সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে আবারও ফিরে এসেছে অগ্নিসন্ত্রাসের এক ভয়াবহ চিত্র। প্রকাশ্য দিবালোকে গণপরিবহনে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ এবং ভাঙচুরের ঘটনা জনমনে তীব্র আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই নির্দেশ করে না, বরং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকেও এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে দেশ যখন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন এই সহিংসতা কার স্বার্থে এবং এর নেপথ্যে কারা—এই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
এই ধরনের অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। অতীতেও আমরা দেখেছি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যখন রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে নেমেছে, তখন হরতাল বা অবরোধকে কেন্দ্র করে যানবাহন পোড়ানো ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই আক্রমণকারী পক্ষ দায় অস্বীকার করেছে এবং একে অপরের ওপর দোষারোপের রাজনীতি চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিও এর ব্যতিক্রম নয়। অভিযোগের আঙুল সরাসরি উঠছে ক্ষমতাচ্যুত কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দিকে। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, তাদের নেতাকর্মীরাই এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয়, তবে প্রশ্ন জাগে—এই ধ্বংসাত্মক পথে হেঁটে তারা কী অর্জন করতে চায়? অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে, দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করে তারা কি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে পারবে? বাস্তবতা হলো, এই পথে গণসমর্থন আদায় বা রাজনৈতিক বিজয় অর্জন অসম্ভব। বরং এটি তাদের প্রতি জনগণের শেষ আস্থাটুকুও নষ্ট করে দেবে।
আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য হতে পারে কয়েকটি। প্রথমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি দুর্বল ও ব্যর্থ সরকার হিসেবে প্রমাণ করা। দ্বিতীয়ত, নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি যে এখনও অটুট, সেই বার্তা দেওয়া। এবং তৃতীয়ত, জনগণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে সরকারের প্রতি তাদের বীতশ্রদ্ধ করে তোলা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ইতিহাস এবং তার শাসনামলে বিরোধী মত দমনের যে চিত্র দেখা গেছে, তার ভিত্তিতে অনেকেই মনে করছেন, তার নির্দেশনাতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে এই সরল সমীকরণ দিয়ে পুরো পরিস্থিতিকে বিচার করা হয়তো সম্ভব নয়।
এর পেছনে আরও গভীর কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে কি না, সেই সন্দেহও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তৃতীয় কোনো পক্ষ কি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে? এমন কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তি কি নেপথ্যে কাজ করছে, যাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে প্রলম্বিত বা বাতিল করা? এই অপশক্তি সরকারের ভেতরে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। তাদের প্রধান লক্ষ্য, একটি গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা। নির্বাচন যদি সময়মতো না হয়, তবে একটি অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা দখলের সুযোগ পেয়ে যাবে, যা দেশকে আবারও দীর্ঘমেয়াদী সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।
এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর পদক্ষেপের কথা বললেও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। গ্রামীণফোনের মতো করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের সামনেও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা তাদের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকারের উপদেষ্টাদের কর্মকাণ্ড মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক এবং তৃণমূল বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটি বড় ঘাটতি দৃশ্যমান। ফলে জনগণ সরকারের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারছে না, সেই প্রশ্নও উঠছে। সরকারের এই দুর্বলতা বা নিষ্ক্রিয়তা সন্ত্রাসীদের আরও উৎসাহিত করছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য দূর করে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আমরা দেখছি, তার মূল কারণ রাজনৈতিক অনৈক্য। এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়েই অশুভ শক্তিগুলো মাঠে নামার সাহস পাচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআরের পাশাপাশি সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকেও রাজপথে থেকে এই সন্ত্রাস প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে। এটি শুধু সরকারের নয়, বরং সকল নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত দায়িত্ব।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণ করা, যেখানে মানুষ নির্ভয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। কিন্তু বর্তমানের এই অগ্নিসন্ত্রাস সেই লক্ষ্যকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। যদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা না যায়, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা আবারও বহু বছর পিছিয়ে যাব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে। নির্বাচন ব্যাহত হলে বিদেশি অনুদান ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অতএব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন প্রধান দায়িত্ব হলো, যেকোনো মূল্যে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। সন্দেহের চোখে না দেখে, সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে হবে। যারা এই অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তারা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। একইসঙ্গে, আওয়ামী লীগের মতো বড় একটি রাজনৈতিক দলকে সহিংসতার পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পথে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানাতে হবে।
দিনশেষে, বাসে পুড়ে যাওয়া প্রতিটি আসন কেবল একটি বস্তু নয়, এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দগ্ধ প্রতিচ্ছবি। এই আগুন নেভানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের। জাতীয় ঐক্য, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে বাংলাদেশকে এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক