leadT1ad

নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির কোটি কোটি টাকা লোপাটে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৫: ৪৪
নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। ছবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বেসরকারি নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), হয়েছে মামলা।

প্রাথমিক অনুসন্ধানকারী দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজিদ-উর-রোমান গত ৭ সেপ্টেম্বর সংস্থার সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ মামলাটি করেন। এই কর্মকর্তার অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের মে থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি ও নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে মোট ১১ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা।

এই দুটি প্রতিষ্ঠান তখন পরিচালিত হতো ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইবিএটি) ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে। বোর্ডটির তহবিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্থের বাইরে আরও প্রায় ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা সরানো হয়। সব মিলিয়ে লোপাট করা প্রায় ২০ কোটি টাকার পুরোটাই গেছে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে।

আবু ইউসুফ নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হন ২০১১ সালে। তিনি এসে আইবিএটি ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট গঠন করেন।

এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির বিষয়টি অবগত আছি। সেখানে ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দুটি পক্ষ আছে। দুপক্ষই আবার নিজেদের অবস্থানে অনঢ়। আর্থিক জালিয়াতিসংক্রান্ত মামলাও হয়েছে দুদকে। আমরা যতটুকু এখতিয়ার আছে নিয়মের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছি।’

মামলার ছয় আসামি একই পরিবারের

দুদকের মামলায় সাত আসামি হলেন—নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম শামছুল হক, ভাইস চেয়ারম্যান হালিমা সুলতানা জিনিয়া, সদস্য সাদ আল জাবির আব্দুল্লাহ, মোসাম্মাৎ হাবিবুন নাহার, নাজমুস সাদাত ও লাবিবা আব্দুল্লাহ।

তাঁদের মধ্যে হালিমা সুলতানা হলেন আবু ইউসুফের স্ত্রী, জাবির আব্দুল্লাহ ছেলে, হাবিবুন নাহার বোন, নাজমুস সাদাত বোনের ছেলে এবং লাবিবা আব্দুল্লাহ তাঁর মেয়ে।

এজাহারের তথ্যানুযায়ী, আইবিএটি ট্রাস্টের তহবিল থেকে আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেড’–এ ১৮ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ১৪০ টাকা এবং ‘সুন্দরবন সায়েন্টিফিক শিল্প কালচারাল লিমিটেড’-এর ব্যাংক হিসাবে দেড় কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ‘অবৈধভাবে’ কাজটি করেছেন।

সংস্থাটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি এবং নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে মোট ১১ কোটি ১৫ লাখ টাকা আইবিএটি ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। দুদক বলছে, এসব টাকা আইবিএটি ট্রাস্টি বোর্ডের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাতমসজিদ রোড শাখার হিসাব নম্বর থেকে প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেডের চারটি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে এই অর্থসহ আইবিএটির ব্যাংক হিসাবের আরও ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম স্ট্রিমকে বলেন, অনুসন্ধানের পর নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এরপরই মামলা করা হয়। এখন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনিই বিষয়টি তদন্ত করবেন।

এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহকে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁকে ই-মেইল পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।

নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমরা দুদকের অনুসন্ধান ও মামলার ব্যাপারে জানি। কিন্তু অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে আমি বিস্তারিত বলতে পারছি না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী

২০০২ সালের ১৭ অক্টোবর আইবিএটি ট্রাস্টের অধীনে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অনুমোদন পায়। ওই সময় সাত সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন অধ্যাপক শামসুল হক, আবু বকর সিদ্দিক, আবু আহমেদ, লুৎফর রহমান, বোরহান উদ্দিন, আয়েশা আক্তার ও রেজাউল করিম। তাঁদের মধ্যে শুধু শামসুল হক বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন।

শুরুতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চলত বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম। এখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন আশকোনায় সাড়ে চার একর জমির ওপর স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পাঁচটি অনুষদের অধীনে মোট ৯টি প্রোগ্রামে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। প্রায় সাড়ে ৩০০ শিক্ষকের পাশাপাশি এখানে রয়েছেন ১৬০ কর্মকর্তা-কর্মচারী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ইউজিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ আসার পর ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন বেশ কয়েকজন সদস্য বাদ পড়েছিলেন। তাঁরা আবার ফিরে আসতে চাচ্ছেন।

প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।

এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে আমরা ট্রাস্টি বোর্ডের বিবদমান সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করছি।’

কে এই আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ

বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ব্যবসাতেও নাম লিখিয়েছেন। প্রাসাদ নির্মাণ লিমিটেড, প্রাসাদ প্যারাডাইস লিমিটেড, সিনার্জি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড হাসপাতাল, সৈকত সুন্দরবন হোটেল লিমিটেড, সুন্দরবন সায়েন্টিফিক শ্রিম্প কালচার লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক তিনি।

২০২২ সালে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অধ্যাপক আবু ইউসুফ। ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও জাল দলিলে জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগে নর্দান ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের এই চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে জামিন পান তিনি।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত