leadT1ad

কর্মবিরতি, আদেশ অমান্যে বরখাস্তের বিধান রেখে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি

কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মতে, এই অধ্যাদেশের ফলে কর্মচারীরা অফিসে ঊর্ধ্বতনদের অন্যায় বা অবৈধ আদেশও মানতে বাধ্য হবেন।

মো. ইসতিয়াক
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৭: ১৫
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৫৮
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সংগৃহীত

গতকাল রাতে ‘সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে কেউ যদি যৌক্তিক কারণ ছাড়া এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে কর্মবিরতিতে যান বা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন; অথবা অন্য কর্মচারীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বরখাস্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।

গতকাল বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করা এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়, যা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়েছে। নতুন অধ্যাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আরও নির্দিষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ করা হয়েছে।

তবে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মতে, এই অধ্যাদেষের ফলে কর্মচারীরা অফিসে ঊর্ধ্বতনদের অন্যায় বা অবৈধ আদেশও মানতে বাধ্য হবেন।

এর আগে চলতি বছরের মে মাসে করা খসড়া অধ্যাদেশে ‘অনানুগত্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ায় তা নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এবার ‘অনানুগত্য’ শব্দটির পরিবর্তে ‘সরকারি কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অসদাচরণ’ হিসেবে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

আইনের ৩৭ (ক) ধারার ভাষা কিছুটা আপেক্ষিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক। “বৈধ আদেশ” অমান্য করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে, কিন্তু “বৈধতা” নির্ধারণ করবে কে? অনেক সময় এমন কিছু আদেশ থাকে, যা টেকনিক্যালি বা নীতিগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তা উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের “ইচ্ছা” হিসেবেই নিচু পর্যায়ের কর্মচারীদের সামনে আসে। এখন যদি কেউ তার পেশাগত বিবেচনায় প্রশ্ন তোলে বা বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটায়, তাহলে সেটিও কি অপরাধ হবে? তানজিবুল আলম, আইনজীবী ও প্রশাসনিক আইন বিশ্লেষক

নতুন অধ্যাদেশে কী বলা হয়েছে

নতুন অধ্যাদেশের ৩৭ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী প্রথমত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য করেন, কিংবা আইনসংগত কারণ ছাড়া সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র বা নির্দেশনার বাস্তবায়নে বাধা দেন বা বিরোধিতা করেন; দ্বিতীয়ত, যৌক্তিক কারণ ছাড়া এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে কর্মবিরতিতে যান বা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন; অথবা তৃতীয়ত, অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে বাধা দেন–তাহলে এসব আচরণকে “সরকারি কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অসদাচরণ” হিসেবে গণ্য করা হবে।

এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে তিন ধরনের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এক. অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিম্ন পদমর্যাদা বা বেতন গ্রেডে অবনমিত করা। দুই. বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং তিন. চাকরি থেকে সরাসরি বরখাস্ত করা।

বলা হয়েছে, বিদ্যমান কোনো বিধিমালায় যা-ই থাকুক না কেন এই আইনই কার্যকর বলে বিবেচিত হবে।

কিন্তু এই আইনে ‘অসদাচরণ’-এর সংজ্ঞা যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে বলে মত দিয়েছেন আইনজীবী ও প্রশাসনিক আইন বিশ্লেষক তানজিবুল আলম।

তানজিবুল আলম স্ট্রিমকে বলেন, ‘আইনের ৩৭ (ক) ধারার ভাষা কিছুটা আপেক্ষিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক। “বৈধ আদেশ” অমান্য করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে, কিন্তু “বৈধতা” নির্ধারণ করবে কে? অনেক সময় এমন কিছু আদেশ থাকে, যা টেকনিক্যালি বা নীতিগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তা উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের “ইচ্ছা” হিসেবেই নিচু পর্যায়ের কর্মচারীদের সামনে আসে। এখন যদি কেউ তার পেশাগত বিবেচনায় প্রশ্ন তোলে বা বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটায়, তাহলে সেটিও কি অপরাধ হবে?’

তানজিবুল আলম আরও বলেন, এই ধারা সংশোধনের ফলে কিছুটা ভাষাগত পরিশুদ্ধতা আনা হলেও মূল দর্শনটি এখনো ‘শৃঙ্খলা রক্ষার নামে প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবি’র মধ্যেই রয়ে গেছে। তাঁর মতে, ধারাটিকে আরও স্পষ্ট করে, ‘দায়বদ্ধতা’ ও ‘সততা’র সুযোগ রেখে প্রয়োগযোগ্য করাই উচিত ছিল।

সারসংক্ষেপে বলা যায়, ৩৭(ক) ধারায় সরকার শৃঙ্খলা রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিলেও, এতে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও প্রশাসনের ভেতরে সুশাসনের জায়গা সংকুচিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আইন প্রয়োগের সময় এসব দিক বিবেচনায় না নিলে এটি প্রশাসনে নিপীড়নমূলক ও একমুখী হয়ে উঠতে পারে।

কী বাদ দেওয়া হয়েছে

তানজিবুল আলম বলেন, ‘অনানুগত্য’ শব্দটি অস্পষ্ট এবং এর অপব্যবহারের আশঙ্কা ছিল অনেক বেশি। অনেক সময় পেশাগত মতামত বা সংবেদনশীল বিষয়ের ওপর প্রশ্ন তোলা হলেও সেটি ‘অনানুগত্য’ হিসেবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা হয়ে কর্মচারীদের ওপর দমনপীড়ন হতে পারত। এতে সরকারি কর্মচারীদের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদের সুযোগ হ্রাস পেত।

তিনি বলেন, এই অস্পষ্টতা ও ব্যাখ্যাগত জটিলতা থেকেই অনেক সময় প্রশাসনিক জবাবদিহিতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে পড়ত। যেমন, কোনো কর্মচারী যদি কোনো আদেশ নিয়ে পেশাগতভাবে দ্বিমত পোষণ করতেন বা সহকর্মীদের সঙ্গে যুক্তিযুক্ত আলোচনা করতেন, সেটিও ‘অনানুগত্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থেকে যেত।

এই বাস্তবতা বিবেচনা করেই ২০২৫-এর সংশোধিত অধ্যাদেশে ওই ‘অনানুগত্য’ শব্দটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংশোধকরা মনে করেন, শব্দটির অপব্যবহারের সুযোগ কমাতে এবং শৃঙ্খলাসংক্রান্ত আচরণগুলোকে আরও নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে এই ধরনের অস্পষ্ট শব্দ পরিহার করা জরুরি।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী অভিযুক্ত কর্মচারী তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগের নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে তিনি ওই অভিযোগের কারণ দর্শাবেন। এর মধ্যে দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগও রাখা হয়েছে। শুনানির মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় তাঁর ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া ও প্রতিকার নিশ্চিত হয়।

তদন্ত, আত্মপক্ষ সমর্থন ও আপিল

সংশোধিত সরকারি চাকরি অধ্যাদেশে তদন্ত প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা সরকারি কর্মচারীদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের সুযোগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্য নিয়ে গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এক সদস্যের বদলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের বিধান। এর মাধ্যমে অভিযোগ তদন্তে আরও স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটিতে একটি বিশেষ নিয়মও সংযোজন করা হয়েছে। সেখানে অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি নারী হন, তাহলে কমিটিতে অন্তত একজন নারী সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে নারীদের প্রতি বৈষম্য ও অনিয়মের আশঙ্কা কমিয়ে তাদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী অভিযুক্ত কর্মচারী তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগের নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে তিনি ওই অভিযোগের কারণ দর্শাবেন। এর মধ্যে দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগও রাখা হয়েছে। শুনানির মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় তাঁর ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়া ও প্রতিকার নিশ্চিত হয়।

সংশোধিত অধ্যাদেশেও আগের মতো রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রাখা হয়নি। অর্থাৎ, যদি তদন্ত শেষে রাষ্ট্রপতির আদেশে কোনো শাস্তি কার্যকর হয়, তাহলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আইনি বা আপিলের পথ বন্ধ থাকবে। যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন, যা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত অনুসারে চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

কর্মচারীদের আপত্তি কেন

সরকারি কর্মচারীরা মনে করেন, এই অধ্যাদেশের ফলে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যেকোনো কঠোর বা নিবর্তনমূলক সিদ্ধান্ত তারা প্রতিবাদ ছাড়াই মানতে বাধ্য হবেন। এর ফলে তাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমে যেতে পারে। কারণ, এই আইন অনুযায়ী তাঁরা আর কাজ বন্ধ করে প্রতিবাদ, সভা-সমাবেশ বা ধর্মঘট করার সুযোগ পাবেন না। কর্মচারীরা এভাবে প্রতিবাদ জানানোকে তাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে গন্য করেন।

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেছেন, ‘এই অধ্যাদেশ প্রয়োগ করবেন কর্মকর্তারা, আর এর শিকার হবেন সাধারণ কর্মচারীরা। তাঁরা অসদাচরণ এবং অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন।’

কীভাবে হলো আইন সংশোধন

চলতি বছরের ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদ সরকারি চাকরি আইনে সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু ২৪ মে থেকে সচিবালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এর বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামেন। তাঁরা সংশোধিত অধ্যাদেশকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দেন।

আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, ‘অনানুগত্য’ শব্দটি অস্পষ্ট ও চাতুরিপূর্ণভাবে প্রয়োগযোগ্য, যা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।

আন্দোলনের মুখে সরকার ৪ জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সংশোধনের সুপারিশ করে।

পরে ৩ জুলাই সংশোধিত অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন পায় এবং ২৩ জুলাই তা চূড়ান্তভাবে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত