স্ট্রিম ডেস্ক
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘নো কিং’ (কোনো রাজা মানি না) আন্দোলনের ব্যানারে দেশব্যাপী বিক্ষোভের এক জোয়ার দেখা গেছে। দেশটির ছোট-বড় শহরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বৈরাচারসদৃশ কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
২০২৫ সালের জুন ও অক্টোবর মাসের ঘটনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক জনসমাগম দেখা গেছে। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, আটলান্টা ও শিকাগোর মতো বড় শহরগুলোর পাশাপাশি ৫০টি রাজ্যের ছোট ছোট এলাকাতেও বড় আকারের মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) ও ইনডিভিজিবল-সহ ২০০টিরও বেশি প্রগতিশীল সংস্থা, ইউনিয়ন এবং নাগরিক অধিকার গোষ্ঠীর জোট এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বেশিরভাগ বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ হলেও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষও হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম এই গণজমায়েতকে অংশগ্রহণকারীরা দেখছেন গণতন্ত্র রক্ষার দেশাত্মবোধক সংগ্রাম হিসেবে। অন্যদিকে, প্রশাসন ও ট্রাম্প সমর্থকরা একে 'আমেরিকাবিরোধী' কার্যকলাপ বলে চিহ্নিত করেছে।
প্রশ্ন জাগছে, এই ব্যাপক জনরোষের পেছনের কারণগুলো কী, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আমেরিকার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতে এর তাৎপর্যই বা কেমন?
‘নো কিং’ বিক্ষোভ কী?
‘নো কিং’ বিক্ষোভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতি রক্ষার আন্দোলন। বিক্ষোভের মূল বার্তা হলো—যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একচ্ছত্র শাসনকে প্রত্যাখ্যান করার নীতির ওপর, তাই দেশটির কোনো প্রেসিডেন্টের রাজার মতো আচরণ করা উচিত নয়। বিক্ষোভকারী ও আয়োজকরা বলছেন, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন আদালতের আদেশ অমান্য করা, নাগরিক অধিকারের ওপর আক্রমণ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করছে।
এই আন্দোলনে সরাসরি রাজতন্ত্র উচ্ছেদের ডাক দেওয়া হচ্ছে না; এটি আসলে এক ধরনের রূপক প্রতিরোধ। বিক্ষোভকারীরা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও আইনের শাসনের মৌলিক নীতিকে অবজ্ঞা করছে। তাদের প্রতিবাদ ঠিক সেই ধারণার বিরুদ্ধেই। এই বিক্ষোভের প্রধান দুটি লক্ষ্য হচ্ছে: অভিবাসন, নাগরিক স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার সম্পর্কিত বিতর্কিত নীতির বিরোধিতা করা এবং নির্বাচিত কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল হতে চাপ সৃষ্টি করা। হাতে ‘আমেরিকায় কোনো রাজা নেই’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভকারীরা বলতে চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করাই তাঁদের প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন মতে, গণতান্ত্রিক নীতির অবক্ষয় ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবণতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ‘নো কিং’ বিক্ষোভগুলো ঘটছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর গণতন্ত্র ও ভারসাম্য নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ, কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশের ব্যবহার ও দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিক্ষোভ দমনে ফেডারেল এজেন্টদের মোতায়েন।
আন্দোলনকারীরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী ‘রাজার মতো’ আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। অনেকবারই ট্রাম্পের নিজের মুখে ক্ষমতার সীমাহীন প্রয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার প্রশাসন আদালতের নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে ফিরে ট্রাম্প অভিবাসন, কর ও বাণিজ্যে একযোগে অনেকগুলো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেন। ‘অপারেশন বর্ডার শিল্ড ২.০’-এর মাধ্যমে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের পাশাপাশি ‘ট্র্যাভেল ব্যান’ নীতি পুনর্বহাল করেন। ‘বিগ, বিউটিফুল বিলের’ মাধ্যমে কর্পোরেশন ও ধনীদের কর ছাড় দেন। ‘ট্যারিফ রিইনস্টেটমেন্ট অ্যাক্ট’-এর আওতায় বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ডব্লিউএইচও’ ও ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ থেকে প্রত্যাহার করেন। পাশাপাশি, ‘এন্ডিং র্যাডিক্যাল ইনডকট্রিনেশন’ আদেশের মাধ্যমে স্কুলে জেন্ডার ও বর্ণবিষয়ক শিক্ষা এবং ‘ডিইআই’ প্রোগ্রাম বাতিল করেন। এছাড়া বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ দমনের জন্য ফেডারেল এজেন্ট ও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেন।
বিশেষজ্ঞরা এসব কর্মকাণ্ডকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ওপর মারাত্মক আঘাত হিসেবে দেখছেন।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, এই প্রতিবাদ বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা উদ্বেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বিক্ষোভকারীরা আমেরিকান গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সংকটময় সন্ধিক্ষণ হিসেবে দেখছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই আন্দোলনকে ‘আমেরিকাবিরোধী সমাবেশ’ মন্তব্যের জবাবে ভারমন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘লাখো আমেরিকান আজ রাস্তায় নেমেছে দেশকে ঘৃণা করার জন্য নয়, বরং ভালোবাসার জন্য। তাঁরা এসেছেন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষায় অতীতের ত্যাগকে সম্মান জানাতে।’
ইনডিভিজিবলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এজরা লেভিনের মতে, এই বিক্ষোভকে শুধু ট্রাম্পের বিরোধিতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এই আন্দোলনকে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর নতুন রাজনৈতিক জাগরণেরও প্রতীক হিসেবেও দেখা উচিত।
অন্যদিকে, চলতি বছরের জুলাই মাসে ট্যারিফ ইস্যুতে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিকে উদ্দেশ্য করে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা বলেছিলেন, ‘বিশ্বের আর কোনো সম্রাটের প্রয়োজন নেই’।
যদিও ‘নো কিং’ আন্দোলন সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তবে রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অসংখ্য ঐতিহাসিক বিক্ষোভের সঙ্গে আদর্শগতভাবে এর মিল চোখে পড়ার মতো।
১৭৭৫ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারী শাসন প্রত্যাখ্যান ও স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল আমেরিকান বিপ্লব। সেই সময়ের বিপ্লবীরা একক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। আজকের ‘নো কিং’ বিক্ষোভেও একই মনোভাব প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
‘নো কিং’ আন্দোলনের সঙ্গে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৫৫ সালের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পদ্ধতিগত ও আদর্শগত গভীর মিল রয়েছে। ওই আন্দোলনের মতোই ‘নো কিং’ আন্দোলন অহিংস প্রতিরোধ, গণজমায়েত এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন যেমন ফেডারেল সরকারের কাছে সকল নাগরিকের জন্য সুরক্ষা দাবি করেছিল, তেমনি ‘নো কিং’ আন্দোলনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষায় সরকারের জবাবদিহিতা চাইছে।
১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার প্রসারের বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিরোধ ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন’-এর সঙ্গে ‘নো কিং’ আন্দোলনের আদর্শগত মিল রয়েছে। ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন’-এর অংশগ্রহণকারীরা বলেছিলেন, সরকার জনগণকে ভুল তথ্য দিয়ে অন্যায্য যুদ্ধে দেশকে জড়িয়ে ফেলেছে এবং কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। ‘নো কিং’ বিক্ষোভকারীরাও একইভাবে বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ও ভিন্নমতকে দমন করার অভিযোগ তুলেছে। উভয় আন্দোলনই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও জনগণের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দী জুড়ে গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফলে বিশ্বের অসংখ্য দেশ রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০১০-এর দশকের শুরুতে আরব বসন্তের অভ্যুত্থানগুলোতেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের দাবিতে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল।
এই ঐতিহাসিক ও চলমান আন্দোলনগুলো নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র হলেও, ‘নো কিং’ বিক্ষোভের সঙ্গে একটি সাধারণ সূত্রে গাঁথা: জনগণই তাদের নেতা নির্বাচন করবে ও নির্বাচিতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
‘নো কিং’ বিক্ষোভ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্ভবত আগামী মাস ও বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অগ্রগতির ওপর নির্ভর করবে। আয়োজকরা টেকসই, অহিংস প্রতিরোধের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার পাশাপাশি স্থায়ী রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে বৃহত্তর আন্দোলনের কথাও বলেছেন। কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, এই ধরনের আন্দোলনের সাফল্য বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রিত করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ।
‘নো কিং’ আন্দোলন ইতিমধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিজেদের লড়াইয়ে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। এই শক্তিকে রাজনৈতিক ফলাফলে রূপান্তরিত করাই হবে এই আন্দোলনের জন্য সামনের দিনের মূল চ্যালেঞ্জ।
শেষ পর্যন্ত, ‘নো কিং’ বিক্ষোভ গণতন্ত্রে নাগরিক অংশগ্রহণের শক্তিশালী স্মারক হিসেবে কাজ করে। স্বাধীনতা, সমতা ও স্বশাসনের নীতি সমুন্নত রাখার দীর্ঘ ও প্রায়শই শ্রমসাধ্য সংগ্রামের সমসাময়িক অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে ‘নো কিং’ আন্দোলন। এই আন্দোলন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে, তবে এর উত্থান নিঃসন্দেহে আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও এর নাগরিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে জাতীয় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, পলিটিকো
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘নো কিং’ (কোনো রাজা মানি না) আন্দোলনের ব্যানারে দেশব্যাপী বিক্ষোভের এক জোয়ার দেখা গেছে। দেশটির ছোট-বড় শহরগুলোতে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বৈরাচারসদৃশ কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।
২০২৫ সালের জুন ও অক্টোবর মাসের ঘটনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক জনসমাগম দেখা গেছে। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, আটলান্টা ও শিকাগোর মতো বড় শহরগুলোর পাশাপাশি ৫০টি রাজ্যের ছোট ছোট এলাকাতেও বড় আকারের মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) ও ইনডিভিজিবল-সহ ২০০টিরও বেশি প্রগতিশীল সংস্থা, ইউনিয়ন এবং নাগরিক অধিকার গোষ্ঠীর জোট এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বেশিরভাগ বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ হলেও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষও হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম এই গণজমায়েতকে অংশগ্রহণকারীরা দেখছেন গণতন্ত্র রক্ষার দেশাত্মবোধক সংগ্রাম হিসেবে। অন্যদিকে, প্রশাসন ও ট্রাম্প সমর্থকরা একে 'আমেরিকাবিরোধী' কার্যকলাপ বলে চিহ্নিত করেছে।
প্রশ্ন জাগছে, এই ব্যাপক জনরোষের পেছনের কারণগুলো কী, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আমেরিকার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতে এর তাৎপর্যই বা কেমন?
‘নো কিং’ বিক্ষোভ কী?
‘নো কিং’ বিক্ষোভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতি রক্ষার আন্দোলন। বিক্ষোভের মূল বার্তা হলো—যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একচ্ছত্র শাসনকে প্রত্যাখ্যান করার নীতির ওপর, তাই দেশটির কোনো প্রেসিডেন্টের রাজার মতো আচরণ করা উচিত নয়। বিক্ষোভকারী ও আয়োজকরা বলছেন, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন আদালতের আদেশ অমান্য করা, নাগরিক অধিকারের ওপর আক্রমণ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করছে।
এই আন্দোলনে সরাসরি রাজতন্ত্র উচ্ছেদের ডাক দেওয়া হচ্ছে না; এটি আসলে এক ধরনের রূপক প্রতিরোধ। বিক্ষোভকারীরা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও আইনের শাসনের মৌলিক নীতিকে অবজ্ঞা করছে। তাদের প্রতিবাদ ঠিক সেই ধারণার বিরুদ্ধেই। এই বিক্ষোভের প্রধান দুটি লক্ষ্য হচ্ছে: অভিবাসন, নাগরিক স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার সম্পর্কিত বিতর্কিত নীতির বিরোধিতা করা এবং নির্বাচিত কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল হতে চাপ সৃষ্টি করা। হাতে ‘আমেরিকায় কোনো রাজা নেই’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভকারীরা বলতে চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করাই তাঁদের প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন মতে, গণতান্ত্রিক নীতির অবক্ষয় ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবণতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ‘নো কিং’ বিক্ষোভগুলো ঘটছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর গণতন্ত্র ও ভারসাম্য নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ, কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশের ব্যবহার ও দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিক্ষোভ দমনে ফেডারেল এজেন্টদের মোতায়েন।
আন্দোলনকারীরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী ‘রাজার মতো’ আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। অনেকবারই ট্রাম্পের নিজের মুখে ক্ষমতার সীমাহীন প্রয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার প্রশাসন আদালতের নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে ফিরে ট্রাম্প অভিবাসন, কর ও বাণিজ্যে একযোগে অনেকগুলো আগ্রাসী পদক্ষেপ নেন। ‘অপারেশন বর্ডার শিল্ড ২.০’-এর মাধ্যমে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের পাশাপাশি ‘ট্র্যাভেল ব্যান’ নীতি পুনর্বহাল করেন। ‘বিগ, বিউটিফুল বিলের’ মাধ্যমে কর্পোরেশন ও ধনীদের কর ছাড় দেন। ‘ট্যারিফ রিইনস্টেটমেন্ট অ্যাক্ট’-এর আওতায় বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ডব্লিউএইচও’ ও ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ থেকে প্রত্যাহার করেন। পাশাপাশি, ‘এন্ডিং র্যাডিক্যাল ইনডকট্রিনেশন’ আদেশের মাধ্যমে স্কুলে জেন্ডার ও বর্ণবিষয়ক শিক্ষা এবং ‘ডিইআই’ প্রোগ্রাম বাতিল করেন। এছাড়া বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ দমনের জন্য ফেডারেল এজেন্ট ও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেন।
বিশেষজ্ঞরা এসব কর্মকাণ্ডকে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ওপর মারাত্মক আঘাত হিসেবে দেখছেন।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, এই প্রতিবাদ বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা উদ্বেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বিক্ষোভকারীরা আমেরিকান গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধগুলোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সংকটময় সন্ধিক্ষণ হিসেবে দেখছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই আন্দোলনকে ‘আমেরিকাবিরোধী সমাবেশ’ মন্তব্যের জবাবে ভারমন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘লাখো আমেরিকান আজ রাস্তায় নেমেছে দেশকে ঘৃণা করার জন্য নয়, বরং ভালোবাসার জন্য। তাঁরা এসেছেন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষায় অতীতের ত্যাগকে সম্মান জানাতে।’
ইনডিভিজিবলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এজরা লেভিনের মতে, এই বিক্ষোভকে শুধু ট্রাম্পের বিরোধিতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এই আন্দোলনকে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর নতুন রাজনৈতিক জাগরণেরও প্রতীক হিসেবেও দেখা উচিত।
অন্যদিকে, চলতি বছরের জুলাই মাসে ট্যারিফ ইস্যুতে ট্রাম্পের হুঁশিয়ারিকে উদ্দেশ্য করে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা বলেছিলেন, ‘বিশ্বের আর কোনো সম্রাটের প্রয়োজন নেই’।
যদিও ‘নো কিং’ আন্দোলন সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তবে রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অসংখ্য ঐতিহাসিক বিক্ষোভের সঙ্গে আদর্শগতভাবে এর মিল চোখে পড়ার মতো।
১৭৭৫ সালে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারী শাসন প্রত্যাখ্যান ও স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল আমেরিকান বিপ্লব। সেই সময়ের বিপ্লবীরা একক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। আজকের ‘নো কিং’ বিক্ষোভেও একই মনোভাব প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
‘নো কিং’ আন্দোলনের সঙ্গে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৫৫ সালের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পদ্ধতিগত ও আদর্শগত গভীর মিল রয়েছে। ওই আন্দোলনের মতোই ‘নো কিং’ আন্দোলন অহিংস প্রতিরোধ, গণজমায়েত এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন যেমন ফেডারেল সরকারের কাছে সকল নাগরিকের জন্য সুরক্ষা দাবি করেছিল, তেমনি ‘নো কিং’ আন্দোলনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষায় সরকারের জবাবদিহিতা চাইছে।
১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার প্রসারের বিরুদ্ধে নাগরিক প্রতিরোধ ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন’-এর সঙ্গে ‘নো কিং’ আন্দোলনের আদর্শগত মিল রয়েছে। ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন’-এর অংশগ্রহণকারীরা বলেছিলেন, সরকার জনগণকে ভুল তথ্য দিয়ে অন্যায্য যুদ্ধে দেশকে জড়িয়ে ফেলেছে এবং কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। ‘নো কিং’ বিক্ষোভকারীরাও একইভাবে বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ও ভিন্নমতকে দমন করার অভিযোগ তুলেছে। উভয় আন্দোলনই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও জনগণের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দী জুড়ে গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ফলে বিশ্বের অসংখ্য দেশ রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। ২০১০-এর দশকের শুরুতে আরব বসন্তের অভ্যুত্থানগুলোতেও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের দাবিতে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখা গিয়েছিল।
এই ঐতিহাসিক ও চলমান আন্দোলনগুলো নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র হলেও, ‘নো কিং’ বিক্ষোভের সঙ্গে একটি সাধারণ সূত্রে গাঁথা: জনগণই তাদের নেতা নির্বাচন করবে ও নির্বাচিতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
‘নো কিং’ বিক্ষোভ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্ভবত আগামী মাস ও বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অগ্রগতির ওপর নির্ভর করবে। আয়োজকরা টেকসই, অহিংস প্রতিরোধের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার পাশাপাশি স্থায়ী রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে বৃহত্তর আন্দোলনের কথাও বলেছেন। কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, এই ধরনের আন্দোলনের সাফল্য বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রিত করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ।
‘নো কিং’ আন্দোলন ইতিমধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিজেদের লড়াইয়ে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। এই শক্তিকে রাজনৈতিক ফলাফলে রূপান্তরিত করাই হবে এই আন্দোলনের জন্য সামনের দিনের মূল চ্যালেঞ্জ।
শেষ পর্যন্ত, ‘নো কিং’ বিক্ষোভ গণতন্ত্রে নাগরিক অংশগ্রহণের শক্তিশালী স্মারক হিসেবে কাজ করে। স্বাধীনতা, সমতা ও স্বশাসনের নীতি সমুন্নত রাখার দীর্ঘ ও প্রায়শই শ্রমসাধ্য সংগ্রামের সমসাময়িক অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে ‘নো কিং’ আন্দোলন। এই আন্দোলন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে, তবে এর উত্থান নিঃসন্দেহে আমেরিকান গণতন্ত্রের প্রকৃতি ও এর নাগরিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে জাতীয় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, পলিটিকো
তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার মশাল কর্মসূচি পালন করে রংপুর বিভাগের হাজার হাজার মানুষ। আগামী ৩০ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টা থেকে ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ‘স্তব্ধ রংপুর’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি।
১৪ ঘণ্টা আগে২০২৪ সালের শুরু থেকে জেনারেশন জেড বা জেন জিরা ১২টিরও বেশি দেশে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই প্রজন্ম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে তরুণ-নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের সূত্রপাত করে।
১ দিন আগেফিলিস্তিনের জনপ্রিয় কারাবন্দী নেতা মারওয়ান বারঘুতির পরিবার তার জীবন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি ইসরায়েলি কারারক্ষীদের হাতে বারঘুতি নির্মম প্রহারের শিকার হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এই আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে। তাঁর ছেলে আরব বারঘুতি আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, ইসরায়েলি সরকার বন্দীদের,
২ দিন আগেসবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এটা কেবল নোবেল কমিটির ভুল সিদ্ধান্ত নয়, বরং এমন এক পদক্ষেপ যা ট্রাম্পকে আরও বেশি সামরিক হস্তক্ষেপ ও শক্তি প্রদর্শনের পথ খুলে দিয়েছে। এর মাধ্যমে লাতিন আমেরিকায় বন্দুকনির্ভর কূটনীতি আবারও জোরদার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
৩ দিন আগে