leadT1ad

প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন, যে ব্যাখ্যা দিল সরকার

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ৪৪
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে অংশ নিতে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংগৃহীত ছবি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে অংশ নিতে গত সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে পৌঁছান। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটি দল জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খলার মুখে পড়েন। তখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারাকেও গালমন্দের শিকার হতে হয়। এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দায়ী করা হয়। ঘটনাটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা, ভিসা প্রোটোকল এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কী ঘটেছিল জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে

নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান। হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তার প্রতিনিধি দলে আছেন— বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির বিদেশবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা।

জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আখতার হোসেন। সংগৃহীত ছবি
জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আখতার হোসেন। সংগৃহীত ছবি

সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার দিকে তাঁরা জনএফ কেনেডি বিমানবন্দরের টার্মিনাল ৪ থেকে বের হচ্ছিলেন। মুহাম্মদ ইউনূস ও কর্মকর্তারা ভিআইপি গেট ব্যবহার করছিলেন, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশি ছিল। অন্যদিকে, রাজনৈতিক নেতারা বি১/বি২ ভিসা দিয়ে সাধারণ লাইন ব্যবহার করছিলেন। এ সময়ই অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি ঘটে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীরা ‘রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে আখতার হোসেনের পিঠে দুটি ডিম ছুড়ে মারেন। তাসনিম জারাকেও অশালীন গালমন্দ ও হুমকি দেওয়া হয়। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, বিক্ষুব্ধ আওয়ামী সমর্থকরা বিএনপি-জামাত-এনসিপি নেতাদের ঘিরে ধরেছে। একটি ভিডিও ক্লিপে ডিম ছোঁড়ার দৃশ্য এবং ‘সন্ত্রাসী’ বলে গালি দিতে দেখা যায়।

এই ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মিজানুর রহমান নামে এক যুবলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিউইয়র্ক পুলিশ। তবে পরদিন মঙ্গলবারই তিনি জামিন পেয়েছেন।

সরকারের বিরুদ্ধে ‘ব্যর্থতার’ অভিযোগ

‘ডিম হামলা’র পর আখতার হোসেন বলেন, ‘আমরা সেই প্রজন্মের যারা হাসিনার গুলির মুখোমুখি হতে ভয় পাইনি। তাই ডিম ছুড়েও আমাদের ভয় দেখানো যাবে না। এই ঘটনা আবার প্রমাণ করল যে, আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আওয়ামী লীগ স্বভাবগত ও প্রকৃতিগতভাবে সন্ত্রাসী। তারা সবসময় সহিংসতার পথ অবলম্বন করে।’

আখতার হোসেন এই বক্তব্য এনসিপি ডায়াসপোরা এলায়েন্সের তথা প্রবাসী জোটেরর ফেসবুক পেজে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দিয়েছেন। একই বক্তব্য তিনি তাঁর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্টেও দেন।

বিক্ষোভকারীরা ‘রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে আখতার হোসেনের পিঠে দুটি ডিম ছুড়ে মারেন। সংগৃহীত ছবি
বিক্ষোভকারীরা ‘রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে আখতার হোসেনের পিঠে দুটি ডিম ছুড়ে মারেন। সংগৃহীত ছবি

আখতার হোসেন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। যারা দেশে এবং বিদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদেরকে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।

ঘটনার পর এনসিপির প্রবাসী জোটও একটি বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, এটি শুধু রাজনৈতিক সহিংসতার প্রকাশ নয়, বরং রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রোটোকল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতারও একটি উদাহরণ। তারা প্রশ্ন তুলেছে, যদি সরকারী সফরে অংশগ্রহণকারীদের ন্যূনতম নিরাপত্তাও দেওয়া না হয়, তাহলে বিদেশে বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাস কেন আছে। তারা আরও জানতে চেয়েছে, এসব কনস্যুলেট ও দূতাবাস কার স্বার্থে কাজ করছে। তারা এটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি গুরুতর ব্যর্থতা হিসেবেও দেখেছে।

বিবৃতিতে সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনটি দাবি তুলে ধরা হয়। ১. বাংলাদেশ সরকারকে সরাসরি মার্কিন ফেডারেল কর্তৃপক্ষ এবং নিউইয়র্ক সিটির সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ দাখিল করতে হবে।

২. নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কনস্যুলেট জেনারেলের পুরো টিমকে অবিলম্বে বদলি বা বরখাস্ত করতে হবে।

৩. সফররত নেতাদের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

এনসিপর আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ সমালোচকরা এই ঘটনাকে সরকারের সিস্টেমের ব্যর্থতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা ‘অবশিষ্ট ফ্যাসিস্ট সমর্থকদের’ এই হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন।

ডিম ছোড়ার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মিজানুর রহমান নামে এক যুবলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিউইয়র্ক পুলিশ। সংগৃহীত ছবি
ডিম ছোড়ার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে মিজানুর রহমান নামে এক যুবলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিউইয়র্ক পুলিশ। সংগৃহীত ছবি

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেলকে পদত্যাগ করতে হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত কূটনীতিকদের বরখাস্ত করতে হবে। হামলার জন্য সকল দোষীকে গ্রেপ্তার করতে হবে।

বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুলও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটি আওয়ামী লীগের ‘অনুতাপহীন অন্যায়ের’ প্রমাণ। তিনি আইনি পদক্ষেপের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন।

গণ সংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী ও নির্বাহী সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার পাশপাশি তাঁর সঙ্গে থাকা প্রতিনিধি দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত ছিল। তবে এই হামলা দেখিয়েছে, সফররত রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

গণ সংহতি আন্দোলনের নেতারা বলেন, বিভিন্ন সরকারি বিভাগের, বিশেষ করে এমন আমলাদের ভূমিকা যাচাই করা প্রয়োজন। আমলাতন্ত্রে কোনও সংস্কার ছাড়াই ফ্যাসিস্ট সহযোগীরা এখনও আছে এবং তারা এমন ঘটনার সুযোগ করে দেয়।

যে ব্যাখ্যা দিল সরকার

সোমবার নিউইয়র্কে রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্থার ঘটনায় মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়, এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ও কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক সহিংসতা ও ভয়ভীতি, তা দেশের ভেতরে হোক বা দেশের বাইরে—কোনভাবেই সহ্য করা হবে না। এর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, দেশে ও দেশের বাইরে গণতান্ত্রিক রীতি ও আইনের শাসন অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে সরকার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য গৃহীত প্রটোকল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘প্রধান উপদেষ্টা এবং সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগেই একাধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সেই অনুযায়ী, জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিনিধিদলকে প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ভিভিআইপি গেটের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়।

‘এরপর তাদের একটি বিশেষ সুরক্ষিত পরিবহন ব্যবস্থায় বসানো হয়। তবে ভিসা সংক্রান্ত আকস্মিক ও শেষ মুহূর্তের জটিলতার কারণে তাদেরকে বিকল্প পথে যাত্রা করতে হয়েছে।’

তবে ভিসা সংক্রান্ত শেষ মুহূর্তের জটিলতা কী ছিল, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভিভিআইপি প্রবেশাধিকার ও নিরাপত্তা সুবিধা জারি রাখার জন্য আবেদন করা হলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তা অনুমোদন দেননি। এর ফলে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা এবং রাষ্ট্রীয় সফরে আসা প্রতিনিধিদলের সকল সদস্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে, যাতে বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা যায়।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত