জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে সোমবার (১৭ নভেম্বর) মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আসামিদের অনুপস্থিতিতে বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপসহ (আইসিজি) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। পৃথক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুজনের অনুপস্থিতিতেই বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তাদের পছন্দের আইনজীবী দেওয়ার সুযোগ ছিল না, যেটি গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনার প্রশাসনের নির্যাতনের জন্য দায়ীদের যথাযথভাবে জবাবদিহি করা উচিত। কিন্তু প্রসিকিউশন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থন, সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জিজ্ঞাসাবাদের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ এবং নিজের পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ পাননি আসামিরা। এই মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ফলে সঠিক বিচার নিয়ে উদ্বেগ অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করে এইচআরডব্লিউ।
সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়েরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক, অন্যায়ভাবে বিচার করা এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার কার্যালয় এবং বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ‘মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষায় সহায়তা করার লক্ষে’ দেশে একটি মিশন খোলার জন্য তিন বছরের সমঝোতা স্মারক সই করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদেরও ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া উচিত। এই ধরনের সহায়তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশ প্রয়োজন।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর জাতিসংঘের
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় এ মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরোধিতা করে বলেছে, দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরনের সাজা বাতিলের আহ্বান জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। রায়কে ‘ভুক্তভোগীদের জন্য একটি মুহূর্ত উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
এদিকে, মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরোধিতা করলেও বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস অফিস (ওএইচসিএইচআর)। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের এ সংস্থা যেকোনো পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছে।
সংস্থাটি বলছে, গত বছরের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন হয়, তাতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সহিংসভাবে দমন করে। এক পর্যায়ে পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
জাতিসংঘের নেতৃত্বে পরিচালিত এক তদন্তে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেক শিশুও ছিল। আহত হয়েছেন হাজার হাজার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বিবৃতিতে বলেছে, জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে এমন কার্যক্রমের আহ্বান জানিয়ে আসছে যা নিঃসন্দেহে যথাযথ প্রক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারের সব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে। দীর্ঘদিন ধরেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিলের দাবিতে জাতিসংঘে একাধিক প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।
বিবৃতিতে মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে, শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খানের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে, যেটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে ‘বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ করে তুলেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশ এখন ‘জাতীয় সংহতি ও উত্তরণের পথ হিসেবে সত্য-প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ এবং ন্যায়বিচারের’ একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাবে।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সবাইকে শান্ত থাকা এবং সংযম প্রদশর্নের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মৃত্যুদণ্ডের রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মৃত্যুদণ্ডকে অমানবিক সাজা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং কোনো বিচারিক প্রক্রিয়ায় এর স্থান নেই বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামাহ বলেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংসতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের বিচার করা উচিত। তবে এই বিচার ও সাজা নিরপেক্ষ বা ন্যায়সঙ্গত কোনোটাই নয়।
এতে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা প্রয়োজন, কিন্তু মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আরো জটিল করে তোলে। এটি চূড়ান্ত নিষ্ঠুর, অবমাননাকর এবং অমানবিক শাস্তি এবং কোনো বিচার প্রক্রিয়ায় এর স্থান নেই।
সংগঠনটি বলেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে। বেঁচে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান পূরণকারী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার পরিচালনা করা প্রয়োজন। কিন্তু এর পরিবর্তে, এই বিচার এমন একটি আদালতের সামনে পরিচালিত হয়েছে, যার স্বাধীনতার অভাব এবং অন্যায্য বিচারের ইতিহাসের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা করে আসছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, আসামিদের অনুপস্থিতিতে বিচারের অনাকাঙ্ক্ষিত গতি এবং রায় এই জটিল মামলার ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ তৈরি করে। যদিও শেখ হাসিনার পক্ষে আদালত আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবুও তার প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতির জন্য সময় অপর্যাপ্ত ছিল।
পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর আসামিপক্ষকে জেরা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি এমন প্রতিবেদনগুলো এই ধরনের অন্যায্য বিচারের সূচক বা লক্ষণগুলোকে বৃদ্ধি করে বলে মনে করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
সংগঠনটি বলেছে, এটি কোনো সুষ্ঠু বিচার ছিল না। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ভুক্তভোগীরা আরও ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের এমন একটি ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া প্রয়োজন, যা পক্ষপাতের সন্দেহের বাইরে, সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ হবে এবং মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে আরও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আদেশ দেবে না। তবে প্রকৃত এবং অর্থপূর্ণ সত্য, ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা সম্ভব হবে।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম: আইসিজি
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডাদেশকে দেশের জনগণ স্বাগত জানালেও এই রায় তার (শেখ হাসিনার) রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কার্যত অবসানের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)।
বার্তা সংস্থা ইউএনবি এ প্রতিবেদন দিয়েছে।
আইসিজির বাংলাদেশবিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বিবৃতিতে বলেছেন, শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডাদেশ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কারণ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বিক্ষোভ দমনে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য তার ভূমিকা নিয়ে কোনো সন্দেহ দেশের মানুষের নেই।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের তদন্তে আগেই নিশ্চিত হয়, এক হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানির ঘটানো সেই দমন অভিযানে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ায় উপস্থাপিত রেকর্ডিং, নথিপত্র এবং সাবেক আইজিপির সাক্ষ্য এসব তথ্যকে আরও পোক্ত করে।
তবে থমাস কিয়ান বিচারপ্রক্রিয়ার কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। অনুপস্থিতিতে বিচার, অল্প সময়ে শুনানি শেষ করা এবং প্রতিরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের অভাব নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এগুলো বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বিচারব্যবস্থাগত সমস্যার প্রতিফলন বলে তিনি মনে করেন। তবুও এসব প্রশ্নকে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দায় এড়ানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন থমাস কিয়ান।
আইসিজির মতে, এই রায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাকে অত্যন্ত ক্ষীণ করে দিয়েছে। তিনি দল ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে আওয়ামী লীগেরও সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসা কঠিন হবে। সাম্প্রতিক বোমা হামলা এবং দলের ডাকা দেশব্যাপী ‘লকডাউন’ কর্মসূচি দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থায় রেখেছে– যা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
থমাস কিয়ান বলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে আওয়ামী লীগকে সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে দলীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এড়াতে হবে।