leadT1ad

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ার যেসব ‘অন্ধকার’ উঠে এলো গবেষণায়

২০১১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত পাঁচটি বড় সহিংস হামলার মূলেই ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছবি বা বিকৃত তথ্য ভাইরাল করে সাধারণ মানুষকে উসকে দেওয়া হয়েছে।

সৈকত আমীন
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৫, ২০: ১৭
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি এর নেতিবাচক দিকগুলোও দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নিয়ে।

গবেষণায় উঠে এসেছে ট্রলিং, গুজব ও হেট স্পিচ এখন আর শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়ার সমস্যা নয়, এগুলো এখন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পর্ক, এমনকি সামাজিক নিরাপত্তাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশে অনলাইনে ট্রলিং কীভাবে এক ধরনের ‘সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেছেন বুশরা আনোয়ার। তাঁর গবেষণার শিরোনাম ‘বাংলাদেশে ট্রল কালচার: সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক একটি গবেষণা’। গবেষণাটি ২০২২ সালে ‘রিসার্চ গেট’-এ প্রকাশিত হয়।

এই গবেষণায় দেখা যায়, অনলাইনে ট্রলিং শুধু কৌতুকের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তির চেহারা, পোশাক, পারিবারিক জীবন, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েও অহরহ ট্রল করা হচ্ছে। এর ফলে বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধে আঘাত, অস্থিরতা ও বিষণ্নতার মাত্রা বাড়ছে।

এদিকে, বাংলাদেশে গুজব যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে সাজল রায়, আশীষ কুমার সিং ও কামরুজ্জামানের যৌথ গবেষণায়।

‘সোশ্যাল মিডিয়া, গুজব ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: বাংলাদেশ থেকে প্রমাণ’ শিরোনামে গবেষণাটি ২০২৩ সালে ‘পাব মেড সেন্ট্রাল’ -এ প্রকাশিত হয়।

গবেষণাটিতে উঠে এসেছে, ২০১১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত পাঁচটি বড় সহিংস হামলার মূলেই ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছবি বা বিকৃত তথ্য ভাইরাল করে সাধারণ মানুষকে উসকে দেওয়া হয়েছে।

শাশ্বত সৌরভ রায় সৌম্য, শালেহ ইসলাম তন্ময় ও ফরহাদ রাব্বির যৌথ গবেষণা ‘গ্লোবাল সাউথ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার: একটি মানসিক আচরণগত বিশ্লেষণ’।
২০২৩ সালে ‘পাব মেড সেন্ট্রাল’-এ প্রকাশিত এই গবেষণায় উঠে এসেছে, কোভিড-১৯-এর টিকা নিয়ে কীভাবে ভুল তথ্য মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে। পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টকে মানুষ যাচাই না করে বিশ্বাস করেছে এবং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে। ফলে শুধু মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা নয়, সার্বিক জনস্বাস্থ্যের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

গুজবের পাশাপাশি হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সাজল রায় ও তাঁর সহ-গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ‘উম্মাহ নেটওয়ার্ক’ নামের পাঁচ লাখের বেশি সাবস্ক্রাইবার থাকা একটি ইউটিউব চ্যানেল কীভাবে নিয়মিত সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ছড়িয়ে সামাজিক সম্প্রীতি ভাঙতে মানুষকে উস্কানি দিচ্ছে। শুধু ধর্ম নয়, রাজনৈতিক বিরোধিতাকেও হেট স্পিচের মাধ্যমে উসকে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যা সমাজকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

শাশ্বত সৌরভ রায়ের গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন, অস্থিরতা, ঘুমের সমস্যা ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে। করোনা লকডাউনের সময় ৫৮ শতাংশ পুরুষ ও ১৯ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানসিক অবসাদে ভুগেছেন। এ ছাড়া ৭৩ শতাংশ ব্যবহারকারী ঘুমের সমস্যায় ভুগেছেন। বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি প্রকট।

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দম্পতিদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় পারস্পরিক সন্দেহ, দ্বন্দ্ব ও বিশ্বাসহীনতা তৈরি করছে। ফলে পারিবারিক বন্ধন হালকা হয়ে যাচ্ছে। যেসব সমাজে পরিবারই সামাজিক স্থিতির প্রধান ভিত্তি, সেখানে এটি এক বড় বিপদ।

গবেষণাগুলো বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ার অন্ধকার দিকগুলো সামনে নিয়ে এসেছে। দেখিয়েছে, ট্রলিং, গুজব আর হেট স্পিচ মানুষের মন ও সমাজ দুটিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখা, তথ্য যাচাই করা, ভুয়া খবর না ছড়ানো এবং ট্রল কালচার ও বিদ্বেষমূলক ভাষার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। না হলে অনলাইনের এই অদৃশ্য ছোবল আরও বহু পরিবার ও সমাজকে বিচ্ছিন্নতার অন্ধকারে ঠেলে দেবে।

বিষয়:

গবেষণা
Ad 300x250

সম্পর্কিত