সরকারকে তহবিল সরবরাহে একটি দ্বিদলীয় অর্থায়ন বিলে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘতম সরকারি অচলবাস্থার অবসান ঘটে। এই অচলাবস্থা চলেছিল টানা ৪৩ দিন।
ট্রাম্পের স্বাক্ষরের আগে বুধবার সন্ধ্যায় প্রতিনিধি পরিষদে ২২২-২০৯ ভোটে বিলটি পাস হয়। ছয়জন ডেমোক্র্যাট সদস্য রিপাবলিকানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিলটির পক্ষে ভোট দেন।
তার আগে গত সোমবার সেনেট সরকারের কার্যক্রম পুনরায় চালু করার জন্য বিলটি অনুমোদন করে। এরপর বিলটি প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত হয়। আর সবশেষে ট্রাম্প ওভাল অফিসে স্বাক্ষর করে সরকারের অচলবাস্থার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সরকারি দপ্তরগুলো পুনরায় খুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। থ্যাংকসগিভিং ছুটির আগে বিমান চলাচলও স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কর্মীসংকটের কারণে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন প্রশাসন আংশিক সেবা দিচ্ছিল। এতে কংগ্রেস সদস্যদেরও রাজধানীতে পৌঁছাতে সমস্যায় পড়তে হয়।
উইসকনসিনের রিপাবলিকান সদস্য ডেরিক ভ্যান অর্ডেন নিজের মোটরসাইকেলে প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে এসে ভোট দেন।
এই বিলের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ফেডারেল সংস্থাগুলোর অর্থায়ন পুনরায় চালু হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীদের বকেয়া বেতন প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
নতুন এই আইন অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ফেডারেল সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের অর্থায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে খাদ্য সহায়তা ও ভেটেরান বিষয়ক কর্মসূচির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সেপ্টেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত। প্রায় ১৪ লাখ কর্মচারীর বকেয়া বেতন দেওয়ার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছে।
বিলটি তাৎক্ষণিক সংকট কাটাতে সহায়ক হলেও স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি বৃদ্ধির দাবিতে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান উপেক্ষিত থাকে। এর ফলে ২ কোটি ৪০ লাখ নিম্নআয়ের মানুষের চিকিৎসা সহায়তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ডিসেম্বর মাসে।
দীর্ঘ এই অচলাবস্থার কারণ ছিল দলীয় বিভাজন ও স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে মতবিরোধ। শেষ পর্যন্ত আটজন সিনেট ডেমোক্র্যাট দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে বিলটির পক্ষে ভোট দেন। বিনিময়ে ডিসেম্বর মাসে স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি বৃদ্ধির বিষয়ে ভোটের প্রতিশ্রুতি পান তারা।
এই অবস্থান পরিবর্তনে ডেমোক্র্যাট দলে ক্ষোভ দেখা দেয়। প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যালঘু নেতা হাকিম জেফ্রিস এবং ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজম প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন।
সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার বলেন, ‘এই চুক্তি আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবা সংকট সমাধানে কার্যকর কিছুই করছে না।’
অন্যদিকে ভার্জিনিয়ার সিনেটর টিম কেইন, যিনি বিলের পক্ষে ভোট দেন, বলেন, ‘আমি যে ফেডারেল কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব করি, তারা সবাই এই সমঝোতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।’
শাটডাউনে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। অনেক সরকারি কর্মচারী, যাত্রী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন।
রিপাবলিকানরা একে ‘বড় বিজয়’ বলে দাবি করেছে, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা একে ‘আত্মসমর্পণ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
১৪ নভেম্বর থেকে ফেডারেল সংস্থাগুলো পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে। তবে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে।
অচলাবস্থা শুরু হয় ২০২৫ সালের ১ অক্টোবর। তার আগে ৩০ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নতুন অর্থবছরের বাজেট পাসে ব্যর্থ হয়। এটি ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকাকালে চতুর্থ শাটডাউন। এটি ২০১৮-২০১৯ সালের সীমান্তপ্রাচীর অর্থায়ন ইস্যুতে ৩৫ দিনের যে অচলাবস্থা হয়েছিল, সেটিকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মূল বিরোধের কেন্দ্র ছিল স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি বৃদ্ধি। ডেমোক্র্যাটরা ভর্তুকির মেয়াদ বাড়ানোর দাবি জানায়, অন্যদিকে রিপাবলিকানরা তা আলাদাভাবে আলোচনার প্রস্তাব দেয়।
সেনেটের ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত ব্যয় বিল ১৪ বার প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের প্রধান দাবি ছিল—স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি নবায়ন, যা ২ কোটি ৪০ লাখ নিম্নআয়ের নাগরিককে সহায়তা দেয়। এই ভর্তুকি বন্ধ হলে তাদের খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যেত। রিপাবলিকানরা বলেন, স্বাস্থ্যখাতের বিষয় আলাদাভাবে পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
অচলাবস্থার সময় ৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মচারী ছুটিতে ছিলেন এবং ৭ লাখ ৩০ হাজার বেতনহীনভাবে কাজ করেছেন। উৎপাদন ক্ষতি প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। প্রায় ২০ হাজার ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। জাতীয় উদ্যান ও জাদুঘরগুলো বন্ধ ছিল।
ট্রাম্প একে ‘অত্যন্ত বড় বিজয়’ বলে উল্লেখ করেন এবং ডেমোক্র্যাটদের দায়ী করেন। স্পিকার মাইক জনসন বলেন, এই শাটডাউন ‘অযৌক্তিক ও ক্ষতিকর’ ছিল।
সেনেট নেতা চাক শুমার স্বীকার করেন, ভর্তুকি ইস্যুতে তারা সমঝোতায় আসতে পারেননি।
ডেমোক্র্যাট নেতা হাকিম জেফরিস বিলটির বিরোধিতা করেন, একে ‘পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেন।
সমাধানের মূল দিকগুলো হলো— ২০২৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি ব্যয় চালু থাকবে। কর্মচারীদের বকেয়া বেতন প্রদান করা হবে। কিছু ফোন রেকর্ড সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়, সামরিক স্থাপনা এবং আইনসভা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর জন্য পূর্ণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
চুক্তিতে ডিসেম্বর মাসে স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি বাড়ানোর বিষয়ে ভোটের প্রতিশ্রুতিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ডেমোক্র্যাটদের প্রধান দাবি ছিল।
এই সমঝোতা সাময়িক স্বস্তি দিয়েছে, তবে বাজেট প্রক্রিয়ায় বড় সংস্কারের প্রয়োজন স্পষ্ট হয়েছে। ডিসেম্বরের ভর্তুকি বিতর্ক ও ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক উত্তেজনা আবার বাড়তে পারে। সরকার পুনরায় সচল হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অর্থনীতি ও জনগণের আস্থার ওপর রয়ে গেছে।