দক্ষিণের চমৎকার শহর উসুয়াইয়া এসে পৌঁছেছি। আর্জেন্টিনার শেষ প্রান্তে পৃথিবীর দক্ষিণতম এই শহরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যেন এক অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জগতে প্রবেশ করলাম। চারপাশে চোখ পৌঁছাচ্ছে না এমন বিস্তৃত দৃশ্য: পাহাড়, বরফ, সমুদ্র এবং সবুজের এক অনন্য মিশেল। শহরের আকাশ, নদী, পাহাড় এবং বন থেকে ভেসে আসা বাতাস সবকিছু যেন একসঙ্গে মিলেমিশে একধরনের সমারোহ তৈরি করছে।
আন্দিজ পর্বতের মাঝে উসুয়াইয়া শহর। ছবি: লেখকের সৌজন্যেএখানে বসন্তের ঋতু শুরু হলেও হিম বাতাসের মধ্যে এখনও শীতের স্পর্শ আছে। তবুও প্রতিটি বৃষ্টির পর, প্রতিটি হাওয়ার ঝাপটায় অনুভূত হয় নতুন জীবনের আগমন। রাস্তার পাশে থাকা ছোট ছোট বাগান, পাড়ার কোণে ফুটে থাকা বিভিন্ন রঙের ফুল এবং রঙিন পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ এক অদ্ভুত সংগীতের মতো। প্রকৃতি এখানে যেন জেগে উঠেছে নতুন সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে।
আন্দিজ পর্বতের মাঝে উসুয়াইয়া শহর। ছবি: লেখকের সৌজন্যেশহরটিতে পা রাখতেই বোঝা যায় যে উসুয়াইয়া শুধুই একটি শহর নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাসের অংশ। এটি টিয়েরা দেল ফুয়েগোর দ্বীপের অংশ এবং বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত শহর হিসেবে খ্যাত। এমন একটি অবস্থান যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতির মিলন ঘটে এক অনন্য রূপে। একসময় এখানে ‘যামানা’ আদিবাসীরা বাস করত।
উসুয়াইয়া শহরের মাঝে ‘মেইন স্কয়ার’। ছবি: লেখকের সৌজন্যেতাঁদের জীবন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁরা বরফজলে সাঁতার কাটত, নৌকায় ভেসে দিন পার করত এবং প্রকৃতির সঙ্গে এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি করেছিল। তাঁদের জীবনযাত্রার ছাপ এখনো শহরের কিছু নির্জন কোণে খুঁজে পাওয়া যায়। পরে স্প্যানিশ ও ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এই অঞ্চলে এসে ধীরে ধীরে এটি একটি বন্দরের শহরে রূপান্তরিত করেন।
উসুয়াইয়া শহরে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যেইতিহাসের পাতায় উসুয়াইয়া ছিল একসময়ের আর্জেন্টিনার কারাগারের শহর। সবচেয়ে কঠিন অপরাধীরা যাদের জন্য অন্যত্র জায়গা ছিল না, তাঁদেরকে এই শহরের জেলে রাখা হতো। আজ সেই পুরোনো জেলখানাটি একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে শহরের ইতিহাসের কঠিন অধ্যায়গুলো সংরক্ষিত রয়েছে।
উসুয়াইয়ার চারপাশে ছড়িয়ে আছে আন্দিজ পর্বতমালার দক্ষিণ প্রান্তের অনবদ্য দৃশ্য। এখানকার রাস্তা-ঘাট পরিপাটি, পাহাড়ঘেঁষা এবং সমুদ্রের পাশে গড়ে ওঠা বসতিগুলোতে রয়েছে একধরনের ছিমছাম সৌন্দর্য। শহরের আকাশ থেকে শুরু করে গ্লেসিয়ার পর্যন্ত চোখ যায়নি এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন। একদিকে বিস্তৃত বীগল চ্যানেল, অন্যদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বরফঢাকা গ্লেসিয়ার, প্রতিটি দৃশ্য যেন একটি প্রাণবন্ত চিত্রকলার মতো।
আন্দিজ পর্বত মালা এবং দক্ষিণ মহাসাগরের মাঝে। ছবি: লেখকের সৌজন্যেসাগরের নীল জলরাশি, পাহাড়ের সবুজ বুনো বন এবং বরফের সাদা চাদর এই সবকিছুর সংমিশ্রণ শহরের সৌন্দর্যকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। শহরের ছোট ছোট ঘরগুলোও যেন এই প্রকৃতির অপার মেলবন্ধন: রঙিন ছাদ, কাঠের বারান্দা, ছোট খাল এবং রাস্তার পাশে সাজানো ফুলের বাগান।
শহরের প্রতিটি কোণা যেন নিজের গল্প বলছে। নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, এখানে সময় একটু থেমে গেছে। শহরের ছোট্ট বন্দর, যেখানে মাছ ধরার নৌকা থেমে থাকে এবং মৎসজীবীরা দিনের পরিশ্রমের গল্প শোনায়, সেটিও শহরেরই অংশ। এখানকার মানুষের সহজ সরল জীবন, প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের সংযোগ, দৈনন্দিন কাজগুলো সবকিছু একধরনের শান্তি এবং সমৃদ্ধির অনুভূতি জাগায়।
বসন্তের ফুল। ছবি: লেখকের সৌজন্যেশহরে বসন্তের আগমন কিছুটা আলাদা। দক্ষিণের এই সীমান্তে বসন্ত মানে নতুন আলো, নতুন রং এবং নতুন জীবনের প্রতীক। যদিও হাওয়ার তীব্রতা এখনো কিছুটা শীতল, তবুও সূর্যের উষ্ণ আলো এবং ফুলের সুবাস চারপাশকে একটি নতুন আভা দিয়েছে। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুলের গন্ধ নিতে থাকলে মনে হয়, পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও বসন্তের এই আহ্বান মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। শহরের উদ্যান, ছোট ছোট গাছের ছায়া এবং রঙিন পাখির কোলাহল সবকিছুই জীবন্ত।
বসন্তের ফুল। ছবি: লেখকের সৌজন্যেউসুয়াইয়া সঙ্গে একটি আত্মিক বন্ধন তৈরি হয় খুব সহজে। এখানে শুধু দর্শক হয়ে থাকা যথেষ্ট নয়, শহরের প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি মুহূর্তকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। শহরের ইতিহাস, নৌকাগুলো, গ্লেসিয়ার, পাহাড়ের চূড়া সবকিছুর সঙ্গে মন গভীরভাবে সংযুক্ত হয়ে যায়। আমি যখন বীগল চ্যানেলের ধারে বসে থাকি, জলের নীরবতা, পাখির ডাক এবং হাওয়ার দমকা অনুভব করি, তখন মনে হয়, এই শহর আমার ভ্রমণের মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল আলোকচিহ্ন হয়ে থাকবে।
উসুয়াইয়া শহরে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত গরুর মাংসের রেস্টুরেন্ট। ছবি: লেখকের সৌজন্যেশহরের প্রতিটি কোণায় ইতিহাসের ছোঁয়া পাওয়া যায়। পুরনো কারাগার, প্রাথমিক বন্দর স্থাপনা, আদিবাসীদের বসতি—সবকিছু একধরনের নীরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এই জাদুঘরগুলো ঘুরে দেখলে শহরের অতীত জীবন্ত হয়ে ওঠে। এমনকি কিছু পুরনো চিহ্ন এখনও রাস্তার পাশে দেখা যায়, যা মনে করিয়ে দেয়, একসময় এখানে মানুষের জীবন কতটা কঠিন এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ ছিল। তবুও বর্তমান উশুয়া মানুষের জন্য শান্তি এবং আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু।
রাতের উসুয়াইয়া শহর। ছবি: লেখকের সৌজন্যেউসুয়াইয়া প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। পাহাড়, গ্লেসিয়ার, সমুদ্র, নদী এবং বনের সঙ্গে মানুষের বসতি সবকিছু যেন এক অপরিহার্য সংযোগে আবদ্ধ। আমি প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হই, শহরের বাতাস নিই, ফুলের গন্ধ শ্বাসের সঙ্গে মেশাই এবং পাখিদের গান শুনি। প্রতিটি দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতি এখানে জীবিত এবং মানুষের সংস্পর্শে আরও উজ্জ্বল। শহরের ছোট্ট বাগান, রাস্তার ধারে গাছের সারি এবং নদীর ধারে ঝুলন্ত নৌকা সবকিছু এক ধরণের শান্তি এবং স্থিরতা প্রকাশ করে।
আমাদের হোটেলের বারান্দা থেকে উসুয়াইয়া শহর। ছবি: লেখকের সৌজন্যেএখানে বসন্ত মানে শুধু ঋতুর পরিবর্তন নয়, এটি একটি নতুন যাত্রার সূচনা। প্রতিটি ফুলের পাপড়ি, প্রতিটি শাখায় বসা পাখি, প্রতিটি নদীর ঢেউ সবকিছু যেন নতুন জীবনের বার্তা দিচ্ছে। আমি যখন শহরের বাগানে বসে ফুলের সৌন্দর্য নেমে আসে, তখন মনে হয়, উসুয়াইয়া একটি অনুভব। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি পদচারণা সবকিছু এক ধরনের শান্তি এবং আনন্দের প্রতিফলন।
শহরের মানুষও এখানে স্বাভাবিক এবং বন্ধুসুলভ। তাঁরা সহজ সরল জীবনের মধ্যে সুখ খুঁজে পান। নৌকায় মাছ ধরার দৃশ্য, বাজারের ছোট ছোট দোকান, আমি বার বার আসতে চাই এই সুন্দর শহরে।