ভোরের প্রকৃতিতে হালকা কুয়াশা। সারি সারি খেজুর গাছের ডালের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ভোরের সূর্যের আলো। একটার পর একটা গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনছেন রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার চকগোচর গ্রামের গাছি মো. ওবায়দুল। বুধবার (৫ নভেম্বর) ভোরে চকগোচর গ্রামে ঢুকতেই এ দৃশ্য চোখে পড়ল। ওবায়দুল জানালেন, এক সপ্তাহ ধরেই রস এসেছে গাছে। এরইমধ্যে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়েছে গুড় তৈরির কর্মযজ্ঞও।
প্রতিবছরই অক্টোবরের শেষ থেকে রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলার গ্রামে গ্রামে গাছিদের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। খেজুর গাছ ‘ঝোড়’ করে তারা রস নামানোর উপযোগী করে তোলেন। শীত শুরু হতে না হতেই লাগিয়ে দেওয়া হয় বাঁশের ‘গুজ ফাতাড়ি’। রোজ বিকেলে ‘গুজের’ নিচে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় চুনমাখা কোর (মাটির হাঁড়ি)। ফোঁটা ফোঁটা রস জমে সারা রাতে কোর প্রায় ভরে ওঠে।
পঞ্জিকার পাতা অনুযায়ী, এখন ভর হেমন্ত। তবে এরইমধ্যে উত্তরের জেলাগুলোতে শুরু হয়েছে শীতের আমেজ। সকালে রাজশাহীর চরঘাটা এলাকার গ্রামগুলোতে গেলে দেখা যায়, বড় চুলোর পাশ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। বড় বড় তাওয়ায় ফুটছে খেজুর রস। আর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। এবারও শীতের শুরুতেই খেজুর গুড়ের গন্ধে সকালটা আরও মিষ্টি হয়ে উঠেছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, নথি অনুযায়ী জেলায় খেজুর গাছ আছে ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি। প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ২৫ লিটার রস পাওয়া যায়। তা থেকে প্রায় ১০ কেজি গুড় হয়। সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাছ থেকে রস নামে। গেল মৌসুমে জেলায় প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হয়। এই গুড় বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার গাছির হাতে এসেছে ২০০ কোটি টাকা। এবার আরও বেশি গুড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জ্বাল দেওয়া হচ্ছে খেজুর রস। স্ট্রিম ছবিচকগোচর গ্রামের গাছি মো. ওবায়দুল জানালেন, গ্রামের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ এই খেজুর রস নামানো ও গুড় তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইদানিং চিনির দাম কম হওয়ায় অনেকে আবার রসের সঙ্গে চিনিও মিশিয়ে দিচ্ছেন। এতে লাভ বেশি হচ্ছে। তবে অনেকেই চিনি দিয়ে গুড় তৈরি করেন না। তারা শুধু রস দিয়েই গুড় করেন। এই গুড়ের দাম কিছুটা বেশি। অনলাইনের অনেক উদ্যোক্তাই দাম বেশি দিয়ে হলেও ক্রেতাদের জন্য খাঁটি খেজুরের গুড় নিয়ে যান।
বুধবার (৫ নভেম্বর) ভোরে পুঠিয়া উপজেলার ভুবননগরে গিয়ে দেখা গেল, গাছ থেকে রস নামাচ্ছেন মো. রানা। তার বাইসাইকেলে দুটি বড় বড় জার বাঁধা। গাছ থেকে নামানো রস নেওয়া হচ্ছে ওই জারে। রানা জানালেন, গত প্রায় একমাস ধরেই তিনি রস নামাচ্ছেন। তার ইজারা নেওয়া ৫২টি গাছ থেকে রোজ প্রায় ৬০ লিটার রস হচ্ছে। এই রস থেকে ১০ থেকে ১১ কেজি গুড় হচ্ছে।
ভুবননগর গ্রামের জালাল উদ্দিন ৩০টি গাছ থেকে রস নামান। খুব ভোরেই কলেজপড়ুয়া ছেলে জামিল হাসানকে নিয়ে রস নামিয়ে এনেছেন। সকাল সাড়ে ৭টায় তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, জালাল উদ্দিনের স্ত্রী রওশন আরা বাড়ির সামনে রসের তাওয়ায় জ্বাল দিচ্ছেন। ফুটন্ত রসের ম-ম গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। রওশন আরা জানালেন, প্রায় আড়াই ঘণ্টা একটানা জ্বাল দেওয়ার পর রস শুকিয়ে লালি গুড় হয়ে যাবে। তারপর পাত্রে ঢাললেই শুকিয়ে গিয়ে তৈরি হবে গুড়ের পাটালি। এবার মৌসুমের শুরুতেই ১৬০ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি হচ্ছে।
বাঘা, চারঘাট ও পুঠিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, আরেকটু বেশি শীতের অপেক্ষায় অনেক গাছেই রসের হাঁড়ি লাগানো হয়নি। আবার কিছু কিছু গাছি এখনও গাছের ঝোড় করা ও গুজ লাগানোর কাজ করছেন। পুঠিয়ার জরমডাঙ্গা গ্রামে দেখা হয় গাছি সাইফুল ইসলাম মিলু ও তার চাচাত ভাই মিঠুন আলীর সঙ্গে। মিঠুন গাছের ঝোড় করার পর সাইফুল রস লাগানোর স্থানটি প্রস্তুত করে গুজ বসিয়ে দিচ্ছিলেন। সাইফুল বললেন, কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে তাদের কাজ পিছিয়ে পড়েছে। কয়েকদিন পর তারা রস নামানো শুরু করবেন।
খেজুর রস জ্বালিয়ে বানানো হচ্ছে গুড়। স্ট্রিম ছবিসাইফুল জানান, যাদের কাছে আছে তাদের বেশিরভাগই রস নামাতে পারেন না। গাছিদের কাছে তারা এক মৌসুমের জন্য গাছ ইজারা দিয়ে দেন। গাছ দেখে ইজারার দাম হয়। কোনো গাছের জন্য দিতে হয় ৫০০ টাকা, কোনটির ইজারামূল্য ১ হাজার। একেকজন গাছি কমপক্ষে ৩০টি থেকে শুরু করে ১০০টি পর্যন্ত গাছ নেন। বাড়িতে গুড় তৈরির কাজ নারীরাই করেন। পুরুষেরা আবার গুড় নিয়ে বিক্রি করেন পুঠিয়ার বানেশ্বর ও বাঘার আড়ানি হাটে।
গ্রামের বাসিন্দা শামসুল ইসলাম বললেন, যেদিন গুড় বিক্রি হয়, সেদিন হাতে নগদ টাকা আসে। হাট থেকে তখনই বাজার-সদায় করা হয়। বাড়িতে ভাল খাবার হয়। এছাড়া সুমিষ্ট রস দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে নানারকম পিঠা-পুলির আয়োজন তো থাকেই। পুরো মৌসুমজুড়েই তাদের এলাকায় উৎসবের আমেজ থাকে। তাই এলাকায় খেজুর গাছের কদর কমেনি। কেউ গাছ কাটেও না। বরং, ইদানিং নতুন নতুন জমিতে খেজুর গাছ লাগানো হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহীর খেজুর গুড়ের খুব সুনাম আছে। গত মৌসুমে তো প্রায় ২০০ কোটি টাকার গুড় বিক্রি হয়েছে। এবার আমরা আশা করছি যে, আরও বেশি গুড় তৈরি হবে। তবে আশঙ্কার কথা এই যে, অনেক অসাধু গাছি রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে দেয়। এ রকম হতে থাকলে রাজশাহীর খেজুর গুড়ের সুনাম হারিয়ে যাবে। তাই গাছিদের এটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’