leadT1ad

রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা কি দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পকে পেছনে রাখছে

সুমন সুবহান
সুমন সুবহান
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ২৩: ৫০
ছবি: সংগৃহীত

বাণিজ্য উপদেষ্টা বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে গিয়ে উপদেশ দিয়েছেন, ফার্নিচার, গাড়ি-টাড়ি বানানো বাদ দিয়ে ওখানে যেন ট্যাংক বানানো হয়। আমি বাণিজ্য উপদেষ্টার মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে দুটি প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমত, বাংলাদেশের রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় এখনও অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে কেন? কেননা, বাংলাদেশের রপ্তানি নীতিমালা প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে একটি প্রধান এবং সরাসরি বাধা হিসেবে কাজ করে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, বর্তমানে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও সংশ্লিষ্ট উপকরণ রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয়ত, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা (বিএফও) প্রায় ৪ কোটি ডলারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ রপ্তানি করেছিল। এরপর এই রপ্তানি কার্যক্রম বিকশিত না হয়ে বন্ধ হয়ে গেল কেন? এর পরপরই বাংলাদেশ ‘অস্ত্র ছাড়া সবকিছু’ (এভ্রিথিং বাট আর্মস - ইবিএ) নীতি অনুসরণ করবে, এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কেন? কেন পরে তা আর পর্যালোচনা করা হয়নি? বর্তমান সরকার এই বিষয়ে কি উদ্যোগ নিয়েছে?

সরকারের দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে চমকপ্রদ মন্তব্য না করে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া বেশি জরুরি। মনে রাখা দরকার, সেনাবাহিনীর সার্বিক কর্মকাণ্ড দেশের নীতিমালা ও সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে বাংলাদেশ অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি (বিওএফ), বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফ), ডিজেল প্ল্যান্ট এবং সেনা কল্যাণ সংস্থাকে একসঙ্গে নিয়ে কথা বলতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের একেকটা একেক ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের পাশাপাশি অন্যান্য সাধারণ পণ্য নিজেদের প্রয়োজনে উৎপাদন ও সীমিত পরিসরে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করে থাকে। তবে প্রথমেই বোঝা দরকার প্রতিরক্ষা শিল্প কী?

১. প্রতিরক্ষা শিল্প কী

প্রতিরক্ষা শিল্প বা অস্ত্র শিল্প একটি বৈশ্বিক শিল্প। এখানে বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রযুক্তি, সরঞ্জাম এবং অস্ত্রশস্ত্র তৈরি ও বিক্রি করা হয়। এই শিল্পের প্রধান গ্রাহক বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র বাহিনী। এছাড়া, বেসামরিক ব্যক্তি ও সংস্থার কাছেও কিছু পণ্য বিক্রি করা হতে পারে। প্রতিরক্ষা শিল্পে যা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে তা হলো:

—অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম: যেমন আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধযান (ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান), যুদ্ধজাহাজ, সামরিক বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি।

—প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত প্রযুক্তি ও সিস্টেম: যেমন—যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম, রাডার ও সোনার সিস্টেম, সাইবার নিরাপত্তা সমাধান ইত্যাদি।

—সরবরাহ ও পরিচালনা সহায়তা: সামরিক সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং অপারেশনাল বা লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করা। সরঞ্জামের মাঝে ইউনিফর্ম, বুট, হেলমেট, নেট ক্যামফ্লেজ, তাঁবু ইত্যাদি থেকে শুরু করে অন্যান্য আইটেম অন্তর্ভূক্ত।

২. বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্প: বর্তমান অবস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্প তুলনামূলকভাবে নতুন, আকারে ছোট ও মূলত আমদানিনির্ভর। তবে সম্প্রতি কিছুকিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা চলছে। এই আলোচনা মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য প্রযোজ্য প্রতিরক্ষা শিল্প নিয়ে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক বাহিনী তার প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির জন্য আমদানির ওপরই বেশি নির্ভরশীল ছিল। বিশেষত চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে এসব সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হতো। দেশের একমাত্র প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বিওএফ বা বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা ১৯৭১ সালের পূর্বে যাত্রা শুরু করলেও, মূলত স্মল আর্মস, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য হালকা সরঞ্জাম তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য শক্তিশালী দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্প ভিত্তি গড়ে তোলার পরিকল্পনা হয়েছে। উদ্দেশ্য, দেশের সামরিক চাহিদা মেটানো ও বৈদেশিক নির্ভরতা কমানো। সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও প্রশিক্ষণের জন্য চীনের সাথে ২০০২ সালে ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি’ সহ তুরস্কের মতো বন্ধু দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা জোরদার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান

ক. বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা: ৬ এপ্রিল ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানা দেশের একমাত্র সরকারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। প্রধানত স্মল আর্মস, পদাতিক বাহিনীর গোলাবারুদ, গ্রেনেড এবং কিছু সামরিক সরঞ্জাম তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে এই কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। এর অধীনে আবার একাধিক কারখানায় বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম তৈরি হয়। প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে—১. ক্ষুদ্রাস্ত্র কারখানা, স্মল আর্মস তৈরির জন্য, ২. স্মল আর্মের গোলাবারুদ কারখানা, ৩. উচ্চ ক্যালিবার গোলাবারুদ ও গ্রেনেড কারখানা, যেখানে ভারী আর্টিলারি শেল, মর্টার বোমা এবং বিভিন্ন ধরনের গ্রেনেড তৈরি হয় ও ৪. টুলস উৎপাদন কারখানা, যেখানে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় টুলস তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের সামরিক বহরে থাকা ট্যাংকগুলোর ওভারহোলিং, মেরামত ও আপগ্রেডের প্রধান কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিজস্ব রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট, বিশেষত ৯০২ সেন্ট্রাল ওয়ার্কশপ-এর মতো কারিগরি কেন্দ্রে করা হয়। যেমন—চীনা টাইপ-৫৯ ট্যাংকগুলোকে উন্নতমানের টাইপ-৫৯জি দুর্জয় ট্যাংকে রূপান্তর করা হয়েছে। তবে সরকার প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে সমরাস্ত্র কারখানায় ট্যাংক উৎপাদন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে এর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরির সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে কার্যক্রম চলছে।

খ. বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি: ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানা অলাভজনক হলে ২০০০ সালের দিকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে এর অধীনে মোট ১৯টি সক্রিয় কারখানা রয়েছে, যেখানে ৫৬০টিরও বেশি পণ্য উৎপাদন করে হয়ে থাকে। এর মেশিন শপে ভারী যানবাহনের লোড বডি, মোবাইল ওয়ার্কশপ, বিভিন্ন ধরনের গিয়ার, স্পেয়ার পার্টস এবং বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং টুলস তৈরি করা হয়। অটোমোবাইল শপে সামরিক বাহিনীর বিশেষায়িত যানবাহন, যেমন—ইসুজু ৩ টন ট্রাক, টয়োটা জিপ, অ্যাম্বুলেন্স এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষায়িত গাড়ি (যেমন- প্রিজনার ভ্যান) ইত্যাদি সংযোজন করা হয়ে থাকে। ইস্পাত কাঠামো কারখানায় স্টিল স্ট্রাকচার (যেমন—সেতুর অংশ, অবকাঠামো সরঞ্জাম) নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও এখানে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে সামরিক বুট, কাঠ, ধাতু ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, সিএফএল ও এলইডি বাল্ব, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরি করা হয়। এসবের কিছুকিছু সীমিত পরিসরে স্থানীয় বাজারেও এসে থাকে।

গ. সেনা কল্যাণ সংস্থা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৩ সালে গঠিত ‘পোস্ট ওয়ার সার্ভিসেস রিকনস্ট্রাকশন ফান্ড’ থেকে এটি ১৯৫৩ সালে ‘ফৌজি ফাউন্ডেশন’ নামে পুনর্গঠিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১ জুলাই ১৯৭২ সালে এটি ‘সেনা কল্যাণ সংস্থা’ নামে পুনর্গঠিত হয়। এটি সেনাবাহিনীর জন্য মূলত ক্লদিং আইটেম যেমন—ইউনিফর্ম, মোজা, তাঁবু ইত্যাদি পণ্য উৎপাদন করে।

ঘ. বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট লিমিটেড: ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের অধীনে আসে। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০০০ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৩০ মে ২০০৭ তারিখে লোকসানসহ এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি বর্তমানে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে কিছু নিরাপত্তা সরঞ্জাম, যেমন—কনসার্টিনা ওয়্যার, বার্বড ওয়্যার, ফাইবার হেলমেট ইত্যাদি তৈরি হয়। এছাড়াও এখানে গাড়ির ইঞ্জিনের বিভিন্ন স্পেয়ার পার্টস, এয়ার, অয়েল ও ফুয়েল ফিল্টার ইত্যাদি সহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়।

৩. দেশীয় প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন: বাধা ও সম্ভাবনা

দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নত সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য গবেষণা ও উন্নয়নখাতে বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই খাতে আমাদের সক্ষমতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এই কারণে বাংলাদেশ সরকার তুরস্কের মতো বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ প্রতিরক্ষা শিল্প স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং দেশীয় উৎপাদন উৎসাহিত হবে। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় বৃহৎ ও অত্যাধুনিক সামরিক হার্ডওয়্যার (যেমন—যুদ্ধবিমান, উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার সিস্টেম ইত্যাদি) এখনও বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প এককথায় এখনও শৈশবাবস্থায় রয়েছে। তবে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’-এর মাধ্যমে সরকার এই আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর এবং সামরিক সক্ষমতাকে আধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে প্রধান বাধা

বাংলাদেশের রপ্তানি নীতিমালা প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে প্রধান বাধা। কেননা এই নীতিমালা অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও সংশ্লিষ্ট উপকরণ রপ্তানি করা নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশের পথে এই নিষেধাজ্ঞা মূলত তিনভাবে বড় বাধা সৃষ্টি করে:

ক. বাজারের আকার সীমাবদ্ধতা: প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি বড় এবং টেকসই বাজার অপরিহার্য। রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকায় দেশীয় শিল্পের বাজার কেবল বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর চাহিদার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ সামরিক সরঞ্জাম খুব ব্যয়বহুল এবং এর অভ্যন্তরীণ চাহিদা সীমিত। শুধুমাত্র দেশীয় চাহিদার ওপর নির্ভর করে বড় ধরনের শিল্প স্থাপন বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয়ে ওঠে।

খ. বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির অভাব: সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির সুযোগ না থাকায় এই শিল্পে বেসরকারি বা বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা প্রায় অসম্ভব। রপ্তানির মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের সুযোগ না থাকায়, গবেষণা ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিশাল বাজেট বরাদ্দ করা সম্ভব হয় না। ফলে দেশীয় প্রযুক্তি উন্নত হয় না।

গ. সীমিত উৎপাদন: আন্তর্জাতিক বাজার না থাকায় সামরিক সরঞ্জামাদি ব্যাপক হারে উৎপাদন করা যায় না। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি হয় এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বেশি হওয়ায় তা বিদেশী পণ্যের সাথে পাল্লা দিতে পারে না।

অন্যান্য প্রধান বাধা

যদিও রপ্তানি নীতিমালা একটি প্রত্যক্ষ বাধা, তবে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা রয়েছে, যেমন:

১. প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাব: অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম (যেমন—মিসাইল সিস্টেম, উন্নত রাডার, যুদ্ধবিমান) তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ-প্রযুক্তি এবং কারিগরি জ্ঞান এখনও অপ্রতুল।

২. গবেষণা ও উন্নয়নে কম বিনিয়োগ: এই খাতে বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়, যার ফলে নতুন পণ্য উদ্ভাবন বা বিদ্যমান প্রযুক্তির মানোন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

৩. কাঁচামালের দেশীয় উৎসের অভাব: সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত কাঁচামাল ও উপাদান বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কেননা বাংলাদেশে আকরিক লোহা বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ধাতুর খনি নেই।

৪. আমদানিনির্ভরতা: সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হয়, যার ফলে দেশীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত সহায়তা পায় না।

এই বাধাগুলি দূর করে শিল্পটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার দিতে হলে রপ্তানি নীতিমালায় পরিবর্তন আনা এবং সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নীতিগত সমর্থন প্রদান করা জরুরি। কিন্তু তারপরও কিছু কথা থেকে যায়।

৪. প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশের নির্ধারক: প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও নীতি

একটা দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ কয়েকটি মূল বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সাথে সম্পর্কিত। প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে এসব নির্ধারকগুলো হলো:

ক. প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও উদ্ভাবন: প্রতিরক্ষা শিল্পকে উন্নত করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তি এবং গবেষণা অপরিহার্য। এটি নির্ভর করে: ১. গবেষণা ও উন্নয়ন বিনিয়োগ। প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, নতুন সামরিক সরঞ্জাম ডিজাইন এবং বিদ্যমান সরঞ্জামের মানোন্নয়নের জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করতে হয়।

২. দক্ষ মানবসম্পদ। সামরিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে উচ্চ প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও কারিগরি কর্মীর পর্যাপ্ততা। ৩. বেসামরিক শিল্পের সাথে সমন্বয়। তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, ইলেকট্রনিক্স, ও ভারী শিল্পের মতো বেসামরিক খাতের প্রযুক্তিকে সামরিক খাতে ব্যবহারের সক্ষমতা।

খ. অর্থনৈতিক ও আর্থিক ভিত্তি: এই শিল্প অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এর ভিত্তি অবশ্যই শক্তিশালী হতে হয়, যেমন:

১. সামরিক বাজেট: প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং শিল্প বিকাশের জন্য স্থায়ী ও পর্যাপ্ত বাজেট থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেটের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের শতকরা হার সাধারণত ৬% এর নিচে থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বা সংশোধিত বাজেটের ক্ষেত্রে এই হারটি ৫.০৭% - ৫.৩০%। এই হিসাব তিন বাহিনীকে মিলে। অথচ ভারতের প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ ১২% থেকে ১৪% এর মধ্যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ১২% থেকে ১৫% এর মধ্যে এবং মিয়ানমারের ক্ষেত্রে এই হার ১৫% ।

২. বাজারের আকার ও রপ্তানির সুযোগ: শিল্পকে লাভজনক রাখতে কেবল দেশীয় চাহিদা নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে অস্ত্র রপ্তানির সুযোগ থাকা জরুরি, যা উৎপাদনের স্কেল বাড়ায় এবং খরচ কমায়।

৩. বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ: প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা।

গ. কৌশলগত ও রাজনৈতিক সমর্থন: সরকারের দীর্ঘমেয়াদী নীতি ও দূরদর্শিতা এই শিল্পের বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এক্ষেত্রে তুরস্কের উদাহরণ সামনে আনা যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন:

১. দীর্ঘমেয়াদী নীতি: সামরিক বাহিনীর সরঞ্জাম আধুনিকীকরণের জন্য সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা (যেমন: বাংলাদেশের 'ফোর্সেস গোল ২০৩০') থাকা প্রয়োজন, যা দেশীয় শিল্পকে একটি স্থির লক্ষ্য প্রদান করে।

২. আমদানির ওপর বিধিনিষেধ: দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে এবং আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে নির্দিষ্ট কিছু কিছু সামরিক সরঞ্জাম আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

৩. প্রযুক্তি হস্তান্তর: বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে উৎপাদন শুরু করা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দেশে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।

৪. স্বচ্ছতা ও সুশাসন: সামরিক ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, যাতে দুর্নীতি কমে এবং দেশীয় শিল্পে আস্থা বাড়ে।

ঘ. অবকাঠামো ও শিল্প সক্ষমতা: সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় শিল্প কারখানা ও সরবরাহ চেইন থাকতে হয়। এজন্য প্রয়োজন:

১. উৎপাদন সুবিধা: যুদ্ধাস্ত্র, জাহাজ, বিমান ও অন্যান্য সরঞ্জামের জন্য বিশেষায়িত কারখানা (যেমন: বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা, শিপইয়ার্ড) থাকা।

২. সরবরাহ শৃঙ্খল: প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ধরনের কাঁচামাল এবং উপাদান সরবরাহকারী একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ শিল্প নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

৩. ভারী শিল্পের ভিত্তি: প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ভারী শিল্প (যেমন: ইস্পাত, উন্নত ধাতু, মেশিন টুলস) কতটা উন্নত, তার ওপরও প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ নির্ভরশীল।

৫. বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা

প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশের জন্য বিদ্যমান সবধরনের সমস্যা অতিক্রম করে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন ও রপ্তানির উদ্যোগ নিলেও বেশকিছু বহুমাত্রিক এবং জটিল বাধার সম্মুখীন হতে পারে। এই বাধাগুলো প্রধানত নীতিগত, প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান।

ক. নীতিগত ও আইনি বাধা

আগেই বলেছি প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশে সবচেয়ে বড় এবং সরাসরি বাধা হলো বাংলাদেশের বর্তমান রপ্তানি নীতিমালায় আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও সংশ্লিষ্ট উপকরণ রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকা। এই নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তন করা একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে অস্ত্র বিক্রি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ যদি রপ্তানি শুরু করতে চায়, তবে তাকে জাতিসংঘের অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে, যা স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত আরোপ করে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এখানে বড় ফ্যাক্টর হবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের দিকে তাকালে বিষয়টা ক্লিয়ার হবে। সামরিক সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের জন্য।

খ. প্রযুক্তিগত ও সক্ষমতার বাধা

বর্তমানে আমাদের দেশে নিজস্ব প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চমানের গবেষণা ও উন্নয়ন অবকাঠামো ও বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। আমাদের মিসাইল সিস্টেম, আধুনিক রাডার, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার বা উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধবিমানের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নেই। ফলে বেশিরভাগ জটিল যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তিগত উপাদান আমদানিনির্ভর থাকবে। এছাড়াও প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী, ডিজাইনার ও দক্ষ কারিগরি কর্মীর ঘাটতি একটি বড় বাধা। এই বিষয়টা পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের সময় গভীরভাবে অনুভূত হয়েছিল। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্বমানের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং সার্টিফিকেশন বজায় রাখা কঠিন হতে পারে।

গ. অর্থনৈতিক ও বাজার বাধা

শুধুমাত্র দেশীয় চাহিদা মেটাতে উৎপাদন করলে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে। অথচ লাভজনকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য যে বিশাল আকারের উৎপাদন প্রয়োজন, তা শুরুতে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। তাছাড়া সামরিক সরঞ্জাম একটি আস্থানির্ভর পণ্য। প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক সরবরাহকারীদের (রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র) থেকে নতুন একটি দেশের উপর আস্থা তৈরি করা এবং দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি পাওয়া কঠিন। এছাড়াও বৈশ্বিক অস্ত্র বাজারে প্রবেশ করা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রায়শই রাজনৈতিক লবিং-এর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের জন্য কার্যকর বিপণন কৌশল তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং হবে, আবার এই খাতে উচ্চ ঝুঁকি এবং কম প্রত্যাশিত লাভের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ সহজে আসবে না।

ঘ. ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাধা

বাংলাদেশ অস্ত্র রপ্তানি শুরু করলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর (যেমন— ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র) পক্ষ থেকে কূটনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক চাপের সম্মুখীন হতে হতে পারে। বিশেষ করে কোন দেশে অস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এই চাপ বাড়তে পারে। এছাড়াও তুরস্ক বা চীন বা অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি হস্তান্তরে সম্মত হলেও, সেই প্রযুক্তির ব্যবহার বা তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত আরোপ করতে পারে।

৬. কে নেবে উদ্যোগ

বাংলাদেশ তার ‘এভ্রিথিং বাট আর্মস’ নীতিমালা সংশোধন করে অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানি করলে দেশের শান্তিপ্রিয় বৈদেশিক নীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’-এর সাথে সাংঘর্ষিক হবে। যেটা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রধান ভূমিকা বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রশ্ন ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপরে অযথা দোষ বা দায়বদ্ধতা না চাপিয়ে সরকারকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে সেনাবাহিনীকে দিক নির্দেশনা দিতে হবে। সেনাবাহিনী সরকারের আইনি কাঠামোর মাঝেই পরিচালিত হয়, এটি কোনো স্বাধীন সত্তা না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত