leadT1ad

ছাত্র-সংসদে ভরাডুবির পর আরও নিষ্প্রভ ছাত্রদল

মিরহাজুল শিবলী
মিরহাজুল শিবলী

প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২২: ২৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসুর ভোটে শীর্ষ দুই পদের কোনটিতেই জিততে পারেনি বিএনপির ছাত্র সংগঠনটির প্রার্থীরা। নির্বাচনের পর যেখানে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে আরও যেন নিষ্ক্রিয় হয়েছে সংগঠনটি। ভোটের পর ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রমেই দেখা যায়নি ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের। বিষয়টি নিয়ে হতাশ সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও। তাঁরা বলছেন, বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টাই দেখছেন না।

শোচনীয় ফল

দেশের চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ২৮টি পদের বিপরীতে ২৫টি পদে বিজয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাকসু) নির্বাচনে ২৫ পদের বিপরীতে ২০টি পদে জিতেছে ছাত্রশিবির। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে কোনো পদে জিততে পারেনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আগের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় মন্দের ভালো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে ক্রীড়া ও খেলাধুলা সম্পাদক পদে জয় পায় ছাত্রদল। তবে এই দুই ছাত্র সংসদেও সিংহভাগ পদে জয় পায় ছাত্রশিবির।

পরাজয়ের নেপথ্য কারণ: দীর্ঘ অনুপস্থিতি ও গ্রুপিং

ছাত্রদলের এই পরাজয়ের পেছনে নানা কারণ দেখছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সংগঠনের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘শিবিরের কল্যাণমূলক রাজনীতি’, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার’, ‘দীর্ঘদিন ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতি’, ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ তীব্র গ্রুপিং’কে দায়ী করছেন তাঁরা। ‘নির্বাচন নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা না থাকা’, ‘শেষ মুহূর্তে প্রার্থী ঘোষণা’ করাকেও কারণ হিসাবে দায়ী করছেন কেউ কেউ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকা এবং দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি না পারা পরাজয়ের অন্যতম কারণ।

ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন হলে অবস্থান করতে পারেনি। কিন্তু শিবিরের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী আমলে ছাত্রলীগের পদ-পদবি নিয়ে হলে অবস্থান করেছে। আবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করেছে। আমরা ১৭ বছর ধরে মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে রাজনীতি করেছি। আমাদের এরকম টাকা খরচ করে ছাত্র রাজনীতি করার সামর্থ্য নেই।’

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির ঢাকা স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমাদের পরিশ্রম ছিল, প্রত্যাশা ছিল। এরপরও ফলাফল খারাপ হয়েছে। তবে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিবন্ধকতা ছিল। আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার ছিল। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও ছিল না। তারপরও আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থে ও জুলাইয়ের স্পিরিট অক্ষুণ্ন রাখতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।’

নেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

সম্প্রতি ছাত্র-সংসদ নির্বাচন হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এমনটাই মনে করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাধিক শিক্ষার্থী স্ট্রিমকে জানান, নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদলের সক্রিয়তা থাকলেও বর্তমানে তা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীসংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা সামনের দিকে ছিলেন। তবে ভোটের পর তারা অনেকটাই নিষ্প্রভ।

চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র-সংসদগুলো দায়িত্ব নিয়ে ইতিমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বেশ কিছু কার্যক্রম আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে কোনো প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে না ছাত্রদল। এমনকি সম্প্রতি ‘রাষ্ট্র সংস্কারে বিরোধিতার অপচেষ্টা’র অভিযোগ তুলে বিএনপির উদ্দেশে ডাকসু আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানালেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি ঢাবি ছাত্রদল।

সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও এখনো পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর মাত্র একটি বর্ধিত সভা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটি গঠনের প্রায় দুই মাস হলেও কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক বা দিক-নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক মামিনুল ইসলাম জিসান বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে আমরা বিজয়ীদের সরকার বলি। পরাজিতরা হয় ছায়া সরকার। যদিও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে, তবুও বলা যায় ছাত্রদল বর্তমানে ছায়া সংসদ। কিন্তু ছায়া সংসদের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের কোনো দায়িত্ব পালন করতে দেখতে পাচ্ছি না।’

ব্যর্থতার দায় কার?

ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলকে দায়ী করছেন সংগঠনটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের এক নেতা বলেন, ‘বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সংগঠনের ভেতরে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। প্রার্থীতার বিষয়ে যোগ্যতার চেয়ে তার নিজ অনুসারীদেরকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। বর্তমান ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা তাঁর অনুসারী। তাই তারা দলের চেয়ে বকুলের প্রিয় হতেই বেশি আগ্রহী।’

অন্যদিকে, ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় সংসদের শীর্ষ পাঁচ নেতার একজন বলেন, ‘এই মুহূর্তে সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতার পূর্ণ মনোযোগ থাকার কথা ছাত্রদলের প্রতি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তারা ছাত্রদলের চেয়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রতি বেশি আগ্রহী। তারা আসন্ন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হতে চান।’

তবে ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, ‘ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আমাদের কোনো কাজ বাধাগ্রস্ত করা কিংবা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। উনি পলিসি তৈরির কাজ করেন বা আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এখানে কোনো বলয় নেই। যে কথাগুলো আসছে তা দুঃখজনক।’

সংসদ সদস্য হতে চাওয়ার বিষয়টি সত্য হলেও মনোযোগ না রাখার বিষয়টি ঠিক নয় বলে জানান ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘জাতীয় রাজনীতি কিংবা ছাত্র রাজনীতি আমার কাছে আলাদা কোনো প্রেক্ষাপট নয়। আমরা জাতীয় নির্বাচন করতে চাই। তাই বলে এলাকায় গিয়ে তো দীর্ঘদিন পড়ে থাকি না। আমাদের পূর্ণ মনোযোগ ছাত্রদলে আছে।’

অবশ্য সোমবার দলটি ২৩৭ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করলে, সে তালিকায় ছাত্রদল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম পাওয়া যায়নি।

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা ও আশাবাদ

তবে ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে আশাবাদী ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ এই নেতা। তিনি বলেন, ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনে ছাত্রদল বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে। ছাত্রদল অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। নতুন ও ডায়নামিক নেতৃত্ব পেলে ছাত্রদল আরও গতিশীল হবে।’

ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, ‘আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই। ইতিমধ্যে আমাদের প্রায় ১৮০০ থেকে ১৯০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে কমিটি গঠন করেছি। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোগুলোকে আরও শ্রেণিবিন্যাস করে শিক্ষার্থীদের আরও কাছে যেতে চাই, যেটি আমরা গত ১৭ বছর পারিনি।’

নাসির আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মসূচিতে আমরা হাত দিচ্ছি। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের কেন্দ্রীয় টিম মনিটরিং করছে। যদি আমরা এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারি, আশা করি আগামী ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে আমরা ভালো করব।’

সারা দেশে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতি গতিশীলতা অর্জন করলেও দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন শাওন বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টা করছি, সমালোচনা তো থাকেই। তবে সাংগঠনিক গতিশীলতার জন্য নতুন কমিটি হওয়া দরকার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সহসভাপতি আনিসুর রহমান আনিক বলেন, ‘ছাত্রদল তার নিজস্ব কার্যক্রম করছে। এটি স্পষ্ট যে ডাকসু একটি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।’

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যর্থতার দায়ভার প্রসঙ্গে সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মানুষ সব সময়ে বিজয়ীদের মনে রাখে। যেহেতু আমরা জিততে পারিনি, সেহেতু ব্যর্থতার দায় সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অবশ্যই আমাদের রয়েছে।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত