দক্ষিণ এশিয়া বর্তমানে এক চরম ভূ-রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আঞ্চলিক সংঘাতের তীব্রতা আর প্রতিটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা মিলিতভাবে নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করেছে। এমনকি এই অস্থিরতার ঢেউ বাংলাদেশের স্থিতিশীলতায় আঘাত হানার ঝুঁকি তৈরি করেছে। এই অঞ্চলের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সম্প্রতি তাদের নিজ নিজ রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতামূলক হামলার শিকার হয়েছে। নয়াদিল্লিতে বোমা বিস্ফোরণ এবং ইসলামাবাদে একই কায়দার গাড়ি বোমা হামলা প্রমাণ করে যে, সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। উপমহাদেশের আঞ্চলিক উত্তেজনার পারদ যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুকতা, পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হওয়া এবং অদ্যাবধি সেগুলো ঠিকঠাক উদ্ধার না হওয়া দেশের নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। দেশের বর্তমান দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা এই ঝুঁকিগুলোকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করি। পার্শ্ববর্তী দেশে সংঘটিত ঘৃণ্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং এদেশের অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যের সম্মিলিত আক্রমণ কি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে গ্রাস করতে পারে! নাকি বাংলাদেশ এই চক্রব্যূহ ভেদ করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে? নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এটিই এখন বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আঞ্চলিক অস্থিরতার সংকেত: নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদের বিস্ফোরণ
অল্প সময়ের ব্যবধানে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্রের রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতামূলক হামলার ঘটনা আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্কের একটি গুরুতর পুনরুত্থানের সংকেত দিচ্ছে। একই কায়দায় বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো কেবল স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর ও সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ হতে পারে; যা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে লক্ষ্য করে ঘটানো হয়েছে।
ক) দিল্লিতে বিস্ফোরণ: সন্ত্রাসের গভীর শিকড়
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির জনাকীর্ণ লালকেল্লা মেট্রোস্টেশনের কাছে একটি চলন্ত বা পার্ক করা গাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই হামলায় প্রাথমিক প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ৮ জন বলা হলেও পরে এই সংখ্যা ১৩ জনে দাঁড়ায়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে এটি রাজধানীতে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। প্রাথমিক তদন্তে এবং কিছু গণমাধ্যম রিপোর্টে পাকিস্তানভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের দিকে সন্দেহের তির যায়। কিছু প্রতিবেদনে এমনও দাবি করা হয় যে, এটি তাদের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বদলা বা প্রতিশোধ হতে পারে, যেখানে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা মাসুদ আজহারের পরিবারের সদস্য নিহত হয়েছিলেন।
আবার কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বাকে দায়ী করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দাবি করা হয় যে এই গোষ্ঠীটি বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে ভারতে হামলা চালিয়েছে। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে নাকচ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং উভয়েই এই ঘটনাকে একটি নাশকতা বা ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন, জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা করেন। এই ঘটনার পর দিল্লিতে উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয়। লালকেল্লার মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়।
খ) ইসলামাবাদে হামলা: আফগান সংযোগের অভিযোগ
দিল্লির ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে একটি আদালতের বাইরে একই ধরনের কায়দায় গাড়ি বোমা বা আত্মঘাতী হামলা ঘটে। এই হামলায় কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছেন বলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া এই ঘটনায় প্রায় ২৭ জন আহত হন। ঘটনাস্থলের স্পর্শকাতরতা ও হামলার ধরন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে এই আত্মঘাতী হামলায় ভারতের চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো বা ভারতের ‘সন্ত্রাসী প্রক্সি’ জড়িত। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই হামলার পেছনে আফগানিস্তানের মদত থাকতে পারে; আফগানিস্তানের তালেবান সরকার যদি চায়, তাহলে তারা পাকিস্তানে সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারে।
ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে আফগান সরকারকে তেহরিক-ই-তালেবানকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে। যদিও তেহরিক-ই-তালেবান কেন্দ্রীয়ভাবে এই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তবে জামা-উল-আহরার নামে তেহরিক-ই-তালেবানের একটি ভিন্নমতাবলম্বী অংশ এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, পাকিস্তানের ‘অনৈসলামিক আইন’ অনুযায়ী রায় প্রদানকারী বিচারক, আইনজীবী ও কর্মকর্তারা তাদের লক্ষ্যবস্তু।
গ) ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত ঝুঁকি
প্রায় একই ধরনের নাশকতামূলক কৌশল অবলম্বন করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের রাজধানীতে সন্ত্রাসী হামলা চালানো এই ইঙ্গিত দেয় যে, এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ক এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়েও কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম। এই হামলার পর দোষারোপের রাজনীতি আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এসব আঞ্চলিক অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসবাদের ঢেউয়ের সরাসরি প্রভাবে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি তৈরি হয়। কেননা যখন আঞ্চলিক নিরাপত্তা শিথিল হয় তখন আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সহজেই দুর্বল সীমান্ত ব্যবহার করে নিজেদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের সীমান্তের দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক শিথিলতা এই ধরনের সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ ও কার্যক্রম বিস্তারের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, যা বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ফেলেছে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্বলতা: আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুকতা
আঞ্চলিক অস্থিরতার বিপরীতে, দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে তার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার ওপর। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামো এক গভীর সংকটের মুখে। যেমন—
ক) অস্ত্রাগার লুট ও উদ্ধার না হওয়া অস্ত্র
দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ইতিহাসে অন্যতম উদ্বেগজনক ঘটনা হলো গত বছর গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের বিভিন্ন থানা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হওয়া। এই ঘটনাটি কেবল একটি লুণ্ঠন নয়, বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ওপর একটি বড় ধরনের আঘাত। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, লুট হওয়া অস্ত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩৬৯টি। যার মধ্যে রাইফেল, শটগান, টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার ও সিগন্যাল পিস্তলের মতো মারণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়াও প্রায় ৬ লক্ষাধিক রাউন্ড গোলাবারুদ বেহাত হয়ে যায়। বিশাল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এই ব্যর্থতা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য চরম ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করে এদেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে থাকা নেতা-কর্মীদের নাশকতা চালানোর ক্রমাগত উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো আঞ্চলিক বা অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর নির্বাচনের প্রাক্কালে নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মীদের সহযোগে বড় ধরনের নাশকতামূলক হামলা বা সহিংসতা চালানোর জন্য এই অস্ত্রগুলো মারাত্মক হুমকি।
খ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্বল প্রশাসন: নৈরাজ্যের সুযোগ
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে প্রশাসনিক কাঠামোতে যে শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য সৃষ্টিতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায়শই পূর্ণকালীন সরকারের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বা কঠোর প্রশাসন চালাতে সক্ষম হয় না। এই সময়ে আমলাতান্ত্রিক শিথিলতা ও আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্বল তদারকির কারণে অপরাধীরা দ্রুত বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ পায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাধারণ প্রশাসনের শিথিলতা মিলেমিশে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এর ফলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সেই সঙ্গে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়।
সীমান্তে অস্থিরতা ও অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ
আঞ্চলিক সন্ত্রাস ও অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক দুর্বলতার পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো বর্তমানে অস্থিতিশীলতা ও অবৈধ অস্ত্রের প্রধান করিডোর হিসেবে কাজ করছে, যা দেশের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে।
ক) পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও জঙ্গি তৎপরতার ঝুঁকি
দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল ধরে বিরাজমান সংঘাত এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ কোন্দল এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকাকে ব্যবহার করে আঞ্চলিক বা পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অনুপ্রবেশ ও তৎপরতা বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই অঞ্চলের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ চরমপন্থীদের জন্য একটি নিরাপদ আস্তানা বা প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে।
খ) মিয়ানমার সীমান্তের অশান্তি ও চোরাচালানের সুযোগ
মিয়ানমারে চলমান সামরিক সংঘাত এবং রাখাইন রাজ্যের অস্থিতিশীল পরিবেশের সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অনুভূত হচ্ছে। সীমান্ত-সংলগ্ন অঞ্চলগুলো থেকে আসা গোলাগুলি ও সংঘাতের শব্দ একদিকে যেমন স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে, তেমনি তা চোরাচালানের জন্য এক মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মনোযোগ সংঘাতের দিকে কেন্দ্রীভূত থাকার কারণে বিভিন্ন অপরাধী চক্র এই সুযোগে অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচারের মতো অবৈধ কার্যক্রমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
গ) অবৈধ অস্ত্রের চালান এবং অরাজকতার প্রস্তুতি
বিভিন্ন সময়ে দেশের সীমান্ত অঞ্চল ও অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান ধরা পড়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে দেশের অভ্যন্তরে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরির সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি চলছে। গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান লক্ষ্য হতে পারে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে অরাজকতা, নাশকতা ও সহিংসতা চালানো। এই চোরাচালানের পথটি অভ্যন্তরীণ সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের রসদ যোগাচ্ছে, যা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের হুমকির সঙ্গে মিশে এক মারাত্মক বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য নির্বাচনকে ঘিরে অরাজকতার আশঙ্কা
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য এক 'ট্রানজিশনাল ঝুঁকি' তৈরি করেছে। বিদ্যমান আঞ্চলিক সন্ত্রাস ও অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যের পটভূমিতে নির্বাচনকে ঘিরে অরাজকতার আশঙ্কা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক) রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি ও বহুমুখী প্রভাব
নির্বাচনকে ঘিরে প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার অনমনীয় বিভেদ ও সংঘাতের কারণে দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। হরতাল, অবরোধ ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির নামে রাস্তায় সহিংসতা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে শেখ হাসিনার মামলার সম্ভাব্য রায়কে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি পোড়ানো বা আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। এসব নাশকতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সরাসরি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে। এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা-দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলে।
খ) তৃতীয় পক্ষের সুবিধা গ্রহণ: সন্ত্রাসবাদের হাতছানি
রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে উঠলে তা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে বাড়ায় না, বরং আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য এক বিশাল সুযোগ তৈরি করে। যখন রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দেয়, তখন সন্ত্রাসীরা তাদের নাশকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফাঁকা মাঠ পেয়ে যায়। পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া মারণাস্ত্রগুলো অপরাধী বা জঙ্গি সংগঠনের হাতে থাকায় যেকোনো সহিংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এছাড়াও সীমান্ত পার হয়ে আসা অবৈধ অস্ত্রের চালানগুলো নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও নাশকতার রসদ যোগাতে ব্যবহৃত হতে পারে। নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি চরমে পৌঁছায়, তবে আঞ্চলিক সন্ত্রাস ও অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যের শক্তিগুলো এটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে এক গভীর ও বিস্তৃত নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সম্ভাব্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় কৌশলগত উদ্যোগ
সম্ভাব্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় সরকারকে কেবল স্বল্পমেয়াদি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেমন—
১. লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা। এই অভিযান কেবল অস্ত্র উদ্ধার নয়, এর পেছনে জড়িত নেটওয়ার্ককে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হতে হবে।
২. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত প্রশাসনিক কাঠামোতে বিদ্যমান দুর্বলতা, শিথিলতা ও সমন্বয়হীনতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারত্ব নিশ্চিত করে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই কঠোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩. সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পাহাড় এবং বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে নজরদারি ও টহল ব্যাপকভাবে জোরদার করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের চোরাচালান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ব্যবহার বাড়ানো আবশ্যক।
৪. প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান ও নিরাপত্তা সমন্বয় বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। এই সহযোগিতা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে সহায়ক হবে। পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সন্ত্রাসবাদকে অভিন্ন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের ঢেউ ও অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যের এক জটিল ‘চক্রব্যূহে’র মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদে ঘটে যাওয়া বোমা হামলা প্রমাণ করে যে, এই অঞ্চলে জঙ্গি নেটওয়ার্ক পুনরায় সক্রিয় এবং সেই অস্থিরতা যেকোনো সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হওয়ার পরও তা উদ্ধার করতে না পারার ঘটনা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাহাড় ও মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনকে ঘিরে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান বৃদ্ধি। এই সম্মিলিত চ্যালেঞ্জগুলো দেশের জননিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য চরম হুমকি।
এই সংকট মোকাবিলায় সরকারকে অবিলম্বে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান অপরিহার্য। এই চারটি প্রধান দুর্বলতা দ্রুত নিরসন করতে ব্যর্থ হলে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সন্ত্রাস ও অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যের এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে।