সালেহ ফুয়াদ
২৫ জুন দুপুরবেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কাইতলা গ্রাম। জনসম্মুখে সাংবাদিক খন্দকার শাহ আলমকে পিটিয়ে হত্যা করেন ওই গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মিয়া। শাহ আলমেরই একটি সংবাদ প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। প্রতিশোধ নিতে জেল থেকে ছাড়া পেয়েই হামলা চালান বাবুল।
খুন হওয়া শাহ আলম (৪৮) দৈনিক মাতৃজগত পত্রিকার নবীনগর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ১৮ জুলাই বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানায়। বাংলাদেশে গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
শাহ আলমের খুন হওয়ার দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে গাজীপুরে আরেক সাংবাদিককে প্রকাশ্যে খুন করা হয়। ৭ আগস্ট রাত আটটার দিকে আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮) নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করেছিল। সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করছিলেন। তখন আসাদুজ্জামানকে ধাওয়া করে গাজীপুর নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
আসাদুজ্জামান তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন।
বাংলাদেশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
চলতি বছরের ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৫ সালের ‘বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক’ প্রকাশ করেছে। সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে। যদিও আরএসএফ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ওই বছর সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক ৯ দেশের মধ্যে শীর্ষে ৩য় স্থানে জায়গা দেয়।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক নিয়ে আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সরকার গণমাধ্যমকে কেবল নিজেদের বার্তা প্রচারের একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাঁর সরকার সেন্সরশিপ, সাইবার হয়রানি, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চাপ, বিচারিক হয়রানি, একের পর এক দমনমূলক আইন, পুলিশি সহিংসতা এবং শাসক দল-সমর্থিত বাহিনীর হামলার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেছিল।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তৈরির প্রস্তাব করেছে, যাতে সাংবাদিকতার জন্য কাউকে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতন করা যাবে না। সরকারের জন্য তাদের সুরক্ষা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। মালিকদের ওপরও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বর্তাবে।কামাল আহমেদ, প্রধান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমগুলো সতর্কভাবে সরকারকে প্রশ্ন করা এড়িয়ে চলত এবং নিজ থেকে মতপ্রকাশে সংযমের (সেলফ-সেন্সরশিপ) আশ্রয় নিত। কয়েক সপ্তাহের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসনের অবসান হয়। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
আরএসএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনও সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমকর্মী নিহত হননি। তবে পাঁচ সাংবাদিক আটক রয়েছেন।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায় সেই রিপোর্টিং কিংবা মতামত প্রকাশের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কাউকে কেউ হয়রানি, নির্যাতন বা নিগৃহীত করেছে—এমন অভিযোগ গত এক বছরে শুনি নাই। সুতরাং সরকারিভাবে কোনো বাধা আছে তা বলা যাবে না। তবে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হুমকি এগুলো বন্ধ হয়েছে, তা-ও বলা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং সামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর তরফে এগুলো অব্যাহত আছে। এটা দুঃখজনক। এতে করে ভীতির পরিবেশ কোথাও কোথাও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার এগুলো পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। তবে, এ কথাও সত্য যে কোনো অঘটন ঘটলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের কাজটা আন্তরিকতার সঙ্গেই করছে। অতীতের তুলনায় পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে প্রত্যাশা অনেক বেশি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরের অবস্থা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সরকারি-বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের নীতিনির্ধারক পদে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগ ‘সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরা চাকরিচ্যুত হন। তাদের জায়গায় বসেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরা।
যেসব সংবাদপ্রতিষ্ঠানে বড় পরিবর্তন আসেনি তাদেরও নানা রকম চাপের মুখে পড়তে হয়। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে ‘জোড়া গরু জবেহ’ কর্মসূচি দিয়ে মব সৃষ্টি করা হয়। সময় টিভি, কালের কণ্ঠসহ ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কয়েকটি পত্রিকা অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়। সম্প্রতি জনকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খান জনকণ্ঠ ভবনে ‘মব সৃষ্টি করে অবৈধভাবে দখলের’ অভিযোগ করেছেন।
বেসরকারি টেলিভিশনের ৩ সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে ৩২টি ফৌজদারি মামলায় ১৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ৩০ এপ্রিল বিবৃতি দিয়ে সংগঠনটি বলেছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও মামলা করা হয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নির্বিঘ্নে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এ ধরনের মামলা কিংবা চাকরিচ্যুতির ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত বলেছে আসক।
সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত চাপ
গত ২৯ এপ্রিল একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে প্রশ্ন করার জেরে চাকরিচ্যুত করা হয় তিন বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিককে। খবরে প্রকাশ, তিন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই মূলত মব-সহিংসতার ভয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন।
গত ২২ এপ্রিল উপজেলা প্রশাসনের ভবন নির্মাণকাজে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি টিপু সুলতানকে ছাতা দিয়ে মারধর করেন উপসহকারী প্রকৌশলী এম এম মামুন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাংবাদিক টিপু সুলতানকে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মো. রাসেল।
পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে ২৪ এপ্রিল টিপুকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জামিনে মুক্তি দেন। অন্যদিকে টিপু সুলতানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া তালার ইউএনও শেখ মো. রাসেলকে রংপুর বিভাগে বদলি করা হয়।
গত ১৭ জুলাই খাগড়াছড়িতে একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন। এ ঘটনায় ২৯ জুলাই কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বিবৃতি দিয়ে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানায়।
গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ
৩ মাস আগে চলতি বছরের ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৫ সালের বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করে। সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে। ১৮০টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় পাঁচটি বিষয়ের (ইন্ডিকেটর) প্রতিটিতে ভালো করেছে।
২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ২০২১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনতি হচ্ছিল। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। পরের বছর ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। ২০২৩ সালে আরও এক ধাপ পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। পরের বছর পিছিয়েছিল আরও দুই ধাপ। অর্থাৎ ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটেছিল, ১৫২তম থেকে নেমে ২০২৪–এ ১৬৫তম অবস্থানে গিয়েছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা— এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। এবার গত বছরের তুলনায় প্রতিটি বিষয়ে (ইন্ডিকেটর) ভালো করেছে বাংলাদেশ।
৬ মাসে সাংবাদিক নির্যাতনের ১৯৬ ঘটনা
সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের পরিসংখ্যান তৈরি করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গত ১০ জুলাই সংগঠনটি বছরের প্রথমার্ধে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাংবাদিকদের উপর ১৯৬টি মামলা-হামলা ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
বছরের প্রথম ছয় মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতন/হয়রানি/হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৯টি। সরাসরি হত্যার হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৮টি। প্রকাশিত সংবাদের বিপরীতে সাংবাদিকদের ওপর মামলা হয়েছে ৪৪টি। নির্যাতন/আক্রমণ/হুমকি/হয়রানি/বোমা নিক্ষেপের মতো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। সংবাদিকাদের ওপর বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো আক্রমণ/নির্যাতন/হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে ১৭টি। এসময়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের আক্রমণ/নির্যাতন/হয়রানির কোনো তথ্য দিতে পারেনি সংগঠনটি।
অন্যদিকে আসক বলছে, ছয় মাসে পেশাগত কাজে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্যাতন/হুমকি/হয়রানির শিকার হয়েছেন অন্তত একজন সাংবাদিক। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে ৬৬টি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৩টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের ওপর। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের আক্রমণ বা হুমকির মুখে পড়েছেন অন্তত একজন। পেশাগত কাজে গিয়ে সাংবাদিকরা অন্য আরও ৬টি নিপীড়নের ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়াও, গত ৩০ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরে দুই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহের সময় সাত সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়। চলতি বছর ২ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বনশ্রীতে এক নারী সংবাদকর্মীকে হেনস্তা ও মারধরের অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় মামলা হয়। হত্যার হুমকির পর ১৯ এপ্রিল সাভারে দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদক ইকবাল হাসান ফরিদের উপর রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ২২ মে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে মেঘনার তীরের জলকপাট (স্লুইসগেট) নির্মাণকাজের ‘অনিয়মের’ খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় চারজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন। এ সময় গ্রামবাসী ও ঠিকাদারের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে আরো ছয়জন আহত হন।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ৯ দেশের মধ্যে শীর্ষ তিনে ওঠে আসে বাংলাদেশ। এ তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফিলিস্তিন ও পাকিস্তান।
এদিকে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
সাংবাদিক খুনের বিচার হয় না
পেশাগত কাজে সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্যতম পূর্ব শর্ত। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, গত দুই যুগে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কিংবা এর সূত্র ধরে যেসকল সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের একজনেরও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন সাংবাদিকের জন্য কোনো ধরনের প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও বিরল। আসক বলছে, পেশাগত কর্মে নিয়োজিত সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এখনো সাংবাদিকতা পেশাটি আক্ষরিক অর্থে স্বাধীন কিংবা চাপমুক্ত হতে পারেনি।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কোনো পরামর্শ দিয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তৈরির প্রস্তাব করেছে, যাতে সাংবাদিকতার জন্য কাউকে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতন করা যাবে না। সরকারের জন্য তাদের সুরক্ষা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। মালিকদের ওপরও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বর্তাবে।’
২৫ জুন দুপুরবেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কাইতলা গ্রাম। জনসম্মুখে সাংবাদিক খন্দকার শাহ আলমকে পিটিয়ে হত্যা করেন ওই গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মিয়া। শাহ আলমেরই একটি সংবাদ প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। প্রতিশোধ নিতে জেল থেকে ছাড়া পেয়েই হামলা চালান বাবুল।
খুন হওয়া শাহ আলম (৪৮) দৈনিক মাতৃজগত পত্রিকার নবীনগর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ১৮ জুলাই বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানায়। বাংলাদেশে গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
শাহ আলমের খুন হওয়ার দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে গাজীপুরে আরেক সাংবাদিককে প্রকাশ্যে খুন করা হয়। ৭ আগস্ট রাত আটটার দিকে আসাদুজ্জামান তুহিনকে (৩৮) নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করেছিল। সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করছিলেন। তখন আসাদুজ্জামানকে ধাওয়া করে গাজীপুর নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
আসাদুজ্জামান তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন।
বাংলাদেশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
চলতি বছরের ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৫ সালের ‘বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক’ প্রকাশ করেছে। সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে। যদিও আরএসএফ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ওই বছর সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক ৯ দেশের মধ্যে শীর্ষে ৩য় স্থানে জায়গা দেয়।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক নিয়ে আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সরকার গণমাধ্যমকে কেবল নিজেদের বার্তা প্রচারের একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাঁর সরকার সেন্সরশিপ, সাইবার হয়রানি, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চাপ, বিচারিক হয়রানি, একের পর এক দমনমূলক আইন, পুলিশি সহিংসতা এবং শাসক দল-সমর্থিত বাহিনীর হামলার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেছিল।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তৈরির প্রস্তাব করেছে, যাতে সাংবাদিকতার জন্য কাউকে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতন করা যাবে না। সরকারের জন্য তাদের সুরক্ষা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। মালিকদের ওপরও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বর্তাবে।কামাল আহমেদ, প্রধান, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমগুলো সতর্কভাবে সরকারকে প্রশ্ন করা এড়িয়ে চলত এবং নিজ থেকে মতপ্রকাশে সংযমের (সেলফ-সেন্সরশিপ) আশ্রয় নিত। কয়েক সপ্তাহের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসনের অবসান হয়। এরপর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
আরএসএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনও সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমকর্মী নিহত হননি। তবে পাঁচ সাংবাদিক আটক রয়েছেন।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায় সেই রিপোর্টিং কিংবা মতামত প্রকাশের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কাউকে কেউ হয়রানি, নির্যাতন বা নিগৃহীত করেছে—এমন অভিযোগ গত এক বছরে শুনি নাই। সুতরাং সরকারিভাবে কোনো বাধা আছে তা বলা যাবে না। তবে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হুমকি এগুলো বন্ধ হয়েছে, তা-ও বলা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং সামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর তরফে এগুলো অব্যাহত আছে। এটা দুঃখজনক। এতে করে ভীতির পরিবেশ কোথাও কোথাও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার এগুলো পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। তবে, এ কথাও সত্য যে কোনো অঘটন ঘটলে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের কাজটা আন্তরিকতার সঙ্গেই করছে। অতীতের তুলনায় পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে প্রত্যাশা অনেক বেশি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরের অবস্থা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সরকারি-বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের নীতিনির্ধারক পদে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগ ‘সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরা চাকরিচ্যুত হন। তাদের জায়গায় বসেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরা।
যেসব সংবাদপ্রতিষ্ঠানে বড় পরিবর্তন আসেনি তাদেরও নানা রকম চাপের মুখে পড়তে হয়। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে ‘জোড়া গরু জবেহ’ কর্মসূচি দিয়ে মব সৃষ্টি করা হয়। সময় টিভি, কালের কণ্ঠসহ ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কয়েকটি পত্রিকা অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়। সম্প্রতি জনকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খান জনকণ্ঠ ভবনে ‘মব সৃষ্টি করে অবৈধভাবে দখলের’ অভিযোগ করেছেন।
বেসরকারি টেলিভিশনের ৩ সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে ৩২টি ফৌজদারি মামলায় ১৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ৩০ এপ্রিল বিবৃতি দিয়ে সংগঠনটি বলেছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও মামলা করা হয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের নির্বিঘ্নে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এ ধরনের মামলা কিংবা চাকরিচ্যুতির ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত বলেছে আসক।
সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত চাপ
গত ২৯ এপ্রিল একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে প্রশ্ন করার জেরে চাকরিচ্যুত করা হয় তিন বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিককে। খবরে প্রকাশ, তিন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই মূলত মব-সহিংসতার ভয়ে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন।
গত ২২ এপ্রিল উপজেলা প্রশাসনের ভবন নির্মাণকাজে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি টিপু সুলতানকে ছাতা দিয়ে মারধর করেন উপসহকারী প্রকৌশলী এম এম মামুন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাংবাদিক টিপু সুলতানকে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মো. রাসেল।
পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে ২৪ এপ্রিল টিপুকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জামিনে মুক্তি দেন। অন্যদিকে টিপু সুলতানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া তালার ইউএনও শেখ মো. রাসেলকে রংপুর বিভাগে বদলি করা হয়।
গত ১৭ জুলাই খাগড়াছড়িতে একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন। এ ঘটনায় ২৯ জুলাই কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বিবৃতি দিয়ে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানায়।
গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ
৩ মাস আগে চলতি বছরের ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২৫ সালের বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করে। সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১৬ ধাপ এগিয়েছে। ১৮০টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম। আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় পাঁচটি বিষয়ের (ইন্ডিকেটর) প্রতিটিতে ভালো করেছে।
২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ২০২১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনতি হচ্ছিল। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। পরের বছর ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থানের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। ২০২৩ সালে আরও এক ধাপ পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। পরের বছর পিছিয়েছিল আরও দুই ধাপ। অর্থাৎ ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটেছিল, ১৫২তম থেকে নেমে ২০২৪–এ ১৬৫তম অবস্থানে গিয়েছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তার ওপর ভিত্তি করে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক ও নিরাপত্তা— এই পাঁচ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক তৈরি করা হয়। এবার গত বছরের তুলনায় প্রতিটি বিষয়ে (ইন্ডিকেটর) ভালো করেছে বাংলাদেশ।
৬ মাসে সাংবাদিক নির্যাতনের ১৯৬ ঘটনা
সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের পরিসংখ্যান তৈরি করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গত ১০ জুলাই সংগঠনটি বছরের প্রথমার্ধে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাংবাদিকদের উপর ১৯৬টি মামলা-হামলা ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
বছরের প্রথম ছয় মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতন/হয়রানি/হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৯টি। সরাসরি হত্যার হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৮টি। প্রকাশিত সংবাদের বিপরীতে সাংবাদিকদের ওপর মামলা হয়েছে ৪৪টি। নির্যাতন/আক্রমণ/হুমকি/হয়রানি/বোমা নিক্ষেপের মতো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। সংবাদিকাদের ওপর বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো আক্রমণ/নির্যাতন/হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে ১৭টি। এসময়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের আক্রমণ/নির্যাতন/হয়রানির কোনো তথ্য দিতে পারেনি সংগঠনটি।
অন্যদিকে আসক বলছে, ছয় মাসে পেশাগত কাজে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নির্যাতন/হুমকি/হয়রানির শিকার হয়েছেন অন্তত একজন সাংবাদিক। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে ৬৬টি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৩টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের ওপর। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের আক্রমণ বা হুমকির মুখে পড়েছেন অন্তত একজন। পেশাগত কাজে গিয়ে সাংবাদিকরা অন্য আরও ৬টি নিপীড়নের ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়াও, গত ৩০ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরে দুই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহের সময় সাত সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়। চলতি বছর ২ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বনশ্রীতে এক নারী সংবাদকর্মীকে হেনস্তা ও মারধরের অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় মামলা হয়। হত্যার হুমকির পর ১৯ এপ্রিল সাভারে দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদক ইকবাল হাসান ফরিদের উপর রাসায়নিক পদার্থ ছিটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ২২ মে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে মেঘনার তীরের জলকপাট (স্লুইসগেট) নির্মাণকাজের ‘অনিয়মের’ খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় চারজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হন। এ সময় গ্রামবাসী ও ঠিকাদারের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে আরো ছয়জন আহত হন।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ৯ দেশের মধ্যে শীর্ষ তিনে ওঠে আসে বাংলাদেশ। এ তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফিলিস্তিন ও পাকিস্তান।
এদিকে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
সাংবাদিক খুনের বিচার হয় না
পেশাগত কাজে সাংবাদিকদের সুরক্ষা প্রদান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অন্যতম পূর্ব শর্ত। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, গত দুই যুগে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কিংবা এর সূত্র ধরে যেসকল সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের একজনেরও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন সাংবাদিকের জন্য কোনো ধরনের প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও বিরল। আসক বলছে, পেশাগত কর্মে নিয়োজিত সাংবাদিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এখনো সাংবাদিকতা পেশাটি আক্ষরিক অর্থে স্বাধীন কিংবা চাপমুক্ত হতে পারেনি।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কোনো পরামর্শ দিয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তৈরির প্রস্তাব করেছে, যাতে সাংবাদিকতার জন্য কাউকে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতন করা যাবে না। সরকারের জন্য তাদের সুরক্ষা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। মালিকদের ওপরও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বর্তাবে।’
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তবে এ আলোচনার মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদী হবে না।
১ ঘণ্টা আগেঅভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়। পরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
১ ঘণ্টা আগেফয়েজুর রহমান রুবেলের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
৩ ঘণ্টা আগেমালয়েশিয়ার জোহর প্রদেশের আয়ার হিতাম এলাকায় বিদেশি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে পরিচালিত এক অভিযানে, ৯ বাংলাদেশিসহ মোট ৩২ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ (ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট)।
৪ ঘণ্টা আগে