leadT1ad

ভারতের বিহারে নির্বাচন

মৃতদের রাখা হয়েছে নতুন ভোটার তালিকায়, মুসলমানেরা তালিকার বাইরে

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ১০
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ২০: ০০
নতুন ভোটার তালিকায় আছেন মৃতরাও, বাদ মুসলিমরা

ভারতের নির্বাচন কমিশন উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারে নির্বাচনের আগে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে কয়েকদিন আগে। বিহার রাজ্যে আগামী নভেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এক মাসব্যাপী পর্যালোচনার পর নির্বাচন কমিশন এই খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করে।

কিন্তু বিরোধী দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ভোটার তালিকা প্রকাশের প্রক্রিয়া তাড়াহুড়ো করে সম্পন্ন করা হয়েছে। বিহারের কয়েকজন ভোটারও বিবিসিকে বলেছেন, তালিকায় প্রচুর ভুল ছবি যুক্ত করা হয়েছে। এমনকি অনেক মৃত মানুষকেও তালিকায় রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ভোট চুরি’র অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনের তালিকার ত্রুটিগুলো তুলে ধরেন। এসময় তিনি একই ঠিকানায় ভোটার হিসেবে কয়েক ডজন লোক এবং একই ঠিকানায় একাধিক বর্ণ ও ধর্মের লোকের নিবন্ধনের কথা তুলে ধরেন।

রাহুল গান্ধীর সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে, ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভোট চুরি’ ও ‘ভোট চুরি এক্সপোজড’ এর মতো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে। ভোটার তালিকার অসঙ্গতি ও ত্রুটি পোস্ট করে নির্বাচনী অনিয়ম তুলে ধরছেন অনেকে।

আজ সোমবার (১১ আগস্ট) বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ‘ভোট চুরি’ ইস্যুতে সংসদ থেকে নির্বাচন কমিশন অফিস পর্যন্ত একটি প্রতিবাদ মিছিলও করেছেন। সেই মিছিল থেকে রাহুল গান্ধীসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে আটক করা হয়।

এ ছাড়া আজই কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ‘ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স’ এর সংসদ সদস্যদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করবেন। সেখানে বিহারের ভোটার তালিকার ব্যাপক পর্যালোচনা এবং ‘নির্বাচনী কারচুপির’ বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এসআইআর এর তথ্য ও পরিসংখ্যান

নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনের এই বিশেষ প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছে¬- স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর। গত ২৫ জুন থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত মাসব্যাপী এই পর্যালোচনা চলেছিল।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, এই সময়ের মধ্যে কর্মকর্তারা বিহার রাজ্যের ৭৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন নিবন্ধিত ভোটারের বাড়িতে গিয়ে তাদের তথ্য পরীক্ষা করেছেন। কমিশন জানিয়েছে, ২০০৩ সালে শেষবার ভোটার তালিকার সংশোধন করা হয়েছিল। এখন তা হালনাগাদ করা প্রয়োজন।

নতুন এই তালিকায় ৭ কোটি ২৪ লাখ নাম রয়েছে। অর্থাৎ আগের তালিকার তুলনায় ৬৫ লাখ নাম কম রয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এই ৬৫ লাখ মানুষের মধ্যে ২২ লাখ মারা গেছেন। ৭ লাখ ভোটার দুবার নিবন্ধিত হয়েছিলেন। ৩৬ লাখ ভোটার বিহার ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে সেখানেই নিবন্ধন করেছেন।

তালিকা সংশোধনের জন্য ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬৫ হাজারেরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সারা দেশে প্রায় একশো কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই করার জন্য একই রকম পর্যালোচনা করা হবে।

তবে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে তালিকা থেকে অনেক নাম বাদ দিয়েছে। বিশেষ করে বিহারের চারটি সীমান্তবর্তী জেলায় বিপুল সংখ্যক মুসলমান বাসিন্দার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর আরও অভিযোগ, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার জন্যই এটা করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন ও বিজেপি অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিবিসি জানতে চাইলে, নির্বাচন কমিশন তাদের ২৪ জুনের আদেশ ও ২৭ জুলাইয়ের একটি প্রেস নোট শেয়ার করে। সেখানে বলা হয়েছে, সকল যোগ্য ভোটারকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন মুছে ফেলা নামের তালিকা বা ধর্ম অনুসারে ভোটারদের কোনও বিভাজন প্রকাশ করেনি। তাই বিরোধীদের উদ্বেগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর এক জরিপে দেখা গেছে, বিহারের কুচিনগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি মুসলমানদের বাস। আর কোনও মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় এতো বেশি ভোটারকে বাদ দেওয়া হয়নি।

‘গণতন্ত্রের জন্য হুমকি’

বিরোধী দলের সদস্যরা এই পরিস্থিতিকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে আখ্যা দিয়ে এ নিয়ে সংসদে বিতর্কের দাবিও জানিয়েছেন। সংসদের বাইরে বিক্ষোভকারীরা ‘মোদি মুর্দাবাদ’, ‘এসআইআর ওয়াপাস লো’ এবং ‘ভোট চুরি বন্ধ করো’ স্লোগান দিয়েছেন।

এই তালিকার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেরও দ্বারস্থ হয়েছেন তারা। কোর্ট বিষয়টির শুনানি করছে। নির্বাচন সংস্কার সংস্থাও ‘এডিআর’ এর সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এডিআরের প্রধান জগদীপ চোকর বিবিসিকে বলেছেন, ‘বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র তিন মাস আগে প্রক্রিয়াটি ঘটছে। ফলে তা সম্পন্ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়নি।’

তাঁর মতে প্রতিবেদনগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, তথ্য সংগ্রহে অনিয়ম ও গুরুতর ত্রুটি রয়েছে।

আদালতে, এডিআর যুক্তি দেখিয়ে বলে, এই প্রক্রিয়া লাখ লাখ প্রকৃত ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। বিশেষ করে বিহারের মতো একটি দরিদ্র রাজ্যে, যেখানে বিপুল সংখ্যক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে।

এডিআর বলেছে, এসআইআর নাগরিকত্ব প্রমাণের ভার মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তাও করতে হচ্ছে স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের ও পিতামাতার জন্য নথি জমা দিয়ে। দরিদ্র শ্রমিকদের জন্য এটি করা প্রায় অসম্ভব এক কাজ।

অন্তর্বর্তীকালীন তালিকা প্রকাশ করার সময় বিবিসির একটি দল পাটনা ও আশেপাশের গ্রামে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে।

দিনারা নামে সেখানকার একটি গ্রামে ‘মহা দলিত’নামে পরিচিত খুবই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাস করেন। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই মাঠে কাজ করে খায় অথবা বেকার। তাদের ঘরবাড়ির অবস্থাও খারাপ। গ্রামটির রাস্তাগুলো খুবই সরু, ড্রেনগুলো খোলা। আর স্থানীয় মন্দিরের পাশে রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত পুকুর।

গ্রামটির বেশিরভাগ মানুষই এসআইআর বা এর প্রভাব সম্পর্কে কিছুই জানত না। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে যায়ওনি। গ্রামের বাসিন্দারা তাদের ভোটের মূল্য নিয়েও বেশ সচেতন। বিবিসির গীতা পান্ডেকে গ্রামটির বাসিন্দা রেখা দেবী বলেন, ‘ভোটের অধিকার হারানো ধ্বংসাত্মক হবে। এটা আমাদের আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।’

খারিকা নামের আরেকটি গ্রামের বেশ কয়েকজন পুরুষ বলেছেন তারা এসআইআর সম্পর্কে শুনেছেন। পাশাপাশি নতুন ছবি তুলতে গিয়ে ৩শ রুপি খরচ করে ফর্মও জমা দিয়েছেন।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তারকেশ্বর সিং বলেন, ‘ব্যাপারটি পুরোপুরি গোলমেলে’। পরিবারের নামপরিচয়ের বিবরণের কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ভোটার তালিকায় এসবের মধ্যে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। যেমন তাঁর নামের পাশে অন্য কারো ছবি বসে গেছে।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না এটা কার ছবি’। বিবিসির প্রতিবেদককে তিনি জানান, তালিকায় তার স্ত্রী ও ছেলেরও ভুল ছবি ওঠেছে। তার এক ছেলের নামের পাশে অজ্ঞাত এক নারীর ছবি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “এসব প্রমাণ করে, ভোটার তালিকা তৈরিতে কোনও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। তালিকায় মৃত ব্যক্তির নাম রয়েছে। ফর্মই পূরণ করেননি এমন ব্যক্তির নামও আছে। এটি সরকারি সম্পদ। কোটি কোটি টাকার অপচয়।’

আদালতে আপিল

এডিআরের জগদীপ চোকর বিবিসিকে বলেন, তিনি এই সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি তুলে ধরবেন। আদালত জুলাই মাসে বলেছিল, আবেদনকারীরা যদি তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন এমন ১৫ জন প্রকৃত ভোটারের নাম দিতে পারেন, তাহলে তালিকাটি স্থগিত করা হবে।

জগদীপ চোকরের মতে, একজন বিচারক পরামর্শ দিয়েছেন, যথাযথ পর্যালোচনায় সময় দেওয়ার জন্য আসন্ন নির্বাচন থেকে প্রক্রিয়াটি আলাদা করা উচিৎ।

এসআইআর ও অন্তর্বর্তীকালীন তালিকা বিহারের রাজনীতিতেও বিভাজন তৈরি করেছে। বিরোধী রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন বিজেপির মিত্র জনতা দল (ইউনাইটেড) এটিকে সমর্থন করছে।

আরজেডির সাধারণ সম্পাদক শিবানন্দ তিওয়ারি বলেন, সংশোধনের জটিলতা মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।

কমিশনের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার ফর্ম পূরণ করেছেন। বেশিরভাগ গ্রামে আমাদের কর্মীরা জানিয়েছেন, ব্লক স্তরের কর্মকর্তা (যিনি সাধারণত স্থানীয় স্কুল শিক্ষক) বাড়িতে পৌঁছাননি।

অনেক কর্মকর্তা প্রশিক্ষিত নন এবং ফর্ম আপলোড করার পদ্ধতিও জানেন না। কিন্তু কমিশন বলছে, এই কর্মকর্তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করেছেন।

তিওয়ারির অভিযোগ, কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট ও নির্বাচনে কারসাজি করছে। তাদের টার্গেট বিজেপিকে ভোট না দিতে ইচ্ছুক বিপুল সংখ্যক মুসলমানের বাসস্থান সীমান্তবর্তী এলাকা।

বিজেপি ও জেডি (ইউ) এই সমালোচনাকে রাজনৈতিক বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিজেপির ভীম সিং বলেছেন, ‘শুধু ভারতীয় নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে। আমরা বিশ্বাস করি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি সীমান্তবর্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে। তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া দরকার।’

তিনি আরও বলেন, কারো ধর্মের সঙ্গে এসআইআর এর কোনও সম্পর্ক নেই। বিরোধীরা তাদের পরাজয় দেখতে পেয়ে হৈচৈ করছে।

জেডিইউ মুখপাত্র এবং রাজ্য বিধায়ক নীরজ কুমার সিং বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন শুধু তার দায়িত্ব পালন করছে। অনেক ভোটারের নাম দু-তিনবার তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, এটা কি সংশোধন করা উচিৎ নয়?’

বিবিসি উর্দু থেকে অনুবাদ করেছেন সালেহ ফুয়াদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত