leadT1ad

মামদানির বড় বাজি

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ৪৩
স্ট্রিম গ্রাফিক

নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির বিজয়ে সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের উল্লসিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই জয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, আজকের জনতুষ্টিবাদী ডানপন্থার (পপুলিস্ট রাইটউইং) হাতেই শুধু জনতাকে সংঘবদ্ধ করার কিংবা নতুন ভোটারদের আকর্ষণ করার একচেটিয়া ক্ষমতা নেই। ডেমোক্রেটিক সোশালিস্টও (গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী) যে তা পারে, এই জয় তারই প্রমাণ।

কিন্তু মামদানি বিলক্ষণ জানেন, তাঁর এই বিজয়কে স্বাগত জানানো হবে অর্থনৈতিক ও ফাইনানশিয়াল অন্তর্ঘাতের নীলনকশা দিয়ে। আমেরিকার রাজনৈতিক প্রধান দুই দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক—উভয় দলের ‘ডিপ স্টেট’ মামদানির মেয়র পদকে যেকোনো মূল্যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে আগ্রহী। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির হওয়া সত্ত্বেও নিউইয়র্কের ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন মামদানির প্রধান প্রতিপক্ষ নিউইয়র্কের সাবেক ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য।

এটা সহজেই অনুমেয়, মামদানি ক্ষমতায় আসায় ট্রাম্পপন্থী জনতুষ্টিবাদী আর মূলধারার ডেমোক্র্যাটরা হঠাৎ করেই একই সুরে কথা বলতে শুরু করবে। মামদানিকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে তারা সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে, এর মধ্যে ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর জন্য আরও একবার ‘জরুরি অবস্থা’ জারির মতো ঘটনাও থাকতে পারে।

সুতরাং বামপন্থীদের জন্য এটা শুধু সক্রিয় হওয়ার মুহূর্ত নয়, বরং বৃহত্তর প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবারও সময়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন দুই-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে চারটি ভিন্ন গোষ্ঠীর এক জটিল সমীকরণে রূপ নিচ্ছে—প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকান, প্রতিষ্ঠিত ডেমোক্র্যাট, উগ্র-ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী ও ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট। পুরোনো বিভাজনরেখা মুছে দিয়ে নতুন জোটের সম্ভাবনাও এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ২০২০ সালে জো বাইডেন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি একজন মধ্যপন্থী রিপাবলিকানকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করতে পারেন।

অন্যদিকে, ট্রাম্পের সাবেক প্রধান রণনীতিকার স্টিভ ব্যানন, ডেমোক্রেটিক পার্টি বাইডেনকে মনোনয়ন দেওয়ার পর বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থকদের ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার জন্য উস্কানি দিয়েছিলেন।

কিন্তু বড় পার্থক্যটা হলো, ট্রাম্পের জনতুষ্টিবাদ যেখানে রিপাবলিকান প্রাতিষ্ঠানিকতার ওপর সহজেই নিজের আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিল (যা প্রমাণ করে সাধারণ শ্রমিকের জন্য ট্রাম্পের উদ্বেগ আসলে নির্জলা ভড়ং), সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরীণ বিভাজন দিনে দিনে আরও গভীর হচ্ছে। বস্তুত, ডেমোক্রেটিক প্রাতিষ্ঠানিকতা আর স্যান্ডার্স শিবিরের মধ্যকার এই লড়াই-ই আজ আমেরিকার একমাত্র প্রকৃত রাজনৈতিক সংগ্রাম। যেমনটা দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এমা ব্রোকস বলেছেন: ‘মামদানির সবচেয়ে বড় হুমকি ডোনাল্ড ট্রাম্প নন, বরং ডেমোক্রেটিক পার্টির পুরোনো নেতৃত্ব।’

আমরা এখানে দুটি ভিন্নধর্মী দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হচ্ছি: একটি হলো ট্রাম্প ও উদারপন্থী প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে, এবং অন্যটি হলো ডেমোক্রেটিক পার্টির স্যান্ডার্স শিবির ও বাকি সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া ছিল প্রাতিষ্ঠানিকতার নৈতিক নেতৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের এক মরিয়া প্রচেষ্টা। কিন্তু পুরো ব্যাপারটিই পরিণত হয়েছিল ভণ্ডামিপূর্ণ প্রহসনে, কারণ প্রাতিষ্ঠানিকতার নিজের দুর্বলতাগুলোও ততদিনে প্রকাশ্যে এসে গেছে। ট্রাম্পের প্রকাশ্য ঔদ্ধত্য, ক্ষমতার অপব্যবহার কেবল আগে থেকেই পর্দার আড়ালে বিদ্যমান সত্যকেই সামনে এনেছিল।

স্যান্ডার্সের শিবির এই বাস্তবতা পরিষ্কার বুঝতে পারে। তারা জানে যে পেছনে ফেরার কোনো পথ নেই, আমেরিকার রাজনৈতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। মামদানি জিতেছেন, কারণ বামপন্থীদের জন্য তিনি ঠিক সেই কাজটিই করেছেন, যা ডানপন্থীদের জন্য করেছিলেন ট্রাম্প। মামদানি মধ্যপন্থা হারানোর ভয় না পেয়ে তিনি তাঁর র‍্যাডিক্যাল অবস্থানকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।

তবে মার্কিন রাজনীতিতে বর্তমানে বিদ্যমান এই চারটি শক্তি একই সমতলে নেই। দুটি মৃতপ্রায় দল (পুরোনো রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট) স্থবিরতার ফাঁদে আটকা পড়েছে, দেশের জন্য তাদের কোনো গভীর দর্শন নেই। অন্যদিকে, ট্রাম্পপন্থী জনতুষ্টিবাদী ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টরা সত্যিকারের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই প্রেক্ষাপটে, একমাত্র অর্থবহ নির্বাচন হতে পারে ট্রাম্প ও একজন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টের মধ্যে।

তাহলে কি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টদের আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত? আমার পরামর্শ হবে একটি নীতিগত বাস্তববাদ অনুসরণ করা: অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য কেন্দ্রীয় লক্ষ্যগুলোর ওপর মনোযোগ দিন, এবং সেই লক্ষ্য পূরণে যা কিছু সম্ভাবনাময় মনে হবে, তার সবটাকেই গ্রহণ করুন। এর মানে হলো, যখন নির্বাচনী গণতন্ত্র কাজ করে, তখন তাকে আলিঙ্গন করা, কিন্তু পরিস্থিতি দাবি করলে গণসংগঠন বা আরও র‍্যাডিকাল পদ্ধতিতেও এগিয়ে যাওয়া।

আমার কথার অর্থ স্পষ্ট করতে একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ টানা যাক। জুলাই মাসে, ট্রাম্পের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে সম্পর্কচ্ছেদের পর ইলোন মাস্ক ঘোষণা করেন, তিনি ‘আমেরিকা পার্টি’ নামে একটি দল চালু করবেন। জন্মসূত্রে মার্কিনি নন বলে ইলোন মাস্ক কখনো প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে পারবেন না। মাস্ক জনতুষ্টিবাদকে ছাপিয়ে এক ধরনের প্রযুক্তি-সামন্ততন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিয়ে ট্রাম্পকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখেনি।

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে জারা সুলতানা ও জেরেমি করবিনের নতুন বামপন্থী দলটি বেশ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিছু জরিপে দেখা গেছে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তরুণ ও লেবার ভোটাররা এই নতুন দলের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত। যদিও দলটি নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে এবং বামপন্থী দলের চরিত্র অনুযায়ী, দুই নেতা শুরুতেই এক প্রকাশ্য বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন।

যুক্তরাজ্যে সত্যিকারের অর্থবহ নির্বাচন হতে পারে নাইজেল ফারাজের উগ্র-ডানপন্থী রিফর্ম ইউকে ও এই নতুন বামপন্থীদের মধ্যে। এর মধ্য দিয়ে স্থবির লেবার পার্টি অদ্ভুতভাবে মৃতপ্রায় কনজারভেটিভদের সঙ্গে প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাবে। এটা ঠিক যে, এমন এক সরাসরি সংঘাতে উগ্র-ডানপন্থী ফারাজই জিতবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, যেমনটা ২০১৯ সালে করবিনকে হারিয়েছিলেন বরিস জনসন। তা সত্ত্বেও, করবিন কিছু সময়ের জন্য লেবার পার্টির নিয়ন্ত্রণ নিতে সফল হয়েছিলেন এবং গোটা প্রাতিষ্ঠানিকতাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত সেরা কৌশল কী হবে, তার কোনো বাঁধাধরা নীতিগত উত্তর নেই। কখনও কখনও ভেতর থেকেই বড় দলকে দখল করার চেষ্টা করতে হয়; কখনও বা বেরিয়ে আসা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আমি মনে করি, মামদানি আপাতত ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরে থেকে ঠিকই করেছেন, এর ফলে তিনি দলের সাধারণ সমর্থকদের প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করার সুযোগ পাবেন। এর বিপরীতে মামদানি যদি একাই বাকি তিনটি রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করতে যেতেন, তবে তাঁর পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী।

এখন যেহেতু তিনি জিতেছেন, মামদানির উচিত দৃঢ় ও সুচিন্তিত পদক্ষেপে নিউ ইয়র্ক স্টেট ডেমোক্রেটিক পার্টিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা। একইসঙ্গে, আমেরিকার ডেমোক্রেটিক সোশালিস্টদের সঙ্গে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি স্যান্ডার্সের পরামর্শ অনুসরণ করে, ট্রাম্পকে ভোট দেওয়া হতাশ নিম্ন-আয়ের কর্মী ও কৃষকদের কাছে সূক্ষ্মভাবে পৌঁছাতে হবে। মামদানি যে প্রকল্পের প্রতীক, তার ভবিষ্যৎ মধ্যপন্থা আঁকড়ে ধরে থাকার ওপর নির্ভর করছে না, বরং ট্রাম্পের শিবির থেকে মোহভঙ্গ হওয়া ভোটারদের নিজের দিকে টেনে আনার ওপর।

কেবল একজন র‍্যাডিকাল বামপন্থীই পারে ট্রাম্পের কর্মজীবী শ্রেণির সমর্থকদের মন জয় করতে।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত স্লাভো জিজেকের মতামত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত