leadT1ad

বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড কোনগুলো, আইন কী বলে

বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ বলতে এমন সব কাজ বোঝায়, যা জাতীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সরকারের কর্তৃত্ব বা রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করে। এর পরিসর সরাসরি বিদ্রোহ ও সন্ত্রাস থেকে শুরু করে অনলাইনে ‘উসকানিমূলক’ প্রচারণা বা অনুমোদনহীন বিক্ষোভ পর্যন্ত বিস্তৃত।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এমন কর্মকাণ্ডই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড। স্ট্রিম গ্রাফিক

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি দেশের রাজনীতি ও বিচারপ্রক্রিয়ায় এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে। মামলাটি করা হয় রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগে।

অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে, ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’-এর এক জুম মিটিং। তদন্তে জানা যায়, দেশি-বিদেশি ৫৭৭ জন ওই সভায় যোগ দিয়ে শেখ হাসিনাকে পুনর্বহালের পক্ষে প্রতিশ্রুতি দেন। আলোচনায় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার অভিযোগও উঠে আসে।

মামলায় মোট ২৮৬ জন অভিযুক্ত। এদের মধ্যে ২৬১ জন পলাতক, যার মধ্যে শেখ হাসিনাও আছেন। তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে ২৮ জন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য—বিদ্রোহ দমনে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা।

বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ বলতে এমন সব কাজ বোঝায়, যা জাতীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সরকারের কর্তৃত্ব বা রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করে। এর পরিসর সরাসরি বিদ্রোহ ও সন্ত্রাস থেকে শুরু করে অনলাইনে ‘উসকানিমূলক’ প্রচারণা বা অনুমোদনহীন বিক্ষোভ পর্যন্ত বিস্তৃত।

রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ধরন

‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে’র একক আইনগত কোনো সংজ্ঞা নেই; বরং এটি বিভিন্ন আইনের সমন্বয়ে গঠিত এবং অনেক সময় কর্তৃপক্ষ ব্যাপকভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড বলতে সাধারণত যেসব কার্যকলাপকে বোঝায়—

সরকার উৎখাত বা রাষ্ট্রদ্রোহ:

সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহে প্ররোচনা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচারণা।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ:

সহিংসতার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ভয় দেখানো, চরমপন্থী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন বা হামলা সংগঠিত করা।

উসকানিমূলক প্রচার:

গণমাধ্যম বা অনলাইনে বিভ্রান্তিকর বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তথ্য প্রচার।

বিদেশি যোগসাজশ:

অন্য রাষ্ট্র বা বিদেশি সংস্থার সঙ্গে মিলে দেশ অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা। বিদেশি তহবিল বা সংযোগ ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা, অথবা নির্বাসিত রাজনীতিবিদদের বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্র।

অননুমোদিত আন্দোলন:

অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ বা প্রচারণা, যা জনশৃঙ্খলা নষ্ট করতে পারে।

আইনি কাঠামো ও শাস্তির ধরন

এর আইনী কাঠামো ও শাস্তি অনেক কঠোর। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই আটক করা যায়। অনেক সময় অনুপস্থিতিতেও বিচার চালানো যায়, যেমন শেখ হাসিনার মামলায় দেখা যাচ্ছে।

প্রধান আইন ও শাস্তি:

দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (ধারা ১২১–১৩০, ১২৪এ):

এই ধারায় অপরাধের মধ্যে রয়েছে—রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, অসন্তোষ উস্কে দেওয়া ও রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রদান। শাস্তির মধ্যে রয়েছে—মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা ৩ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩/২০২৩):

অপরাধের মধ্যে রয়েছে— সহিংসতা বা সরকারি কর্তৃপক্ষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে হামলা, ক্ষয়ক্ষতি বা হত্যাকাণ্ড সংঘটন; জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা প্রচারণা। শাস্তি—মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, ৫–২০ বছর কারাদণ্ড, সম্পদ বাজেয়াপ্ত।

বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪:

এই আইনে সন্দেহভাজন রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের জন্য বিচার ছাড়াই আটক রাখা যায়। শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছর একাকী কারাবাস, তবে মেয়াদ বাড়ানো যায়।

সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩:

অনলাইনে রাষ্ট্রবিরোধী বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার। ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ (সংশোধিত):

মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন। অনুপস্থিতিতেও বিচার অনুমোদিত।

২০২৫ সালের ১৪ অক্টোবর আদালত পলাতকদের নামে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেয়, যা বিচার শুরুর পথ খুলে দেয়।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২৫ সালের আগস্টে এমন একটি খসড়া অধ্যাদেশও প্রস্তুত করছে, যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কনটেন্ট’ প্রকাশের দায়ে প্ল্যাটফর্মগুলোকেও জরিমানা করা যায়।

সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডেভোকেট এবং আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘এই ধরনের আইন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই আইনগুলো রাখা হয়। এসব আইনে সাজাও অনেক কঠোর হয়। অনেক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়।’

শেখ হাসিনাসহ ২৮৬ জনের মামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি মূলত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। এই মামলার সাজাও অনেক কঠোর হতে পারে। সর্বোচ্চ সাজার রায়ও আসতে পারে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত