বাংলাদেশ এখন ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশায় জাতি উল্লসিত হয়েছিল, সেই আশাই এখন অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা। জুলাই জাতীয় সনদ—যে দলিল একসময় নতুন রাজনৈতিক চুক্তির প্রতীক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল—আজ তা-ই হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দু। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অমিল এখন পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই অনিশ্চিত করে তুলেছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পর এই জাতীয় সনদ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের রূপরেখা। এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচন কমিশন সংস্কার, প্রশাসনের জবাবদিহিতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠনের। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন রাজনীতির কৌশলগত হিসাব-নিকাশে বন্দি।
বিএনপি বলেছে, জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে গিয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে তার সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তাবে। সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তখন সেই সিদ্ধান্ত মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। জামায়াতসহ আটটি রাজনৈতিক দল দাবি করছে গণভোট ছাড়া কোনো নির্বাচনের অর্থ জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করা। তাদের অবস্থান স্পষ্ট—‘আগে গণভোট, তারপর নির্বাচন’।
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংকটের মূলে আছে এক গভীর অবিশ্বাসের সংস্কৃতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক অবিশ্বাসের পরিবেশে চলে, যেখানে দলগুলো একই লক্ষ্যে ঐকমত্যে পৌঁছালেও পরস্পরের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ করে। ফলে ঐক্য অচিরেই ভেঙে পড়ে।’
জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি থেকে এনসিপি, জামায়াত থেকে বাম দল—ফ্যাসিস্টবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই ঐক্য ছিল মূলত স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের তাড়নায়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিন্ন দর্শনে নয়। শত্রু অপসারিত হতেই ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ফিরে এসেছে নিজের পুরনো ছন্দে।
এই সংকটের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো, জুলাইয়ের যে চেতনা সাধারণ মানুষের ঐক্য, সাহস ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, তা আজ রাজনীতির অন্তঃকলহে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছিল সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ। তারা রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছিল অভিজাত শ্রেণির হাত থেকে। অথচ এখন সেই চেতনার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে তারাই, যারা নিজেদের জনগণের প্রতিনিধি দাবি করেছিল। জুলাই সনদ নতুন রাজনীতির এক প্রতীক-অন্তর্ভুক্তি, জবাবদিহি ও সংস্কারের রাজনীতি। অথচ আজ সেই সম্ভাবনা দমে যাচ্ছে দলীয় হিসাবের যুদ্ধে।
সময়ের হিসেবে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। এই অচলাবস্থার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। উসকে দিতে পারে অনির্বাচিত শক্তির হস্তক্ষেপ। জুলাইয়ের অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে—জনতার শক্তি স্বৈরাচার ভাঙতে পারে, কিন্তু কেবল প্রতিষ্ঠানই গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পারে। জুলাই সনদ যদি ব্যর্থ হয়, তা শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, হবে জনতার আন্দোলনের প্রতি এক নৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা।
তাহলে এই ব্যর্থতার দায় কার? বাস্তবতা হলো, দায় সবারই। সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসল, কিন্তু চূড়ান্ত কিছু করতে পারল না। সরকার এখন বলছে তারাই সিদ্ধান্ত জানাবে। তখন রাজনৈতিক দলগুলোকে বললেই হতো যে, আপনারা একমত না হলে সরকারই সিদ্ধান্ত দেবে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, এই সরকার কখনো ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ হতে পারেনি, সবসময় ‘প্রো-রিঅ্যাকটিভ’ ভূমিকায় থেকেছে। অথচ গণঅভ্যুত্থানের এই সরকার হলো সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবও অচলাবস্থাকে স্থায়ী করছে। ফলে বাংলাদেশ আবারও আটকে গেছে ‘শর্তসাপেক্ষ গণতন্ত্রে’—যেখানে প্রতিটি পক্ষ নিজের শর্তে রাজনীতি চালাতে চায়। গণতান্ত্রিক রূপান্তর ব্যর্থ হয় দূরদর্শিতার অভাবে নয়, সংযমের অভাবে। প্রতিটি দল চায় নতুন ব্যবস্থার স্থপতি হতে, অংশীদার নয়।
আজ বাংলাদেশের সামনে দুটি পথ খোলা—সমঝোতার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন অথবা অহমিকায় বিভক্ত গণতন্ত্র। জুলাইয়ের রাস্তায় যারা জীবন বাজি রেখে নেমেছিল, তারা আরেক দফা দোষারোপের রাজনীতি চায়নি। তারা চেয়েছিল ন্যায়, মর্যাদা ও সম্মিলিত ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। জুলাই সনদ জনগণের, রাজনীতিবিদদের নয়। তারা যদি এর প্রতি শ্রদ্ধা না দেখায়, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না, শুধু তাদের কল্পনার সীমাবদ্ধতাকেই স্মরণ করবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান অচলাবস্থা যদি দ্রুত না কাটে, তবে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়েও গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। কারণ এই সনদ শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়, এটি বর্তমান গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নৈতিক ভিত্তি। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা প্রশাসনিক প্রস্তুতি, প্রার্থী মনোনয়ন এবং ভোটার আস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য না হলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং নতুন করে আন্দোলন, বর্জন বা সংঘাতের ঝুঁকি বাড়বে।
জুলাই সনদে প্রতিশ্রুতি ছিল নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির নিশ্চয়তা। এই প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ মানে হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আগের মতোই একপাক্ষিক রেখে দেওয়া। তাই সনদসংকট এখন শুধু রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রের বৈধতা ও জনগণের আস্থার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে। যদি পক্ষগুলো দায়িত্বশীল না হয়, তবে গণতন্ত্রের নবযাত্রা আবারও পুরোনো অচলায়তনে ফিরে যাবে।
তবে এখনো সময় আছে। সরকারের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলো রাজি হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ গতিতে এগোতে পারে। তাতে সংকট থেকে মুক্তি পারে দেশ। ক্ষতি থেকে বাঁচবে রাজনৈতিক দল। হতাশ হবে ফ্যাসিস্ট ও তার দোসররা। বহাল হবে গণতন্ত্র।
লেখক:
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন