leadT1ad

নির্বাচনে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ চাইলেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ৪৯
সাংবাদিকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্ট্রিম ছবি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ গণমাধ্যম ব্যক্তিরা।

আজ সোমবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের সংলাপে এই আহ্বান জানানো হয়। সিইসির সভাপতিত্বে সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপে গণমাধ্যম নীতিনির্ধারকরা বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রে অবাধ প্রবেশ, তথ্যের স্বচ্ছতা, প্রার্থীদের আর্থিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক নিয়োগে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিক মিলিয়ে ১৮ জন গণমাধ্যম প্রতিনিধি বাস্তবতার নিরিখে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নানা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। পাশাপাশি অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা নজরদারিতে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিও করেন।

এ সময়ে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যমের সহায়তা চান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা শুধু নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য গণমাধ্যম, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলসহ সবার সহযোগিতা অপরিহার্য।’

সিইসি বলেন, ‘এই নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাই একটি ভালো নির্বাচন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

তিনি জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সময় ২১ লাখ মৃত ভোটার চিহ্নিত করে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এদের অনেকেই আগে ভোট দিয়ে যেতেন। একই সঙ্গে প্রায় ৪৫ লাখ নতুন ভোটার যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে, নারী ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ বাড়াতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিপুল সংখ্যক নারী নিবন্ধন করেছেন।

নির্বাচন কমিশন প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কাজ করছে জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করার পর পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। এটি একটি শংকর পদ্ধতি, যা ডিজিটাল ও পোস্টাল ব্যালটের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে।’

সংলাপে কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমন কিছু বক্তব্য দিয়েছেন যা দেখে মনে হচ্ছে, ভোটারদের আস্থা ফিরে আসছে। তবে আপনাদের এখন “ডু অর ডাই” পরিস্থিতি। জাতির কাছে আপনাদের মেরুদণ্ডী, নৈতিক অবস্থানই নির্ধারণ করবে এই নির্বাচন কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে।’

তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা এখন বড় হুমকি। সাইবার নজরদারি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিদেশি সহায়তা নিয়ে হলেও এ খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি।’

সংলাপে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে নানা গুজব ও আশঙ্কা আছে। কিন্তু জনগণ চায় একটি অবাধ, স্বতঃস্ফূর্ত ও আনন্দময় নির্বাচন। ১৫ বছর ধরে জাতি সেই পথ দিয়ে যেতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের দুর্বলতা, অর্থ ও প্রভাবের খেলা—সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। ইতিমধ্যে একটি দল বিভিন্ন অঞ্চলে বলপ্রয়োগ করছে বলে খবর মিলছে।’

দ্য ডেইলি স্টার-এর হেড অব নিউজ জিয়াউল হক বলেন, ‘সাংবাদিকরা যেন ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন না হন, হয়রানির শিকার না হন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়—এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।’

আজকের পত্রিকা সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, ‘প্রার্থীরা হলফনামা জমা দেওয়ার পর তা অনেক দেরিতে ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। তখন ভোটারদের জানার সুযোগ থাকে না। প্রার্থী হলফনামা জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে, যাতে জনগণ প্রার্থীর সব তথ্য জানতে পারে।”

দৈনিক ইত্তেফাক–এর রাজনীতি ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ‘২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এবার ইসি নিজস্ব কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিলে নির্বাচন আরও নিরপেক্ষ হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোটগ্রহণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ আছে। টেন্ডারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রাক্তন মন্ত্রীর আত্মীয়—এমন তথ্য রয়েছে। কমিশনের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।’

রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি)–এর সভাপতি কাজী জেবেল বলেন, ‘সীমানা পুননির্ধারণের ঘটনায় ভাঙার ঘটনা জাতিকে মনে করিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনের আগে কীভাবে উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। মাঠপর্যায়ে শুনানি না হওয়ায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইসির সংযোগ দুর্বল হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আরপিও সংশোধনে ফেরারি আসামিদের প্রার্থী না করার বিধান প্রশাসনিক অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে। অনেক যোগ্য প্রার্থীকে সরিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’

তিনি অভিযোগ করেন, সাংবাদিক নীতিমালা বিষয়ে ইসির সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও কমিশন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ‘আমরা জানতে চাই, আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে কি না,’ বলেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘গত ১৬ বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। তবে এবার তারা সেই অবস্থানে থাকবে না বরং নির্বাচনকে ভালো করার জন্য কাজ করবে।’

সানাউল্লাহ বলেন, ‘একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে কিছু বাহিনী গেছে। গত ১৬ বছরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচনে ছিল, কিন্তু তারা নির্বাচনকে খারাপ করার কাজ করেছে। এবার হয়তো তারা অতটা শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে না, তবে ভালো নির্বাচনের জন্য কাজ করবে। আমাদের যা সক্ষমতা আছে, তা আমরা কাজে লাগাব—প্রয়োজনে স্কাউটদেরও যুক্ত করা যেতে পারে।’

সংলাপে ওঠে আসা মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জানান, প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় ইসির তত্ত্বাবধানে সব প্রার্থীকে একই মঞ্চে এনে তাদের নির্বাচনি এজেন্ডা উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবে ইসি।

পর্যবেক্ষক নিবন্ধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘৩০০টিরও বেশি আবেদন পাওয়া গেছে, যার মধ্য থেকে বাছাই করে ৭৩টি সংগঠন অনুমোদনের পর্যায়ে এসেছে। আগেরবারের পর্যবেক্ষকদের বাদ দেওয়া হয়েছে। মতাদর্শ থাকতে পারে, কিন্তু সেটিকে বাছাইয়ের মানদণ্ড করা হয়নি।’

ভোটার তালিকা প্রসঙ্গে সানাউল্লাহ জানান, এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ বাধ্যতামূলক নয়। ১৮ বছর পূর্ণ হলেই অনলাইনে ভোটার নিবন্ধন করা সম্ভব, পরে অফিসে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিলেই যথেষ্ট। তবে এখনো কিছু বাদ পড়া বা মৃত ভোটার থাকতে পারে, যা ভবিষ্যতে সংশোধনের কাজ চলবে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ১০ শতাংশ ভোটার ব্যবধানের কথা থাকলেও বাস্তবে তা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। আমরা ইউনিয়ন বা পৌরসভা ভাঙিনি, তবে প্রয়োজনে কিছু সিটি ও উপজেলা পর্যায়ে কাটছাঁট করা হয়েছে।’

ফরিদপুরের ঘটনার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এর মূলে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নয় বরং অন্য কিছু থাকতে পারে বলে আমরা জেনেছি।’

সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘এটি এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন দেশের কমিশনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারণে নির্বাচন অবাধ হলেও সব সময় সুষ্ঠু হয় না। ডিজিটাল স্পেসে ছড়ানো ৫০ শতাংশের বেশি অপপ্রচার ট্রেস করাও যায় না।’

সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা কোনো রেস্ট্রিকটিভ পদক্ষেপ—যেমন শাটডাউন বা ব্যান্ডউইথ কমানো—নেব না। বরং ভালো তথ্য দিয়ে খারাপ তথ্য মোকাবিলা করব। সত্য তথ্যের অবাধ প্রবাহই হবে আমাদের কৌশল।’

এ সময় তিনি আরও জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন চার মিলিয়ন ইউরোর একটি ফান্ড করেছে, তবে সরকারের ২৭৫ মিলিয়ন ডলারের বাজেট তুলনায় অনেক বড়।

সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য ইউএনডিপির সঙ্গে কাজ করছি। পাশাপাশি পুলিশ, বিটিআরসি, গোয়েন্দা সংস্থা সবাইকে নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।’

প্রবাসী ভোটারদের বিষয়ে তিনি জানান, ভোটাররা যদি ঠিকানা ভুল দেন, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা, তাহলে বিকল্প হিসেবে পিকআপ পয়েন্ট থেকে ব্যালট নেওয়ার ব্যবস্থা করা হতে পারে।

সানাউল্লাহ বলেন, ‘প্রবাসী ভোটাররা ব্যালটে ভোট দিয়ে ডাকযোগে পাঠাবেন, আর ভোটের দিন সেই ব্যালট গণনা করা হবে।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত