leadT1ad

ইসির সঙ্গে সংলাপে ‘না ভোট’ রাখার আহ্বান নারী অধিকারকর্মীদের

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
ইসিতে নির্বাচনী সংলাপে বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেত্রীরা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারী অধিকারকর্মীরা বলেছেন, সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়ানো হলেও সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন ছাড়া নারীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে না। তাঁদের দাবি, সরাসরি নির্বাচন না হলে সংরক্ষিত আসন বাড়ানো নিরুৎসাহিত করা উচিত। একই সঙ্গে তাঁরা নারীবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেন, এমন প্রার্থী ঠেকাতে না পারলে ‘না ভোটের’ বিধান রাখা উচিত।

মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সংলাপে বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেত্রীরা এসব কথা বলেন। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নারীর প্রার্থী মনোনয়নে অনীহা দেখাচ্ছে। ফলে সংসদে নারীর কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সংরক্ষিত আসনগুলোকে সরাসরি নির্বাচনের আওতায় আনা ছাড়া বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘জেন্ডার ফ্রেন্ডলি নির্বাচন কেবল কথায় নয়, আচরণে প্রতিফলিত হতে হবে। প্রার্থী যাচাইয়ের সময় নারীবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ যেন মনোনয়ন না পায়।’

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী বাছাইয়ে এই তিনটি মূল্যবোধ বাধ্যতামূলকভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। নারী প্রার্থীদের জন্য আলু, বেগুন, চুলা, কুলা—এ ধরনের প্রতীক দেওয়া অপমানজনক বলেও মন্তব্য করেন ফওজিয়া মোসলেম।

তিনি প্রস্তাব করেন, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ১৫০–তে উন্নীত করা হোক এবং এগুলোও সরাসরি নির্বাচিত হোক। মোট ৪৫০ আসনের মধ্যে ১৫০ নারী আসন হলে অন্তত সংসদে নারীদের ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে বলে দাবি করেন তিনি।

নারীপক্ষ–এর সভাপ্রধান গীতা দাস বলেন, ‘সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোট ছাড়া সংখ্যা বাড়ানো মানে নারীর প্রতিনিধিত্বে ভাঁওতা দেওয়া। এখনই সরাসরি নির্বাচন বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে অন্তত রাজনৈতিক দলগুলোতে ২৫-৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ ধরনের প্রার্থী বাছাই করে বাদ দেওয়া সম্ভব না হয়, নারী বিদ্বেষী বা সাম্প্রদায়িক প্রার্থী থাকলে আমরা প্রতিটি আসনে “না ভোট” দেওয়ার আহ্বান জানাই।’

‘নিজেরা করি’–এর সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, ‘আমরা চাই সংরক্ষিত আসন থাকুক, তবে সেটি অবশ্যই সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে হোক। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নারীদের অংশগ্রহণে আগ্রহী নয়, ৩৩ শতাংশ কোটা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও তারা রাখছে না।’

তিনি বলেন, নিরাপদ ভোটকেন্দ্র ও নারী ভোটারদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। ভোটকেন্দ্র দূরে হলে অনেক নারী সেখানে যেতে পারেন না, তাই প্রত্যন্ত এলাকায় কেন্দ্র বাড়ানো প্রয়োজন। নারী প্রার্থীরা যেন ভোটের সময় ও পরে সহিংসতার শিকার না হন, সেদিকে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, নির্বাচনী সময়ে নারী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন। ‘আমরা চাই এবারের নির্বাচন হোক নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতামুক্ত। নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বা ভয়ভীতি রোধে নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। নারী ভোটার ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে প্রকৃত অংশগ্রহণ সম্ভব নয়,’ বলেন তিনি।

নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, সংসদের বর্তমান ৩০০ আসন বাড়িয়ে ৬০০ করা উচিত। ‘প্রত্যেক আসন থেকে দুইজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন—একজন সাধারণ আসনে, অন্যজন নারী আসনে। উভয়েই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন।’

তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের আসল দায়িত্ব আইন প্রণয়ন; এলাকা উন্নয়ন নয়। এই ধারণাটি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের স্পষ্টভাবে জানাতে হবে।’

নারী রাজনৈতিক অধিকার ফোরামের নেত্রী ও প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘নারীর সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই। সকল সংগঠনই একমত যে নারী আসনগুলোতে প্রত্যক্ষ ভোট দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের এমন আসনে মনোনয়ন দেয়, যেখানে জেতার সম্ভাবনা নেই। নির্বাচন কমিশন চাইলে অন্তত কিছু আসনে নারী প্রার্থীদের জেতার মতো আসনে মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করতে পারে। ‘অনলাইন–অফলাইন নারী হয়রানির বিরুদ্ধে উদাহরণমূলক শাস্তি না দিলে ইনক্লুসিভ ইলেকশন সম্ভব নয়,’ বলেন মাহরুখ মহিউদ্দিন।

বি–স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, দেশে প্রায় ৩৩ লাখ প্রতিবন্ধী ভোটার আছেন, কিন্তু তাঁদের মাত্র ১০ শতাংশ ভোট দিতে পারেন। ‘এবার আমরা চাই শতভাগ ভোটার অংশ নিক।’

তিনি প্রস্তাব দেন, প্রতিবন্ধী ভোটারদের জন্য সহজগম্য ভোটকেন্দ্র, বিশেষ আইডি কার্ড, অডিও ও ব্রেইল ভিত্তিক ভোটিং ব্যবস্থা এবং পোস্টাল ভোটের সুবিধা নিশ্চিত করতে। ‘আপনারা যদি চান সত্যিকারের ইনক্লুসিভ ইলেকশন, তাহলে জেন্ডার ও প্রতিবন্ধী—উভয় দিকেই অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ নিতে হবে,’ বলেন তিনি।

সংলাপের শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, নারী ভোটার ও প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কমিশন বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে।

নারী নেত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদে বড় সাফল্য এসেছে।

নাসির উদ্দিন বলেন, নারী ভোটারের সংখ্যা অতীতে যেখানে পুরুষের তুলনায় ৩০ লাখের বেশি কম ছিল, এবার তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা আগ্রহ নিয়ে রাত ৯–১০টা পর্যন্ত ভোটার নিবন্ধনে অংশ নিয়েছেন। ‘এটি নারী ভোটারদের মধ্যে আস্থার পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে,’ বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই যে কেউ, যেখানে থাকুন না কেন, তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকুক। এজন্য দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় একটি কার্যকর প্রযুক্তিগত সমাধানের দিকে এগোচ্ছি।’

নারী অধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আমাদের নিয়ত পরিষ্কার—আমরা সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে চাই। আপনাদের পরামর্শ শুধু শুনতেই নয়, বাস্তবায়নের জন্যই আমরা এই সভা আয়োজন করেছি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত