ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্তকারী ‘চিকেনস নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডোর হলো এক চরম কৌশলগত সংবেদনশীল ভূখণ্ড, যা সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের ‘লাইফলাইন’ হিসেবে পরিচিত। এই করিডোরের একদিকে চীন নিয়ন্ত্রিত চুম্বি উপত্যকা, অন্যদিকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত অবস্থিত। সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে, বিশেষ করে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটারে সামরিক সক্ষমতার ব্যাপক পুনর্গঠন ও আধুনিকীকরণ শুরু করেছে। এই পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে সীমান্তের কাছে নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত এই সামরিক প্রস্তুতি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য কি কোনো গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে?
শিলিগুড়ি করিডোর অথবা ‘চিকেনস নেক’
এই ভূখণ্ডের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে এবং আকৃতি অনেকটা মুরগির গলার মতো সংকীর্ণ, যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে সর্বনিম্ন ২২ কিলোমিটার। ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের (সেভেন সিস্টারস) সঙ্গে যুক্তকারী এটিই একমাত্র স্থলপথ। এই করিডর দিয়েই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম, রসদ ও সেনা সরবরাহ করা হয়। তবে এটি কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হলে ভারত ভৌগোলিকভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে। শিলিগুড়ি করিডোরকে এজন্য ভারতের লাইফ লাইন বলা হয়ে থাকে। এই করিডোরের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পূর্বে নেপাল ও ভুটান এবং উত্তরে চীন নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা।
ক. ভৌগোলিক সংবেদনশীলতা ও সামরিক ঝুঁকি
শিলিগুড়ি করিডোরের সংকীর্ণতা ভারতের জন্য কৌশলগত দুর্বলতা সৃষ্টি করে। চীনের সামরিক পরিকল্পনাবিদেরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে করিডোরটি অবরুদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন করার ‘কাটিং দ্য নেক’ কৌশল অবলম্বন করতে পারে বলে সামরিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করেন।
করিডোর থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চীন নিয়ন্ত্রিত চুম্বি উপত্যকা একটি কৌশলগত ‘ফানেল’-এর মতো আকৃতিতে রয়েছে। এখান থেকে চীন খুব সহজেই নিচে নেমে এসে (অ্যাসেন্ডিং টু ডিসেন্ডিং টপোগ্রাফি) করিডোরকে লক্ষ্য করে সামরিক অভিযান চালাতে পারে, বিশেষ করে ডোকলাম বা সিকিম সেক্টরের সঙ্গে সমন্বয় করে। অথচ করিডোরের ছোট আকারের কারণে সেখানে বিমান প্রতিরক্ষার জন্য বিশাল বা ভারী সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করা কঠিন। সামান্য গোলযোগ বা আক্রমণ হলেই বেসামরিক অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
খ. সেভেন সিস্টার্সের জীবনরেখা অর্থনৈতিক নির্ভরতা
শুধু সামরিক নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মানুষের দৈনন্দিন পণ্য, জ্বালানি, ওষুধপত্র ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর সরবরাহ এই করিডোরের ওপর নির্ভরশীল। তাই করিডোরটি বিচ্ছিন্ন হলে অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়বে। শিলিগুড়ি করিডোর দুটি প্রধান জাতীয় সড়ক, এনএইচ-২৭ ও এনএইচ-১২ এবং মূল ব্রডগেজ রেললাইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই পরিবহন রুটগুলোর বিকল্প নেই।
গ. আন্তর্জাতিক প্লেয়ারদের ভূমিকা ও কৌশলগত উদ্বেগ
চিকেনস নেককে বিচ্ছিন্ন করা চীনের মূল কৌশলগত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি, যা ডোকলাম, ইয়াংৎসে বা অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের চাপের সময় ব্যবহৃত হতে পারে। চীনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে (উন্নত সড়ক, রেল সংযোগ, দ্রুত সেনা মোতায়েন দক্ষতা ইত্যাদি) এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ করিডোরের পশ্চিমে অবস্থিত হওয়ায়, ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল অনুযায়ী এটি একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে গণ্য। তবে বাংলাদেশের মাধ্যমে কোনো ‘তৃতীয় পক্ষের’ (যেমন চীন/পাকিস্তান) সামরিক বা গোয়েন্দা তৎপরতা ভারতের জন্য মারাত্মক উদ্বেগের কারণ। এ কারণে সীমান্তে শান্তি বজায় রাখা এবং সামরিক কার্যকলাপের ওপর নজরদারি রাখা ভারতের জন্য অত্যাবশ্যক। নেপাল ও ভুটান চিকেনস নেকের উত্তরে ও পূর্বে অবস্থিত হওয়ায় ভারত তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যাপক সামরিক ও কূটনৈতিক বিনিয়োগ করে। এই দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক করিডোরের পার্শ্ব-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
ঘ. ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল
শিলিগুড়ি করিডোরের উচ্চ ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ভারত এই অঞ্চলে ‘ফোর্ট্রেস সিকিউরিটি’ কৌশল গ্রহণ করেছে। করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিশেষ করে ত্রিশক্তি কোর, শিলিগুড়ির সুকনাতে সদর দপ্তর স্থাপন করেছে এবং এটি সর্বোচ্চ যুদ্ধ প্রস্তুতিতে থাকে। করিডোরের চারপাশে ভূমি, আকাশ ও ইলেকট্রনিক নজরদারির মাধ্যমে বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ভারত চিকেনস নেকের ওপর নির্ভরতা কমাতে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা এবং আকাশ ও জলপথে সংযোগের মতো বিকল্প লজিস্টিক রুট তৈরির জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কেন না চিকেনস নেক হলো ভারতের ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোর একটি ‘একিলিস হিল’ বা দুর্বলতম স্থান, যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর দেশের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটারের সামরিক পুনর্গঠন
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং বিশেষ করে চীন ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কৌশলগত সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সামরিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে, যাকে ‘ইস্টার্ন থিয়েটার’-এর পুনর্গঠন বলা যেতে পারে।
ক. থিয়েটার কমান্ড
ভারতের সামরিক নেতৃত্ব বর্তমানে ১৭টি একক কমান্ডকে কয়েকটি সমন্বিত ‘থিয়েটার কমান্ড’-এ একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ‘ইস্টার্ন ল্যান্ড থিয়েটার’ বা উত্তর ফ্রন্ট অন্যতম। এর লক্ষ্য সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মধ্যে একাত্মতা ও সমন্বিত যুদ্ধের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। এতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং যেকোনো সামরিক হুমকির মুখে দ্রুত সমন্বিত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা যাবে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ত্রিশক্তি কোর-এর সদর দপ্তর বা পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর শিলিগুড়ির কাছাকাছি সুকনায় স্থাপন করা হয়েছে।
খ. সামরিক সরঞ্জাম ও সক্ষমতা বৃদ্ধি
চিকেনস নেকের সুরক্ষার জন্য এই অঞ্চলে ভারত যে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রাফাল যুদ্ধবিমান, ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র রেজিমেন্ট, এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, এমআরএসএএম (মিডিয়াম রেঞ্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইল) ও আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি। এর মধ্যে রাফাল যুদ্ধবিমান পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা বিমানঘাঁটি-এ মোতায়েন করা হয়েছে। যার লক্ষ্য আকাশপথে সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং দ্রুত স্ট্রাইক ক্ষমতা বজায় রাখা। ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র রেজিমেন্ট শিলিগুড়ি করিডোর বরাবর কৌশলগত অবস্থানে মোতায়েন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে সম্ভাব্য হুমকি প্রতিরোধ করা। এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তাদের কৌশলগত স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে।
রাশিয়া থেকে কেনা এই অত্যাধুনিক সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল চীন বা অন্যকোনো শত্রুপক্ষের বিমান অনুপ্রবেশ রোধে ডিজাইন করা হয়েছে। তাদের এমআরএসএএম ও আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে মোতায়েন রয়েছে। ইজরায়েল ও ভারতের যৌথভাবে তৈরি এমআরএসএএম এবং দেশীয় ‘আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারত ত্রি-স্তরীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এছাড়া সেখানে তিন বাহিনীর সমন্বয়ে নিয়মিত সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে টি-৯০ ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে লাইভ-ফায়ার ড্রিলও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৮ হাজার ১৬০ কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছে আকাশ-অ্যাডভান্সড সিস্টেমের দুটি নতুন রেজিমেন্টের জন্য, যেখানে থাকবে উন্নত সিকার প্রযুক্তি ও ৩৬০ ডিগ্রি হামলা প্রতিরোধ ক্ষমতা।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও উদ্বেগের মূল কারণ
ভারতের সাম্প্রতিক কালের এই পুনর্গঠন এবং চিকেনস নেকের সুরক্ষামূলক কৌশল সরাসরি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাকেন্দ্রিক। এ কারণে ভারতের এই সামরিক প্রস্তুতিকে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে উদ্বেগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ক. সীমান্তে নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা প্রধানত তিনটি মূল নথির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এগুলো হচ্ছে ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি, ১৯৭৫ সালের জয়েন্ট গাইডলাইনস এবং ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। সীমান্ত সংক্রান্ত এই চুক্তিগুলোতে ‘বন্ধুসুলভ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা’-এর সাধারণ ধারণা থাকলেও সামরিক ঘাঁটি বা আক্রমণাত্মক অস্ত্রের মোতায়েনের দূরত্ব বা ধরন নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ‘কঠিন নিয়ম’ বা স্পষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।
ভারত অন্য সীমান্তগুলিতে (যেমন চীন) ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম) চুক্তি অনুসারে সীমান্ত থেকে ১০ থেকে ২০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে আক্রমণাত্মক পরিকাঠামো বা ভারী যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন না করার নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে এই ধরনের কোনো সিবিএম না থাকায় ভারত কৌশলগত সুযোগ নিচ্ছে বলে মনে করা হয়। এটাই উদ্বেগের কারণ। তবে সর্বাধিক উদ্বেগের কারণ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছেই অতি স্বল্প সময়ে নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা। এর মধ্যে বামুনি (লাচিত বোরফুকন মিলিটারি স্টেশন) ঘাঁটি আসামের ধুবড়ির কাছে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৩০ কিমি দূরত্বের মধ্যে) অবস্থিত।
আসাম-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কৌশলগত ফাঁক পূরণ ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই ঘাঁটি স্থাপন করা হয়ে থাকতে পারে। কিশানগঞ্জ ঘাঁটির অবস্থান বিহারে (বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে)। চোপড়া ঘাঁটির অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলা (বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে)।
নতুন এই ঘাঁটিগুলো স্থাপন করা হচ্ছে মূলত সীমান্তের নজরদারি বাড়াতে এবং চিকেনস নেকের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে যেকোনো অস্থিরতা দ্রুত মোকাবিলার জন্য ‘কন্টিজেন্সি রেস্পন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ তৈরি করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই উদ্যোগ দেশটির বৃহত্তর সামরিক পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো, কৌশলগত দুর্বলতা রোধ করা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত চুক্তিগুলোতে ‘বন্ধুসুলভ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা’র সাধারণ ধারণা থাকলেও, সামরিক ঘাঁটি বা আক্রমণাত্মক অস্ত্রের মোতায়েনের দূরত্ব বা ধরন নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ‘কঠিন নিয়ম’ বা স্পষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। আবার আন্তর্জাতিক আইনে সাধারণত দেশগুলোকে তাদের সার্বভৌম সীমানার মধ্যে যেকোনো স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়। তাই বাংলাদেশ সীমান্তের ৩০ কিমি বা তারও কাছাকাছি দূরে ভারত সামরিক ঘাঁটি (বামুনি, কিষাণগঞ্জ বা চোপড়া) স্থাপন করলে তা আইনগতভাবে চুক্তিভঙ্গ করে না। তবে সমস্যাটি আসলে আইনগত নয়, বরং ‘আস্থা ও বিশ্বাস’-এর ক্ষেত্রে। বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সীমান্তে এত কাছাকাছি (যেমন ৩০ কিমি) আক্রমণাত্মক প্রকৃতির সেনা (প্যারা-এসএফ ইউনিট) মোতায়েন করা আসলে ‘বন্ধুসুলভ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা’র মূল চেতনার পরিপন্থী।
খ. ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটারের সামরিক পুনর্গঠন নিম্নলিখিত কারণে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করে:
১. সামরিক চাপ ও অবিশ্বাস: বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এতগুলো নতুন ও সক্রিয় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, এমনকি অত্যাধুনিক অস্ত্র মোতায়েন, দুই দেশের মধ্যে সামরিক অবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি ‘সামরিক চাপের’ অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
২. ‘ঢাকা-ইসলামাবাদ-বেইজিং অক্ষ’ নিয়ে উদ্বেগ: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ভারতকে সতর্ক করেছে। প্রফেসর ইউনূসের মন্তব্য ‘সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের সমুদ্র প্রবেশাধিকার বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে’ এবং এটি চীনের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের কিছু সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং অনলাইন এক্টিভিস্টদের কিছু কিছু ভারতবিরোধী বক্তব্য ভারতের কৌশলগত উদ্বেগ বাড়িয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এ বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। চীনের সঙ্গে বিনিয়োগে নতুন করে ঘনিষ্ঠতা ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা। ভারতীয় গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিকে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন, যা শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলতে পারে।
৩. সংঘাতের ঝুঁকি: যদি চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত বা ডোকলামের মতো অচলাবস্থা তৈরি হয় এবং ভারত চিকেনস নেককে রক্ষা করতে চায়, তবে বাংলাদেশেরসীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল সামরিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে।
৪. বিকল্প পথের কৌশল: ভারত যদিও চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আগরতলায় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে চিকেনস নেকের একটি বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করছে, তবুও করিডরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের সামরিক কৌশলের মূল ভিত্তি। কালাদান প্রজেক্টের মাধ্যমে বিকল্প রুটের সম্ভাবনা আরাকান পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে অকার্যকর অবস্থায় আছে। এসব কৌশলগত পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটারের সামরিক পুনর্গঠন এবং চিকেন'স নেকের নিরাপত্তা জোরদার করার কৌশল স্পষ্টভাবে আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিফলন। শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য তার জাতীয় অখণ্ডতার প্রতীক এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের লাইফ লাইন হওয়ায় চীনের কৌশলগত চাপের মুখে এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা নয়াদিল্লির জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তবে এই সামরিকায়ন এবং বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি দ্রুত নতুন ঘাঁটি স্থাপন পারস্পরিক অবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে, তখন দিল্লির এই সামরিক প্রস্তুতিকে শুধু সীমান্ত সুরক্ষা নয়, বরং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তাই ভারতের সামরিক পুনর্গঠন তার নিজের কৌশলগত দুর্বলতা ঢাকার প্রচেষ্টা হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি একটি 'উদ্বেগের সতর্কবার্তা'। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা ও নয়াদিল্লি -- উভয় পক্ষের জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশল হবে এই অঞ্চলের সামরিকীকরণ না করে বরং আস্থা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিনির্ভর যৌথ নজরদারি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে এই সংবেদনশীল করিডোরকে কেন্দ্র করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।