়ার আগে করিম সাহেব, রহিম সাহেব ও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে মেট্রো রেল... এটা দেশের উন্নয়নের একটা দিক। দ্রুততা, আধুনিকতা। কিন্তু দেশের রাজনীতি, দেশের অর্থনীতি, দেশের সমাজ—এই সবকিছু কি একই দিকে চলছে? নাকি আমরা উন্নয়নের একদিকে তাকিয়ে আছি, আর বাকি সব উল্টো দিকে নামছে?’
তাঁর প্রশ্নটি আমাকে ভাবালো। এই মেট্রো রেলের এসকেলেটরটি একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের গতি কি সর্বদা একই দিকে থাকে? এই কথোপকথন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যতই দ্রুত হোক না কেন, গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানুষের অর্থনৈতিক স্বস্তি নিশ্চিত না হলে, সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কখনোই দূর হয় না।
এই উদ্বেগ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের বাংলাদেশ। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেনের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
কর্মব্যস্ত বিকেল। মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটছি।
রাজধানীর রাস্তাগুলোতে দিনের পর দিন একইভাবে ক্লান্তিকর যানজটে আটকে থাকার অভ্যাসটা বদলে দিয়েছে এই মেট্রো রেল। যান্ত্রিক কাঠামোয় চাপলে মনে হয় যেন একটা গতিদানবের পিঠে সওয়ার হয়েছি। এই গতি শুধু বাহ্যিক গতি নয়, যেন দেশটার এগিয়ে চলার একটা প্রতীকী গতিও অনুভব করি।
অফিস শেষে দ্রুত বাড়ি ফেরার তাগিদে মেট্রো স্টেশনের এসকেলেটরে উঠেছি। নিচে তাকিয়ে দেখি সারি সারি মানুষ উঠে আসছে। সবারই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া।
এসকেলেটরে আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুই মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। একজনের পরনে ছাই রঙের শার্ট, আরেকজনের পিঠে কালচে ব্যাগ, সম্ভবত কোনো বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা। এসকেলেটর ওপরে ওঠার সময় সাধারণত মানুষ নীরবে থাকে। কিন্তু সেদিন কেন যেন তাঁদের মধ্যে একটি মৃদু আলাপ শুরু হলো। প্রথমে তা ছিল ট্রেনের সময়সূচি নিয়ে, তারপর সেটি মোড় নিলো দেশের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। আমিও কান খাড়া করে তাঁদের আলোচনা শুনতে শুরু করলাম।
কালো ব্যাগধারী ভদ্রলোক (ধরা যাক তাঁর নাম ‘রহিম সাহেব’) বললেন, ‘মেট্রো হয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। দ্রুত গতিতে বাসায় ফেরা যায়। কিন্তু জিনিসপত্রের দামের গতিতে তো লাগাম টানা গেল না, ভাই!’
পাশে দাঁড়ানো ছাই শার্টের ভদ্রলোক (করিম সাহেব) মোবাইল ফোন স্ক্রল করতে করতে বললেন, ‘আমাদের তো অনেক ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো হলো। এবার মনে হয় বাজারের দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার। বাজার করতে গেলেই হিট স্ট্রোক হওয়ার জোগাড় হয়। ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষা দেব কী, তিনবেলা খাবার জোগাতেই জান হাসফাঁস হয়ে যাচ্ছে!’
একটা দীর্ঘশ্বাস উড়তে লাগল মেট্রোর হাওয়ায়। তাঁদের এই ছোট কথোপকথন যেন আজকের মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের এক নিখুঁত চিত্র। চোখে দেখা যায় এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রো রেল, কিন্তু পেটের ক্ষুধা মেটানোর চ্যালেঞ্জটা থেকে যায়। অর্থনীতিবিদরা জিডিপির হিসাব দেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে অর্থনীতি হলো, চাল-ডাল-তেলের দাম আর সন্তানের টিউশন ফির অঙ্ক।
রহিম সাহেব বলছিলেন, ‘আমাদের বেতন বেড়েছে দুই পয়সা, কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে পাঁচ গুণ। মনে হচ্ছে যেন একটা চলমান এসকেলেটরে উল্টো দিকে হাঁটছি। দৌড়াচ্ছি, কিন্তু জায়গা মতো পৌঁছাতে পারছি না।’
ভদ্রলোকদের কথোপকথন শুনতে শুনতে আমার কাছে এসকেলেটরকে মনে হলো গ্রিক পুরাণের সিসিফাস। আর নিজেদের মনে হলো সিসিফাসের ‘পাথর’। মেট্রো আমাদের ঠেলে তুলে দেয় উন্নয়নের মহাসড়কে, আর একটু পরই আমরা আবার গড়িয়ে পড়ি বাজারের খাদে!
আলোচনার মোড় ঘুরল রাজনীতিতে। এসকেলেটরটা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আমরা সবাই প্ল্যাটফর্মে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। রহিম সাহেব চাপা গলায় প্রশ্ন তুললেন, ‘আচ্ছা, দেশ কি এভাবেই চলবে? সামনে তো ভোট আসছে, কী মনে হচ্ছে আপনার? আদৌ কি শান্তিপূর্ণ একটা নির্বাচন দেখব আমরা?’
করিম সাহেব একটু ইতস্তত করে চারপাশে তাকালেন, যেন দেয়ালেরও কান আছে। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘পরিবর্তন চায় সবাই। কিন্তু পরিবর্তন তো মুখের কথায় আসে না, ভাই। গণতন্ত্রের মূল কাঠামোটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। মানুষ ভোট দিতে যাবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। একটা ভয় কাজ করে, একটা অনিশ্চয়তা।’
তাদের কথায় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আগের সরকারের মতোই দমন-পীড়ন এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। মেট্রো রেলের দ্রুততা বা আধুনিকতা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মন্থরতা বা পুরোনো সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে পারছে না। মানুষের মনে প্রশ্ন, এত বড় একটি গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল, এর প্রভাব কি দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে পড়বে না?
একজন তরুণ আমাদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এবার আলোচনায় যোগ দিলেন। (পরে জেনেছি, তাঁর নাম ‘তন্ময়’)। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চোখে স্বপ্ন আর কণ্ঠে ক্ষোভ।
তন্ময় দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘দেখুন, আমাদের প্রজন্মের কাছে উন্নয়ন মানে কেবল অবকাঠামো নয়। উন্নয়ন মানে বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, চাকরির বাজারে মেধার মূল্য এবং একটি জবাবদিহিমূলক সরকার। আমরা একটা নির্দিষ্ট দলের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই না। আমরা চাই, দেশের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মটা যেন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, যেখানে মানুষ নির্ভয়ে তার মতামত দিতে পারবে।’
আমরা ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে নেমে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। আলোচনার বিষয়বস্তু এবার জুলাই সনদ, একের পর এক আগুন লাগা এবং সমাজের অন্যান্য প্রসঙ্গে গড়াল। রহিম সাহেব বললেন, ‘জুলাই সনদ নামে একটা পর্বতের মুসিক প্রসব হলো, দেখলেন তো!’
করিম সাহেব একটু ইতস্তত করলেন, ‘এভাবে বলছেন কেন?’
ক্ষুব্ধ রহিম সাহেব চোখ-মুখ-ভুরু-কপাল সব কুঁচকে বললেন, ‘আট-নয় মাস ধরে দেন-দরবার করে কয়েক পাতার গালভরা বুলি তৈরি করেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, উচ্চকক্ষ… আরে ভাই, সরকার নিরপেক্ষ হবে কী উপায়ে, সে ব্যাপারে কিছু বলা আছে? এসব কিচ্ছু বলা নাই সনদে।’
কথা অবশ্য মিথ্যা নয়। এত দীর্ঘ সময় নিয়ে ঐকমত্য কমিশন যে সনদ তৈরি করল, তা আসলে পর্বতের মুসিক প্রসবের মতোই। যারা সবার আগে এই সনদের দাবি জানিয়েছিল, সেই এনসিপিই শেষ পর্যন্ত সনদে সই করেনি। এই সনদে সত্যিকার অর্থেই অনেক কিছুর ব্যাখ্যা নেই।
যেমন ব্যাখ্যা নেই গত পাঁচ দিনে তিনটি বড় বড় আগুন লাগার ঘটনারও। মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে এবং গতকাল শাহজালাল এয়ার পোর্টে। কীভাবে এসব আগুন লাগছে, কেউ লাগিয়ে দিচ্ছে কি না, এসব নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাতাসে উড়ছে।
প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতিতে ‘মৎস্যন্যায়’ বলে এক ধারণা আছে। এর অর্থ হচ্ছে বড় মাছ ছোট মাছকে গিয়ে ফেলে। এখানেও যেন তাই ঘটছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই মাত্র এক বছর আগে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে অভ্যুত্থান আনলো, তাদেরকে এখন গিয়ে ফেলেছে ক্ষমতার রাঘব-বোয়ালেরা। এখন কোথাও জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারী শিক্ষার্থীদের হিস্যা নেই, শ্রমিক-মজুর-রিকশা চালক.. তাদের জন্য কোথাও কোনো সংস্কার কমিশন নেই।
পরিবেশটা হঠাৎই গুমট হয়ে উঠল। তন্ময় নামের তরুণটি মোবাইলের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে আছেন। ট্রেন হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই সাঁ সাঁ করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়বে। করিম সাহেব গম্ভির গলায় বললেন, ‘এই যে আমরা সবাই ছুটছি... সবাই যেন রেসের ঘোড়া। এই আধুনিকতা আমাদের গতিশীল করেছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নও করেছে। দেখেন, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না, সবাই মোবাইলে মুখ গুঁজে থাকে।’
কথাটা ভীষণভাবে নাড়া দিল। সত্যিই তো। মেট্রোর কল্যাণে মানুষ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পথের মাঝের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, যা একটা শহরের প্রাণ, তা যেন কমে যাচ্ছে।
আমার মনে পড়ল ফরাসি দার্শনিক পল ভিরিলিওর কথা। তিনি এই বর্তমান পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘দ্রুততার দাসত্ব’। তিনি বলেছেন, ‘আধুনিক সমাজ গতিকে উপাস্য বানিয়েছে। আমরা দ্রুত হতে গিয়ে নিজেদের পারস্পরিক সংযোগ ও মানবিকতা হারিয়ে ফেলছি। মেট্রো আমাদের শরীরকে দ্রুত গন্তব্যে নিয়ে যায়, কিন্তু আমাদের আত্মাকে করে তোলে আরও বিচ্ছিন্ন, আরও একা।’
রহিম সাহেব বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আগে বাসে বসে কত অচেনা মানুষের সঙ্গে দেশের হাল-হকিকত নিয়ে আলোচনা হতো। এখন সবাই শুধু ছুটছে, সবাই একা।’
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন এসে দাঁড়াল। তন্ময় মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ উঠিয়ে বিদায় নেওয়ার আগে করিম সাহেব, রহিম সাহেব ও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে মেট্রো রেল... এটা দেশের উন্নয়নের একটা দিক। দ্রুততা, আধুনিকতা। কিন্তু দেশের রাজনীতি, দেশের অর্থনীতি, দেশের সমাজ—এই সবকিছু কি একই দিকে চলছে? নাকি আমরা উন্নয়নের একদিকে তাকিয়ে আছি, আর বাকি সব উল্টো দিকে নামছে?’
তাঁর প্রশ্নটি আমাকে ভাবালো। এই মেট্রো রেলের এসকেলেটরটি একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের গতি কি সর্বদা একই দিকে থাকে? এই কথোপকথন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যতই দ্রুত হোক না কেন, গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানুষের অর্থনৈতিক স্বস্তি নিশ্চিত না হলে, সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কখনোই দূর হয় না।
এই উদ্বেগ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের বাংলাদেশ। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেনের।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আবার চীনের কাছেই ফেরত গিয়েছে তাদের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। সেই লক্ষ্যে এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে আবারও গণমাধ্যমে আলোচনা দেখা যাচ্ছে, সরকারও গণশুনানির আয়োজন করেছে।
১ দিন আগেএইচএসসি ২০২৫ ফলাফল আসলে একটি আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের ব্যর্থতাকেই স্পষ্ট দেখতে পাই। পরিবার, শিক্ষক, সমাজ — সবাই কোনো না কোনোভাবে এই বিপর্যয়ের অংশ। প্রযুক্তির ভিড়ে মনোযোগ হারানো, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভরসা হারানো এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা — সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা দিকহারা হয়ে পড়েছে।
২ দিন আগেআজ ১৭ অক্টোবর, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এটি জুলাই সনদ স্বাক্ষর দিন। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আজ একে একে এই সনদে স্বাক্ করছে। নিঃসন্দেহে এটি দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যেহেতু একটি সনদ প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাই এটিকে আমরা স্বাগত জানাই। জুলাই সনদ কেবল একটি দলীয় উদ্
২ দিন আগেআজ ১৭ অক্টোবর, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিন। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আজ একে একে এই সনদে সাক্ষর করছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই সনদে সাক্ষর করছে না। অনেকেই জানতে চাচ্ছেন, কেন আমরা অংশ নিইনি।
২ দিন আগে