leadT1ad

সাক্ষাৎকারে হোসেন জিল্লুর রহমান

সংকট সামলেছে, কিন্তু আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

হোসেন জিল্লুর রহমান; বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর অতিক্রম, এই সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি-সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে ঢাকা স্ট্রিম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ৫০
হোসেন জিল্লুর রহমান। সংগৃহীত ছবি

এই সাক্ষাৎকারে হোসেন জিল্লুর রহমান সরকারের পথচলার তিনটি অধ্যায়—সংকট মোকাবিলা, জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং উত্তরণের চ্যালেঞ্জ—বিশ্লেষণ করেছেন। সরকারের সাফল্য, বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমলানির্ভরতা, রাজনৈতিক সাহসের অভাব এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার মতো মৌলিক ত্রুটিগুলো তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর পর্যালোচনায় উঠে এসেছে বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জসমূহও। নিচে সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হলো:

স্ট্রিম: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। এই সরকারকে ঘিরে যে রাষ্ট্রীয় সংকট ও জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে কথা বলতে গেলে এর তিনটি দিক বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রথমত, এই সরকারের উদ্ভবটি আসলে মানুষের প্রত্যাশা থেকে শুরু হয়নি, বরং এক ধরনের তাৎক্ষণিক রাষ্ট্রীয় সংকট থেকে শুরু হয়েছিল। কারণ, যেভাবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছিল তখন রাষ্ট্র ছিল এক গভীর সংকটে। প্রশ্ন ছিল—সরকার গঠন কিভাবে হবে, প্রতিবেশী দেশের ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে, তারা এই পরিবর্তনে কী ভূমিকা নেবে, এবং বিশ্বের সঙ্গে কীভাবে দ্রুত একটি কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। অর্থাৎ শুরুতেই বিষয়টা ছিল রাষ্ট্রীয় সংকট মোকাবিলার, যেখানে একদিকে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি, অন্যদিকে সরাসরি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পাশাপাশি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও ছিল।

অর্থনীতির সূচকগুলো—যেমন ডলার ও টাকার বিনিময় হার, রিজার্ভ—অত্যন্ত অনিশ্চিত অবস্থায় ছিল। আস্থার সংকট যেন সংক্রামক হয়ে না ওঠে, সেটি সামাল দেওয়াও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ প্রথম অধ্যায়টি ছিল টিকে থাকার অধ্যায়—ভূরাজনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার অধ্যায়। এই ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সক্ষম হয়েছিল। এর ফলেই আজ আমরা এক বছর পরেও তাদের নিয়ে আলোচনা করছি। না হলে শুরুতেই হয়তো সরকার অচল হয়ে যেত।

স্ট্রিম: আপনি এই সময়কালকে কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম অধ্যায় বা টিকে থাকার পর্বের পর সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ কী ছিল?

হোসেন জিল্লুর রহমান: আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলো, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ সংকট সামাল দেওয়া গেল, আর তখন থেকে শুরু হলো দ্বিতীয় অধ্যায়। এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূল প্রশ্ন ছিল—মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ। জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনের পর জনগণের মনে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, গণতন্ত্রের চাহিদা, দুর্নীতি থেকে মুক্তি, কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এবং রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় সংস্কারের দাবি—এসবই সামনে আসে। তরুণ, নারী, উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষের নানা স্তরের চাহিদা কীভাবে পূরণ করা যাবে, সেই পথ নির্ধারণ করাই ছিল সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায়। এই অধ্যায়কে বলা যায় আকাঙ্ক্ষার অধ্যায়। এখানে মূলত রাজনৈতিক ঝুঁকি নয়, মানুষের চাহিদা পূরণ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। সংস্কারের ধারণা সমাজে আলোচিত ও আলোড়িত হয়েছে, এটি একধরনের সাফল্য।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিতীয় বড় ধরনের ত্রুটি ছিল তাদের অতিরিক্ত আমলা-নির্ভরতা। তারা কার্যত আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক শাসনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। এখানে অবশ্য একটা পার্থক্য স্পষ্ট করা দরকার—আমলাতন্ত্র এবং আমলাতান্ত্রিক শাসন এক নয়। আমলাতন্ত্রকে যদি সঠিকভাবে পরিচালিত করা যায়, তাহলে তারা অনেক কিছু ডেলিভার করতে পারে।

স্ট্রিম: তাহলে আকাঙ্ক্ষার অধ্যায় থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের করণীয় কী ছিল বা আছে বলে আপনি মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে তৃতীয় অধ্যায়ে উত্তরণও জরুরি। আমি তৃতীয় অধ্যায়কে বলবো উত্তরণের অধ্যায়। প্রথম অধ্যায় ছিল টিকে থাকা, দ্বিতীয় অধ্যায় ছিল আকাঙ্ক্ষার পূর্বশর্ত তৈরি, আর তৃতীয় অধ্যায় হবে আসল অর্থে উন্নতির বা উত্তরণের অধ্যায়।

স্ট্রিম: সরকারের এক বছরের কার্যক্রম মূল্যায়নে কোনো মৌলিক ত্রুটি কি আপনার চোখে পড়েছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: হ্যাঁ, এক বছরের মাথায় কিছু মৌলিক ত্রুটিও চোখে পড়েছে। প্রথমত, কর্মপন্থায় দুর্বলতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় শক্তি হলো কার্যকর কোয়ালিশন—সরকারি স্তরের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলের সমন্বয়। কিন্তু সেই রাজনৈতিক কাজটিতে ঘাটতি ছিল। হাতে অনেক কাজ নেয়া হলেও সেগুলোর গতি বা অগ্রগতি প্রত্যাশিতভাবে সামনে আসেনি। আজ প্রশ্ন হচ্ছে—এই এক বছরে আসলে কতটুকু এগোনো গেছে।

এর মধ্যে বিশেষভাবে দুটি ত্রুটি স্পষ্ট। প্রথমটি হচ্ছে অতিরিক্ত এজেন্ডা হাতে নেওয়া। যে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি প্রয়োজন ছিল, সেটি অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একসঙ্গে অনেকগুলো এজেন্ডা খোলা হয়েছে। ফলে সুপরিকল্পিতভাবে এগোনোর পরিবর্তে কিছুটা গন্তব্যহীন অবস্থা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ এজেন্ডার আধিক্য দেখা গেলেও তা যথেষ্ট সুচিন্তিত ছিল না।

স্ট্রিম: কর্মপন্থার দুর্বলতার কথা বলছিলেন। দ্বিতীয় কোনো বড় ত্রুটি কি ছিল?

হোসেন জিল্লুর রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিতীয় বড় ধরনের ত্রুটি ছিল তাদের অতিরিক্ত আমলা-নির্ভরতা। তারা কার্যত আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক শাসনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। এখানে অবশ্য একটা পার্থক্য স্পষ্ট করা দরকার—আমলাতন্ত্র এবং আমলাতান্ত্রিক শাসন এক নয়। আমলাতন্ত্রকে যদি সঠিকভাবে পরিচালিত করা যায়, তাহলে তারা অনেক কিছু ডেলিভার করতে পারে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক শাসন মানে হলো আমলারাই রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে—তারা এজেন্ডা লিখছে, নোট লিখছে, মিনিট তৈরি করছে, অগ্রগতি কেমন হবে সেটির ব্যাখ্যাও তারাই দিচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বিতীয় এই ত্রুটির মধ্যে পড়ে গেল। তারা অতিমাত্রায় আমলা-নির্ভর হয়ে গেলেন। এই দুটি বড় ধরনের ত্রুটি—একদিকে অতিরিক্ত এজেন্ডা নেওয়া, অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক শাসনের উপর নির্ভরতা—যখন একসাথে প্রকাশ পেতে শুরু করল, তখন পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিল।

স্ট্রিম: এই ত্রুটিগুলোর প্রভাব সাধারণ মানুষ বা অন্যান্য প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যে কীভাবে পড়ল?

হোসেন জিল্লুর রহমান: আমি বলব ডিসেম্বরের পর থেকে, বিশেষ করে জানুয়ারি ২০২৫-এর শুরু থেকেই, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ধীরে ধীরে এই সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে শুরু করে। জুলাই-আগস্টের পরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষ, প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও বিভিন্ন শ্রেণির এক্টররা শুরুতে এক ধরনের মানিয়ে নেওয়ার মনোভাব দেখিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, পরিবর্তন হলে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু ডিসেম্বর আসার পর ধীরে ধীরে তারা বুঝে গেল যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার একটি বড় ঘাটতি আছে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি আবার ‘ব্যাক টু নরমাল’ ধাঁচে ফিরে গেল।

যদি আমরা দুর্নীতির প্রসঙ্গ দেখি, তাহলে বোঝা যায়—দৃশ্যমান দুর্নীতির অনেক কিছু কমেছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিটি খাতেই রয়ে গেছে। এমনকি অনেক খাতে বলা যায় যে তা আগের মতোই আছে বা কিছু ক্ষেত্রে আরও গভীর হয়েছে।

স্ট্রিম: সক্ষমতার ঘাটতির পাশাপাশি সরকারের আর কোন দুর্বলতা আপনি চিহ্নিত করবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ২০২৫ এ এসে এই ত্রুটিগুলোর সাথে যখন মানুষের সামনে সরকারের সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতার ঘাটতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, তখন আরেকটি ঘাটতি ধরা পড়ল—সেটি হলো রাজনৈতিক সাহসের অভাব। সাহস বলতে বোঝাচ্ছি—তারা অনেক বেশি এজেন্ডা সামনে এনেছেন, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে রাজনৈতিক সাহস প্রয়োজন ছিল, সেটি দেখাতে পারেননি। আজকে বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালিয়ে যাচ্ছেন, চেষ্টা করছেন, এটিতে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু কেবল ‘চেষ্টা করছেন’ এই বাক্য দিয়ে জনগণকে আর সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না। যখন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী গোষ্ঠীগুলো মূল্যায়ন করল, তখন তারা দেখল সরকারের সক্ষমতার একটি সীমা আছে। এর ফলে সরকারের নিয়ন্ত্রণও প্রত্যাশিতভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারল না।

সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো জাতীয় ঐক্য সংহত করার ক্ষেত্রে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিল জাতীয় ঐক্যকে সংহত করা, বিভক্ত রাজনৈতিক অঙ্গনকে অন্তত আংশিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, তারা সময় পার করেছেন বটে, কিন্তু জাতীয় ঐক্যকে সংহত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং নতুন নতুন প্রশ্ন ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। ফলে আজ জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন আরও বেশি অস্থির এবং অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।

স্ট্রিম: এই পরিস্থিতিতে 'কোর্স কারেকশন' বা চলার পথে নীতি সংশোধনের কোনো সুযোগ ছিল কি? সরকার কি সেই পথে হেঁটেছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোর্স কারেকশন বা চলার পথে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা। একটি সফল ও সক্ষম রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সময়মতো সুচিন্তিত কোর্স কারেকশন করা। যখন দেখা যায় বাস্তব অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কিছু পরিবর্তন দরকার, তখন সেটি করার মানসিকতা থাকতে হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভেতরে এক ধরনের একগুঁয়েমি মনোভাব সামনে এসেছে। তারা প্রায় ঘোষণা করে দিয়েছে—যা চলছে তাই চলবে, কোনো ধরনের কোর্স কারেকশন করা হবে না। এর ফলেই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

স্ট্রিম: নির্বাচন প্রসঙ্গটি এখন বেশ আলোচিত। এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখছেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: এর একটি উদাহরণ হলো নির্বাচন প্রসঙ্গ। নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, একটি বড় সিগন্যাল। এটি কখন হবে, কবে ঘোষণা করা হবে এবং কতটা বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে ঘোষণা করা হবে—এসবের প্রতিটি দিক জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দুই বছর পরেও যদি নির্বাচন হয়, সেটির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকলে মানুষ সেটি মেনে নিত। কিন্তু স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় নির্বাচন প্রসঙ্গটি জনগণের কাছে আরও সন্দেহজনক ও চাপের বিষয় হয়ে উঠেছে। এর প্রস্তুতি কাজ কিছুটা হলেও হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

স্ট্রিম: সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক ছিল বলে আপনি মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: এখন যদি আমরা সংস্কারের দিক দেখি, দেখা যায় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মনোযোগ ব্যয় করেছেন সাংবিধানিক সংস্কারে। কিন্তু এ নিয়ে তারা জনগণের সাথে কথা বলেননি। অথচ জনগণের আসল চাহিদা হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার—যেখানে দুর্নীতি রোধ, অর্থনীতিকে সচল করা, উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এসবের ওপর গুরুত্ব দিতে হয়। নিঃসন্দেহে কিছু উদ্যোগ হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে কিছু সংস্কার হয়েছে, প্রকিউরমেন্ট নিয়ে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সংস্কারেরও আশা আছে। এগুলো খারাপ নয়, বরং কিছু ভালো কাজ হয়েছে। তবে সামগ্রিক চিত্রে দেখা যাচ্ছে সাংবিধানিক সংস্কারকেই অতিরিক্ত প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটির দিকনির্দেশনা স্পষ্ট নয়।

স্ট্রিম: সরকারের অন্যতম একটি দায়িত্ব ছিল জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে তারা কতটা সফল?

হোসেন জিল্লুর রহমান: সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো জাতীয় ঐক্য সংহত করার ক্ষেত্রে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিল জাতীয় ঐক্যকে সংহত করা, বিভক্ত রাজনৈতিক অঙ্গনকে অন্তত আংশিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, তারা সময় পার করেছেন বটে, কিন্তু জাতীয় ঐক্যকে সংহত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং নতুন নতুন প্রশ্ন ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। ফলে আজ জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন আরও বেশি অস্থির এবং অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।

স্ট্রিম: এই বিভক্তির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কতটুকু? তাদের কার্যক্রমে আপনি কী দেখছেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের পক্ষ থাকতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকা দরকার, কারণ একটি প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য প্রতিযোগিতাপূর্ণ রাজনীতি অপরিহার্য। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি সুস্থ এবং আশাপ্রদ রাজনৈতিক মাঠ তৈরি করছে না, বরং উত্তরণের পথে এক ধরনের অন্ধকার রেখা টেনে দিচ্ছে। আমরা দেখছি, নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। আর এই মুখোমুখি অবস্থান মূলত নির্বাচনের নিয়মাবলী নিয়েই। অর্থাৎ মৌলিক বিষয় নিয়েই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। তাদের দুর্বল সিগন্যালিং ও দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতিই এই মুখোমুখি অবস্থানকে ত্বরান্বিত করেছে।

আমার মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মূল কাজ ছিল জনগণের সামনে দুটি বিষয় স্পষ্ট করা। প্রথমত, নির্বাচনের নিয়মাবলী ও রাজনৈতিক মাঠের কাঠামো কী হবে, সে সম্পর্কে একটি গ্রহণযোগ্য ঐকমত্যে আসা। দ্বিতীয়ত, কী ধরনের সমাজ ও অর্থনীতি আমরা চাই, তার একটি পরিষ্কার রূপরেখা জনগণকে দেওয়া। কিন্তু সেটি তারা করতে পারেনি। বরং শুরু থেকেই তারা প্রভাববলয় তৈরির দিকে ঝুঁকে গেছে।

যদি রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে অনড় ও অসহিষ্ণু থাকে, তবে তা কোনো নৈতিক অবস্থান হবে না। যদি একদিকে নৈতিক শক্তি আর অন্যদিকে অনৈতিক শক্তি মুখোমুখি হতো, তবে জনগণ নৈতিক শক্তির পক্ষে দাঁড়াত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এটি নৈতিক বনাম অনৈতিক শক্তির লড়াই নয়, বরং প্রতিপক্ষ প্রভাববলয়ের লড়াই। এটি আসলে ক্ষমতার লড়াই—ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই।

স্ট্রিম: এই 'প্রভাববলয় তৈরির সংস্কৃতি' বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির অর্থ হলো, আমি জনগণের সামনে নিজেকে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করব, আমার উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়াগুলো বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরব। কিন্তু তারা সেটি না করে শুরু থেকেই নানা পর্যায়ে প্রভাববলয় তৈরি করতে মনোযোগ দিয়েছে। প্রশাসনিক যন্ত্রে প্রভাব বিস্তার, কিংবা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এতে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে এবং সুষ্ঠুভাবে এগোনোর পথে বাধা তৈরি হয়েছে।

আরেকটি দিক হলো—যেসব কারণে শেখ হাসিনার সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলো তার থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। সেই সরকারের দুর্বলতা ছিল প্রতিপক্ষকে হেয় করা, দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া, অনৈতিক আপস ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোট গড়ে তোলা, এবং কর্মীদের অবমূল্যায়ন করা। জনগণ এসব বিষয় বোঝে। অথচ নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোও একই ধরণের প্রভাববলয়-কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়েছে।

স্ট্রিম: রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে কোনো ইতিবাচক দিক কি আপনার চোখে পড়েছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: হ্যাঁ, ইতিবাচক দিকও আছে। সংস্কার আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত অংশ নিয়েছে, জড়িত থেকেছে। যদিও সেটি অনেকটাই আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে—এক্সেল শিটে প্রস্তাব টিক চিহ্ন দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ধাঁচে—তবুও বলা যায় তারা আলোচনার সংগ্রামে ছিল, সেটি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

স্ট্রিম: সবশেষে, রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান মুখোমুখি অবস্থানকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? এটি কি আদর্শিক লড়াই?

হোসেন জিল্লুর রহমান: শেষ বিচারে এটি যথেষ্ট নয়। কারণ যদি রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে অনড় ও অসহিষ্ণু থাকে, তবে তা কোনো নৈতিক অবস্থান হবে না। যদি একদিকে নৈতিক শক্তি আর অন্যদিকে অনৈতিক শক্তি মুখোমুখি হতো, তবে জনগণ নৈতিক শক্তির পক্ষে দাঁড়াত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এটি নৈতিক বনাম অনৈতিক শক্তির লড়াই নয়, বরং প্রতিপক্ষ প্রভাববলয়ের লড়াই। এটি আসলে ক্ষমতার লড়াই—ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই। রাজনৈতিক ভাষ্য ও বয়ানগুলো কতটুকু দলগুলো নিজেরাই বিশ্বাস করে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নতুন নতুন বিষয় সামনে আসছে, কিন্তু সেগুলো আসলেই সুচিন্তিত কি না, নাকি কেবল রাজনৈতিক মুখোমুখি অবস্থানকে উসকে দেওয়ার জন্য—এ প্রশ্নও তোলা হচ্ছে।

স্ট্রিম: আপনাকে ধন্যবাদ, আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।

হোসেন জিল্লুর রহমান: ধন্যবাদ ঢাকা স্ট্রিমকে এবং ঢাকা স্ট্রিমের পাঠকদেরও।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

Ad 300x250

সম্পর্কিত