বিভক্ত বিশ্বে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫। জাতিসংঘের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিউইয়র্কে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক চলছে। এ সময় ঢাকা স্ট্রিম আয়োজন করে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের। সেই সাক্ষাৎকারে ছিলেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা স্ট্রিমের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান।
স্ট্রিম ডেস্ক
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া ২৫ বছরের বেশি কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি শান্তিরক্ষার সাফল্যের মাপকাঠি, শীর্ষ সেনা-অবদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অপরিহার্য ভূমিকা, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কৌশল এবং ইউক্রেনের মতো সংঘাতে জাতিসংঘের সম্ভাব্য ভূমিকা তুলে ধরেন।
এছাড়া তিনি শান্তিরক্ষীদের জীবন সুরক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তার আলোচনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মানবিক দিকটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
স্ট্রিম: প্রথমেই জানতে চাই, জাতিসংঘ কীভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সাফল্যকে সংজ্ঞায়িত করে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: সাফল্যকে নানা দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। আমার মতে, চূড়ান্ত সাফল্য তখনই আসে যখন কোনো দেশ শান্তিরক্ষা মিশনের সহায়তায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে স্থিতিশীলতা অর্জন করে ও সংঘাত কাটিয়ে ওঠে।
এমন সাফল্য ইতিমধ্যে বহু দেশে ঘটেছে। কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, লাইবেরিয়া, কোট দিভোয়ার, সিয়েরা লিওন, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিকসহ আরও অনেক দেশ এর উদাহরণ।
তবে এই সাফল্য অর্জনের জন্য শুধু জাতিসংঘ বা শান্তিরক্ষা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হওয়া। এটি সম্ভব হয় তখনই, যখন সদস্যরাষ্ট্র ও সব অংশীদারের শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকে।
আজকের বাস্তবতায় অনেক শান্তি প্রক্রিয়া ধীর বা সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বিভাজন এর বড় কারণ। তবে এসব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মাঝেও শান্তিরক্ষীরা নানা ধরনের সাফল্য অর্জন করছেন।
আমি একে মধ্যবর্তী সাফল্য বলি। তবে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের সুরক্ষা। প্রতিদিন লাখো মানুষ শান্তিরক্ষীদের দ্বারা সুরক্ষিত হচ্ছেন।
এ ছাড়া অস্ত্রবিরতির পর্যবেক্ষণও বড় সাফল্য। অস্ত্রবিরতি বজায় রাখা মানেই নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়া ঠেকানো। এটিও মূলত সাধারণ মানুষের সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমরা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান এবং সাইপ্রাসে এ ধরনের কাজ করছি। এসবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সুতরাং সাফল্যের মানদণ্ড নানা রকম। তবে প্রতিদিন মাঠপর্যায়ে শান্তিরক্ষীরা যে বিশাল পার্থক্য তৈরি করেন, সেটিই আসল বিষয়।
স্ট্রিম: বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম শীর্ষ সেনা-অবদানকারী দেশ। তো এ বিষয়ে আপনি বাংলাদেশের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এ দেশের সঙ্গে আমাদের দৃঢ় অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা রয়েছে। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ সবসময়ই শক্তিশালী সমর্থন দিয়ে আসছে।
বাংলদেশ প্রায়ই এক নম্বর বা দুই নম্বর সেনা-অবদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে তালিকার শীর্ষে থাকে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা উচ্চ মানের পেশাদারিত্ব, সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের ছাড়া শান্তিরক্ষা কার্যক্রম ভিন্ন রূপ নিত। আজ যে সাফল্য আমরা দেখি, তা সম্ভব হতো না।
আমি নিজে বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে তাঁদের কাজ প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁরা স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন, সম্প্রদায়কে সহায়তা করেছেন, সুরক্ষা দিয়েছেন, অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা স্বাগতিক রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছেন।
আমরা বাংলাদেশের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। শান্তিরক্ষায় দেশটি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম।
স্ট্রিম: কিছু সংঘাতপূর্ণ এলাকায় আমরা দেখি, বড় শক্তিগুলো বিপরীত অবস্থানে থাকে। সেসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কীভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: যখন আমাদের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং আমরা ম্যান্ডেট পাই, তখন আমরা সেই ম্যান্ডেট কঠোরভাবে মেনে চলি। ম্যান্ডেট আমাদের নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন থাকতে বাধ্য করে। এটি একটি মৌলিক নীতি। এই নীতির প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হবে।
তবে এটা সহজ নয়, কারণ অনেক সময় এক পক্ষ আশা করে আমরা তাদের দিকে ঝুঁকব। কিন্তু আমাদের প্রতিশ্রুতি খুবই দৃঢ়। মাঠপর্যায়ে যা ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন করার সময় আমরা সবসময় নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতার নীতি মেনে চলি। এটি আমাদের শান্তিরক্ষীদের বিশ্বাসযোগ্যতার মূল ভিত্তি। সহকর্মীরা সবাই জানেন, এই নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য।
স্ট্রিম: ইউক্রেনে পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। সেখানে যদি শান্তিরক্ষা মিশন হয়, বাংলাদেশও যোগ দিতে পারে বলে রিপোর্টে এসেছে। এ বিষয়ে আলোচনা কতদূর এগিয়েছে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা মূলত যুদ্ধেরই অব্যাহত ধারা দেখছি। এর ভয়াবহ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। যুদ্ধবিরতি অবশ্যই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শেষ পর্যন্ত এ সংঘাতের সমাধানও হওয়া উচিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে।
জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা নিয়ে আমরা এখনো কিছু পরিকল্পনা করিনি। কারণ এ বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। আমাদের কোনো ম্যান্ডেটও দেওয়া হয়নি।
তবে অনেক সম্ভাব্য পরিস্থিতি কল্পনা করা যায়। যেমন—যদি অস্ত্রবিরতি হয় এবং উভয় পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছায়, তাহলে তারা তৃতীয় পক্ষকে অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে পারে। এটি একটি সম্ভাব্য দৃশ্য। আরও নানা রকম পরিস্থিতি কল্পনা করা যায়।
আর যদি জাতিসংঘকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে বলা হয়, উভয় পক্ষের সম্মতি ও নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন থাকলে, আমরা অবশ্যই সাড়া দেব। তবে আপাতত এ সবই কেবল অনুমান।
স্ট্রিম: শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ঝুঁকি নিয়ে কথা বলি। আমরা দেখেছি অনেক শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। অনেকে জীবনও হারিয়েছেন। জাতিসংঘ কীভাবে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে? আর যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের এবং তাঁদের দেশের প্রতি জাতিসংঘ কীভাবে সম্মান প্রদর্শন করে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পরিচালিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেক শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও অনেকেই জাতিসংঘ ও শান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
আমাদের দায়িত্ব হলো শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মাইন ও বিস্ফোরকজনিত ঝুঁকি কমানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি, যাতে এসবের কারণে প্রাণহানি রোধ করা যায়।
আমরা ড্রোন হামলার ঝুঁকিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি। শান্তিরক্ষীদের ক্যাম্প ও ঘাঁটি সুরক্ষার ব্যবস্থায় নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সহায়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। হতাহতদের উদ্ধারের ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা টেলিমেডিসিন ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি, যা অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে জীবন রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
নিরাপত্তা জোরদারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার অনেকগুলোই এসেছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বেচ্ছা অনুদান থেকে। আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। নিরাপত্তা পরিষদ শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে চীনের উদ্যোগে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া শান্তিরক্ষীদের সুরক্ষার জন্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর একটি গ্রুপ এবং জাতিসংঘের নিজস্ব একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়মিত কাজ করছে।
তবে হুমকিগুলোর ধরন ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই আমাদেরও এসব ঝুঁকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রস্তুত হতে হচ্ছে।
স্ট্রিম: আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। বাংলাদেশের জনগণ ও আমাদের দর্শকদের পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ।
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: ধন্যবাদ।
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার এবং ফ্র্যাঙ্কোফোনি বিষয়ক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর আগে তিনি সুইডেনে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত, ফ্রান্সের প্রধান প্রোটোকল কর্মকর্তা, নিউইয়র্কে জাতিসংঘে ফ্রান্সের স্থায়ী মিশনে ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি, প্রাগের ফরাসি দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন এবং ওয়াশিংটনে ফরাসি দূতাবাসে প্রথম সচিব ও পরে দ্বিতীয় কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ফরাসি প্রধানমন্ত্রীদের কেবিনেটে উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন।
১৯৬০ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করা জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া ইকোনমিক ও কমার্শিয়াল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট (ইএসএসইসি), পলিটিক্যাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউট-সায়েন্সেস পো প্যারিস এবং ন্যাশনাল স্কুল অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইএনএ) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া ২৫ বছরের বেশি কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি শান্তিরক্ষার সাফল্যের মাপকাঠি, শীর্ষ সেনা-অবদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অপরিহার্য ভূমিকা, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কৌশল এবং ইউক্রেনের মতো সংঘাতে জাতিসংঘের সম্ভাব্য ভূমিকা তুলে ধরেন।
এছাড়া তিনি শান্তিরক্ষীদের জীবন সুরক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তার আলোচনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মানবিক দিকটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
স্ট্রিম: প্রথমেই জানতে চাই, জাতিসংঘ কীভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সাফল্যকে সংজ্ঞায়িত করে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: সাফল্যকে নানা দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। আমার মতে, চূড়ান্ত সাফল্য তখনই আসে যখন কোনো দেশ শান্তিরক্ষা মিশনের সহায়তায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে স্থিতিশীলতা অর্জন করে ও সংঘাত কাটিয়ে ওঠে।
এমন সাফল্য ইতিমধ্যে বহু দেশে ঘটেছে। কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, লাইবেরিয়া, কোট দিভোয়ার, সিয়েরা লিওন, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিকসহ আরও অনেক দেশ এর উদাহরণ।
তবে এই সাফল্য অর্জনের জন্য শুধু জাতিসংঘ বা শান্তিরক্ষা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হওয়া। এটি সম্ভব হয় তখনই, যখন সদস্যরাষ্ট্র ও সব অংশীদারের শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকে।
আজকের বাস্তবতায় অনেক শান্তি প্রক্রিয়া ধীর বা সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বিভাজন এর বড় কারণ। তবে এসব রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মাঝেও শান্তিরক্ষীরা নানা ধরনের সাফল্য অর্জন করছেন।
আমি একে মধ্যবর্তী সাফল্য বলি। তবে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের সুরক্ষা। প্রতিদিন লাখো মানুষ শান্তিরক্ষীদের দ্বারা সুরক্ষিত হচ্ছেন।
এ ছাড়া অস্ত্রবিরতির পর্যবেক্ষণও বড় সাফল্য। অস্ত্রবিরতি বজায় রাখা মানেই নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়া ঠেকানো। এটিও মূলত সাধারণ মানুষের সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমরা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান এবং সাইপ্রাসে এ ধরনের কাজ করছি। এসবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সুতরাং সাফল্যের মানদণ্ড নানা রকম। তবে প্রতিদিন মাঠপর্যায়ে শান্তিরক্ষীরা যে বিশাল পার্থক্য তৈরি করেন, সেটিই আসল বিষয়।
স্ট্রিম: বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম শীর্ষ সেনা-অবদানকারী দেশ। তো এ বিষয়ে আপনি বাংলাদেশের ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এ দেশের সঙ্গে আমাদের দৃঢ় অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা রয়েছে। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ সবসময়ই শক্তিশালী সমর্থন দিয়ে আসছে।
বাংলদেশ প্রায়ই এক নম্বর বা দুই নম্বর সেনা-অবদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে তালিকার শীর্ষে থাকে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা উচ্চ মানের পেশাদারিত্ব, সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের ছাড়া শান্তিরক্ষা কার্যক্রম ভিন্ন রূপ নিত। আজ যে সাফল্য আমরা দেখি, তা সম্ভব হতো না।
আমি নিজে বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে তাঁদের কাজ প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁরা স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন, সম্প্রদায়কে সহায়তা করেছেন, সুরক্ষা দিয়েছেন, অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা স্বাগতিক রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছেন।
আমরা বাংলাদেশের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। শান্তিরক্ষায় দেশটি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম।
স্ট্রিম: কিছু সংঘাতপূর্ণ এলাকায় আমরা দেখি, বড় শক্তিগুলো বিপরীত অবস্থানে থাকে। সেসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কীভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: যখন আমাদের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং আমরা ম্যান্ডেট পাই, তখন আমরা সেই ম্যান্ডেট কঠোরভাবে মেনে চলি। ম্যান্ডেট আমাদের নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন থাকতে বাধ্য করে। এটি একটি মৌলিক নীতি। এই নীতির প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হবে।
তবে এটা সহজ নয়, কারণ অনেক সময় এক পক্ষ আশা করে আমরা তাদের দিকে ঝুঁকব। কিন্তু আমাদের প্রতিশ্রুতি খুবই দৃঢ়। মাঠপর্যায়ে যা ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন করার সময় আমরা সবসময় নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতার নীতি মেনে চলি। এটি আমাদের শান্তিরক্ষীদের বিশ্বাসযোগ্যতার মূল ভিত্তি। সহকর্মীরা সবাই জানেন, এই নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য।
স্ট্রিম: ইউক্রেনে পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। সেখানে যদি শান্তিরক্ষা মিশন হয়, বাংলাদেশও যোগ দিতে পারে বলে রিপোর্টে এসেছে। এ বিষয়ে আলোচনা কতদূর এগিয়েছে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা মূলত যুদ্ধেরই অব্যাহত ধারা দেখছি। এর ভয়াবহ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। যুদ্ধবিরতি অবশ্যই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শেষ পর্যন্ত এ সংঘাতের সমাধানও হওয়া উচিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব অনুসারে।
জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা নিয়ে আমরা এখনো কিছু পরিকল্পনা করিনি। কারণ এ বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। আমাদের কোনো ম্যান্ডেটও দেওয়া হয়নি।
তবে অনেক সম্ভাব্য পরিস্থিতি কল্পনা করা যায়। যেমন—যদি অস্ত্রবিরতি হয় এবং উভয় পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছায়, তাহলে তারা তৃতীয় পক্ষকে অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে পারে। এটি একটি সম্ভাব্য দৃশ্য। আরও নানা রকম পরিস্থিতি কল্পনা করা যায়।
আর যদি জাতিসংঘকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে বলা হয়, উভয় পক্ষের সম্মতি ও নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন থাকলে, আমরা অবশ্যই সাড়া দেব। তবে আপাতত এ সবই কেবল অনুমান।
স্ট্রিম: শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ঝুঁকি নিয়ে কথা বলি। আমরা দেখেছি অনেক শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। অনেকে জীবনও হারিয়েছেন। জাতিসংঘ কীভাবে তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে? আর যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের এবং তাঁদের দেশের প্রতি জাতিসংঘ কীভাবে সম্মান প্রদর্শন করে?
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পরিচালিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেক শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও অনেকেই জাতিসংঘ ও শান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
আমাদের দায়িত্ব হলো শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মাইন ও বিস্ফোরকজনিত ঝুঁকি কমানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি, যাতে এসবের কারণে প্রাণহানি রোধ করা যায়।
আমরা ড্রোন হামলার ঝুঁকিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছি। শান্তিরক্ষীদের ক্যাম্প ও ঘাঁটি সুরক্ষার ব্যবস্থায় নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সহায়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। হতাহতদের উদ্ধারের ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা টেলিমেডিসিন ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি, যা অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে জীবন রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
নিরাপত্তা জোরদারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার অনেকগুলোই এসেছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বেচ্ছা অনুদান থেকে। আমরা এ জন্য কৃতজ্ঞ। নিরাপত্তা পরিষদ শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে চীনের উদ্যোগে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া শান্তিরক্ষীদের সুরক্ষার জন্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর একটি গ্রুপ এবং জাতিসংঘের নিজস্ব একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ নিয়মিত কাজ করছে।
তবে হুমকিগুলোর ধরন ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই আমাদেরও এসব ঝুঁকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রস্তুত হতে হচ্ছে।
স্ট্রিম: আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। বাংলাদেশের জনগণ ও আমাদের দর্শকদের পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ।
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া: ধন্যবাদ।
জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার এবং ফ্র্যাঙ্কোফোনি বিষয়ক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এর আগে তিনি সুইডেনে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত, ফ্রান্সের প্রধান প্রোটোকল কর্মকর্তা, নিউইয়র্কে জাতিসংঘে ফ্রান্সের স্থায়ী মিশনে ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি, প্রাগের ফরাসি দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অব মিশন এবং ওয়াশিংটনে ফরাসি দূতাবাসে প্রথম সচিব ও পরে দ্বিতীয় কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ফরাসি প্রধানমন্ত্রীদের কেবিনেটে উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন।
১৯৬০ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করা জ্যঁ পিয়ে লাখোয়া ইকোনমিক ও কমার্শিয়াল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট (ইএসএসইসি), পলিটিক্যাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউট-সায়েন্সেস পো প্যারিস এবং ন্যাশনাল স্কুল অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইএনএ) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
এই নির্বাচন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? যদি এতটা গুরুত্বপূর্ণই হয়ে থাকে, তাহলে কেন তেত্রিশ বছর এটা হতে পারল না? শিক্ষার্থীদের একটা নির্বাচিত সংসদ থাকলে কী পরিবর্তন ঘটতে পারে? এসবই আপাপত ভাবনার বিষয়।
১৬ দিন আগেএই নির্বাচনে আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাইবার বুলিং। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে একটি গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত অনলাইনে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
২১ দিন আগেএ ঘটনায় সরকারের প্রতিক্রিয়াও তাই সীমিত। তারা কেবল ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়েছে। অনেকেই সরকারের এ প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করেছেন। কারণ, সরকারে থেকেও এমন দায়সারা প্রতিক্রিয়া দিলে তা একধরনের অসংগত অবস্থানই প্রকাশ করে।
৩১ আগস্ট ২০২৫আজ দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। দেশের প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নিয়ে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লাজিম আল মুত্তাকিনের সঙ্গে কথা বলেছে স্ট্রিম।
২৮ আগস্ট ২০২৫