যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে সামরিক উত্তেজনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিমানবাহী রণতরী ও সহায়ক যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। ওয়াশিংটন এই পদক্ষেপকে মাদক পাচার, বিশেষ করে ভেনেজুয়েলীয় চক্রের মাধ্যমে ফেন্টানিল পাচার দমনের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।
এর জবাবে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো প্রায় দুই লাখ সেনা, অস্ত্র ও সরঞ্জামসহ ব্যাপক সামরিক মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে দেশজুড়ে সামরিক মহড়া শুরু হয়েছে। ভেনেজুয়েলা একে সম্ভাব্য মার্কিন হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখছে। বিশ্লেষকদের মতে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা কম হলেও, উভয় পক্ষের বক্তব্য ও পদক্ষেপে ভুল বোঝাবুঝি বা সীমিত আক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে।
পটভূমি
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলা সম্পর্ক টানাপোড়েনে রয়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, বিতর্কিত নির্বাচন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এই উত্তেজনা আরও গভীর করেছে। চলতি সংকটের সূত্রপাত ২০২৫ সালের শুরুতে, যখন ট্রাম্প প্রশাসন পশ্চিম গোলার্ধে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ কার্যক্রম জোরদার করে।
সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় সাগরে সন্দেহভাজন মাদকবাহী নৌযানের ওপর এক ডজনেরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে ৭৫ জনের বেশি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে বেসামরিক নাগরিকও রয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন, এসব অভিযান কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে, যা আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন তুলছে।
স্যাটেলাইট চিত্র ও উড্ডয়ন তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কার্যক্রম বেড়েছে। যুদ্ধজাহাজগুলো ২০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত গোলাবর্ষণ মহড়া চালিয়েছে। এদিকে, মাদুরো সরকার অভিযোগ করছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আগ্রাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ইরাক ও লিবিয়ার যুদ্ধের উদাহরণ টেনে জনগণকে সতর্ক করছে।
মার্কিন সামরিক উপস্থিতি
মার্কিন সামরিক প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড—নৌবাহিনীর সবচেয়ে আধুনিক ও বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী। এটি ১১ নভেম্বর ক্যারিবীয় সাগরে প্রবেশ করে পাঁচটি যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এ বহরটির সঙ্গে এখন সেখানে মোট আটটি যুদ্ধজাহাজ, ১৬ হাজার সেনা এবং একটি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন রয়েছে।
ইএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে আধুনিক ও বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী। ছবি: সিএনএন।এ ছাড়া পুয়ের্তো রিকো ও ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ঘাঁটি থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও বি-৫২ বোমারু বিমান টহল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এই মোতায়েন কেবল প্রতিরক্ষামূলক ও মাদকবিরোধী অভিযানের জন্য। তবে এত কাছাকাছি অবস্থান নেওয়ায় সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে জল্পনা বেড়েছে। পুয়ের্তো রিকোতে নতুন সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ভেনেজুয়েলার প্রতিক্রিয়া
১১ নভেম্বর টেলিভিশন ভাষণে ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ প্রায় দুই লাখ সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেন। এতে স্থল, নৌ, বিমান ও নগর ইউনিট অন্তর্ভুক্ত। পুরনো রুশ-নির্মিত এস-৩০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার ও গেরিলা কৌশল প্রয়োগের কথাও বলা হয়। ১২ নভেম্বর দেশব্যাপী সামরিক মহড়া শুরু হয়েছে, যেখানে অসম যুদ্ধ কৌশলে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ভেনেজুয়েলার সক্রিয় সেনা সংখ্যা আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ। দ্রুত জনবল বাড়াতে বাধ্যতামূলক সেনা নিয়োগ ও মিলিশিয়া একীকরণ চলছে। মাদুরো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে ‘পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ’ শুরু হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভেনেজুয়েলা প্রচলিত যুদ্ধ সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না, তবে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা প্রতিরোধ গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সম্ভাব্য প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, পূর্ণমাত্রার মার্কিন আগ্রাসনের আশঙ্কা কম। কারণ এতে আঞ্চলিক মিত্র ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার বিরোধিতা হতে পারে এবং ট্রাম্প প্রশাসন ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ এড়াতে চায়। তবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক হামলা বা পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই সংকট তেলবাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে। ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি (যদিও নিষেধাজ্ঞার আওতায়) বৈশ্বিক সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখে। কূটনৈতিকভাবে জাতিসংঘের মাধ্যমে মধ্যস্থতার কথা উঠলেও, উভয় পক্ষের কড়া ভাষায় পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।
আঞ্চলিক নেতারা ইতিমধ্যে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, ক্যারিবীয় অঞ্চল যেকোনো সংঘাতের বিস্তারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী মোতায়েন ও ভেনেজুয়েলার এই সামরিক প্রস্তুতি পশ্চিম গোলার্ধে এক নতুন নিরাপত্তা সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।