leadT1ad

নিজ সম্প্রদায়ের জন্য ত্যাগের এক অনন্য নজির

আবেগঘন খোলা চিঠি বিহারের তরুণ মুসলিম নেতার: নতুন রাজনীতির আহ্বান

আইআইটি মুম্বাই থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শারজিল ইমাম নামের এই তরুণ নিজ সম্প্রদায়ের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এ জন্য তিনি লাভজনক করপোরেট ক্যারিয়ারও ত্যাগ করেন। তিনি ভারতের মুসলিমসহ অন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছেন এবং রাষ্ট্রের কাঠামোগত বৈষম্য দূর করার জন্য আমূল সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন।

ইনস্ক্রিপ্ট প্রতিবেদকস্ট্রিম প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ২২
আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ২২
শারজিল ইমাম। সংগৃহীত ছবি

নিজ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে আবেগঘন এক খোলা চিঠি লিখেছেন ভারতের তরুণ মুসলিম নেতা শারজিল ইমাম। যিনি অ্যান্টি-সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আন্দোলনে প্ররোচণামূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সাল থেকে কারাগারে রয়েছেন। সম্প্রতি এই তরুণ জেল থেকেই আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও সীমান্তবর্তী ভারতের বিহার রাজ্যের জেলা কিষণগঞ্জের নির্বাচনী আসন বাহাদুরগঞ্জ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এই আসনের বাসিন্দাসহ সারা ভারতের মুসলমানদের উদ্দেশে তাঁর লেখা খোলা চিঠি মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে।

৩৫ বছর বয়সী শারজিল ইমাম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-আইআইটি, মুম্বাই থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। তিনি নিজের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার ছেড়ে নিজ সম্প্রদায়ের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তিনি লাভজনক করপোরেট ক্যারিয়ারও ত্যাগ করেছেন। চিঠিতে তিনি ভারতের মুসলিমসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেছেন এবং রাষ্ট্রের কাঠামোগত বৈষম্য দূর করার জন্য আমূল সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক সংগ্রাম ও ত্যাগের কথাও তুলে ধরেন।

নিজের জীবনকে স্বাভাবিক পথে চালানোর সব সুযোগই তাঁর সামনে ছিল। ভালো চাকরি, পরিবারের স্বচ্ছলতা, সন্তানদের নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ— সবকিছুই তিনি পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন অন্য এক পথ। সেই পথ ছিল কষ্টের, অনিশ্চয়তার, তবুও তিনি সেই পথে হেঁটেছেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন— নিজ সম্প্রদায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য ত্যাগই সবচেয়ে বড় শক্তি। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন তিনি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাসহ অসংখ্য কষ্টও সহ্য করেছেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি। অবশেষে ভয় ও বিভাজনের রাজনীতির বিপরীতে তার ঐক্য ও ন্যায় এবং রাষ্ট্র-রাজনীতির কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য ত্যাগের জীবন

শারজিল ইমাম চিঠিতে সংগ্রামের গল্পে গড়া এক ব্যক্তিগত জীবনের কথা শেয়ার করেছেন। তিনি জানান, তাঁর পৈতৃক বাড়ি বিহারের জাহানাবাদে হলেও তিনি বড় হয়েছেন পাটনায় নানার বাড়িতে। তাঁর বাপ-দাদার গ্রাম ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তার পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পাটনায় চলে আসে। ভূমিহীন এই পরিবারের সংগ্রাম চলছে এখনও। ফলে শৈশব থেকেই তিনি দেখেছেন, কীভাবে সাধারণ মুসলিম পরিবারগুলোকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। এই সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার গল্পই তাঁকে ভিন্নভাবে গড়ে তুলেছে।

শৈশবের এই অভিজ্ঞতা তাঁকে মানবিকতা, সহমর্মিতা এবং সামাজিক সচেতনতার দিকে পারিচালিত করে। তারপর তিনি পড়াশোনার জন্য এগিয়েছিলেন উচ্চতর শিক্ষার পথে। আইআইটি মুম্বাই থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ২০০৯ সালে তিনি ডেনমার্কে কয়েক মাস চাকরি করেছিলেন। এরপর ২০১১ সালে বেঙ্গালুরুতে বড় বেতনে চাকরি পান। এই সময়ে তার পক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে আরামদায়ক জীবনযাপন করা সম্ভব ছিল, কিন্তু তিনি বেছে নেন অন্য এক পথ।

এক বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। লাভজনক ক্যারিয়ার ছেড়ে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে যান। লক্ষ্য ছিল ইতিহাস থেকে ভারতের মুসলিমসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক হয়ে পড়ার কাঠামোগত মূল কারণ বোঝা। তিনি লিখেছেন, ‘শৈশবে যা শুনেছি ও দেখেছি, তা আমাকে কখনো চুপ থাকতে বা শান্তির জীবন বেছে নিতে দেয়নি।‘ এই পছন্দের মূল্য ছিল বড়। একই বছরে তিনি তাঁর বাবাকে হারান, যিনি জনগণের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তবুও তিনি হতাশ হননি। তিনি গবেষণা চালিয়ে যান এবং পাশাপাশি একটি সাধারণ চাকরি করেন।

অ্যান্টি-সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আন্দোলনে প্ররোচণামূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হন শারজিল ইমাম। সংগৃহীত ছবি
অ্যান্টি-সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আন্দোলনে প্ররোচণামূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হন শারজিল ইমাম। সংগৃহীত ছবি

ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতি থেকেই শারজিল ইমাম ২০১৯–২০২০ সালের নাগরিকত্ব বিষয়ক সিএএ-এনআরসি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে শাহিনবাগ আন্দোলনে, যেখানে তিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। এর জন্য তাঁকে বড় মূল্যও দিতে হয়। ৩২ বছর বয়সে প্রথমবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তার ভাষ্য, যেখানে তিনি ভিত্তিহীন অভিযোগের মুখোমুখি হন। গত পাঁচ বছর ছয় মাস ধরে তিনি কারাগারে বন্দি, শুধু তাঁর বিশ্বাস ও কিছু বই তাঁর সঙ্গী। তিনি লিখেছেন, ‘সাড়ে পাঁচ বছর ধরে জেলের কুঠুরিতে বন্দি আছি, যেখানে শুধু আল্লাহ আমার সঙ্গী আর কিছু বই, যা অন্ধকারে আলোর মতো।’

সাতটি মামলার মধ্যে ছয়টিতে জামিন পেলেও শারজিল ইমাম এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, সুপ্রিম কোর্ট শিগগিরই তাঁকে মুক্তি দেবে।

ব্যবস্থাগত সংস্কারের আহ্বান

শারজিল ইমামের এই চিঠি কেবল একটি ব্যক্তিগত সাক্ষ্য নয়, এতে ভারতের রাষ্ট্র ও রাজনীতির ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের জন্যও জোরালো আহ্বান জানেোনা হয়। তিনি কংগ্রেসের মতো দলগুলোর সমালোচনা করেন, যাঁরা সম্প্রদায়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে এবং ব্যবস্থাগত ত্রুটিগুলো উপেক্ষা করেছে। চিঠির শুরুতেই ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মুসলিমদের যে অসহায়ত্ব তা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি নির্বাচনব্যবস্থার দুর্বলতা, সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেছেন।

শারজিল ইমাম লেখেন, ‘আজ দেশের পরিস্থিতি কেমন, তা আপনাদের বলার দরকার নেই। বিশেষ করে আমাদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আপনারা নিজের চোখে দেখছেন। এই পরিবেশে একটাই প্রশ্ন আমাদের যুবকদের, পড়াশোনা করা মানুষদের এবং সাধারণ জনগণের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে— এখন আমরা কী করব, কোন পথ বেছে নেব? মনে হচ্ছে আমরা একেবারে অসহায়, কিছুই করতে পারছি না, শুধু একসঙ্গে এসে সেই দল বা প্রার্থীকে ভোট দেব যারা বিজেপিকে হারানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, এমনকি সেই আসনেও যেখানে বিজেপি লড়াই করছে না। এই প্রতিশ্রুতি ছাড়া কি আর কিছুর প্রয়োজন নেই? এই ব্যবস্থায় কি এমন কোনো ত্রুটি নেই, যা ঠিক করার জন্য আমাদের একত্রিত হওয়া উচিত? সীমাঞ্চলের মতো এলাকায়, যেখানে আমরা আমাদের নেতৃত্বকে আমাদের সম্প্রদায়ের এবং আঞ্চলিক সমস্যার ভিত্তিতে বেছে নিতে পারি, সেখানেও কি আমরা শুধু বিজেপির ভয়ে ভোট দেব?’

ইতিহাস নিয়ে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে শারজিল ইমাম যুক্তি দেন যে, ১৯৪৭ সাল থেকে মুসলিমদের ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে পদ্ধতিগতভাবে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। তিনি হাসরত মোহানি এবং সাচার কমিটির রিপোর্টের মতো ঐতিহাসিক কণ্ঠস্বরের উল্লেখ করে মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। মুসলিম এবং অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের ব্যবস্থাগত অধিকারহীনতা দূর করার লক্ষ্যে তাঁর প্রস্তাবগুলো সাহসী এবং সুনির্দিষ্ট। শারজিল ইমাম বলেছেন, ‘পথ খুলবে তখনই, যখন আমরা সেই মৌলিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করব, যা আমাদের জরুরি প্রয়োজন।‘

সেই মৌলিক পরিবর্তনগুলো কী? শারজিল ইমামের মূল দাবিগুলোর মধ্যে একটি হলো নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রবর্তন করা। তিনি লিখেছেন, ‘যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, তাকে তত শতাংশ আসন দিতে হবে।’ চিঠিতে তিনি বর্তমান পদ্ধতির অন্যায় তুলে ধরেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, বর্তমানে ভোটের ব্যবস্থায় একটি দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলেও হারতে পারে, আর শেষে রাজ্য মাত্র কয়েকজন (পাঁচ থেকে সাত শতাংশ) বিধায়ক পায়। এই অকার্যকর ব্যবস্থা সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অধিকার সীমিত করে। উদাহরণ হিসেবে উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) কথা উল্লেখ করেন, যারা ২০১৭ ও ২০২২ সালে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েও মাত্র কয়েকটি (দু-তিনটি) আসন পেয়েছে। সমানুপাতিক পদ্ধতিতে বিহারে ১৫ শতাংশ ভোট পাওয়া দলের ৩৬ জন বিধায়ক থাকা উচিত, যা ছোট সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে।

শারজিল ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য জনসংখ্যার সমানুপাতে আসন সংরক্ষণের পক্ষে কথা বলেন। মুসলিম জনসংখ্যা ১৮ শতাংশ হলে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ আসন সংরক্ষিত হওয়া উচিত, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পশমান্দা (পিছিয়ে পড়া) মুসলিমদের জন্য বরাদ্দ হওয়া উচিত।

ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মুসলিমদের স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলা

শারজিল ইমাম ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘যেকোনো ধর্মীয় বিষয়, যা তাদের ধর্মীয় ব্যাপারের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধু সেই ধর্মের মানুষেরই থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াকফের বিষয়—বর্তমান ওয়াকফ-ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু তা সংশোধনের অধিকার, দায়িত্ব এবং ক্ষমতা শুধু মুসলিম জনগণেরই থাকবে, যারা গণতান্ত্রিকভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের কথা বলবে।’

হিন্দুত্ববাদকে মোকাবিলায় মুসলিমদের স্বতন্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি লেখেন, ‘আজ হিন্দুত্বের বিষ যেভাবে আমাদের ঘিরে ফেলেছে, ঘৃণার রাজনীতি আমাদের অসহায় করে দিয়েছে, আরএসএস-বিজেপি এই সিস্টেমের প্রতিটি কোণ কব্জা করে নিয়েছে—এসব সত্য। কিন্তু যেখানে তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, সেখানেও যদি আমরা ভয়ে আমাদের চিন্তাশক্তিকে মেরে ফেলি, আমাদের মনকে বন্ধ করে দিই, তাহলে আমরা এই লড়াই আগেই হেরে গেছি।’

“কাশ্মীর, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ, মালাবার, হায়দরাবাদ, মুম্বাই, পশ্চিম আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের সীমাঞ্চলে আমরা আমাদের মৌলিক সমস্যা এবং সংবিধানের ত্রুটিগুলো নিয়ে আলোচনা করে একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি। এটি আপনাদের দায়িত্বও বটে, সুযোগও বটে। বিশেষ করে বিহারে, যেখানে বিজেপি অর্ধেক আসনে লড়েই না, আমরা একটি পরিকল্পনা করে, ঝুঁকি নিয়ে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি।’

ইমাম আরও লেখেন, ‘বাহাদুরগঞ্জ থেকে নির্বাচনে লড়ার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই যে আজ যে বিপদ আমরা আসামে দেখছি, উত্তর প্রদেশে দেখছি, সেই একই বিপদ বিহারেও রয়েছে। দেশ এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের চিন্তাধারাকে একটা নতুন পথ দেখাতে হবেই। কেন আমরা নতুন পথের কথা ভাবতে পারছি না? এর সবচেয়ে বড় কারণ, আমাদের দিনরাত বিজেপির ভয় দেখানো হচ্ছে, এমনকি সেখানেও, যেখানে বিজেপি লড়ছে না। আর কংগ্রেসের মতো দল, যারা এই ব্যবস্থা তৈরি করেছে, এর সুযোগ নিয়েছে এবং আমাদের এই দুরবস্থায় ফেলে দিয়েছে, তারা চায় না আমরা এই ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর দিকে নজর দিই।

ইমাম আরও লেখেন, ‘তারা চায় আমরা সব সময় তাদের সামনে অসহায় হয়ে থাকি, যেন আমরা বলি, “আমাদের বিজেপির হাত থেকে বাঁচাও, আমাদের বাঁচতে দাও।’ তারা আমাদের কখনো ভাবতে দেবে না। আমাদের এই দলগুলোর কবল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্তত সেখানে যেখানে আমরা আমাদের রাজনীতি করতে পারি। যেখানে আমাদের জনসংখ্যা কম, সেখানে আমরা বিজেপিকে হারানোর জন্য ভোট দেব, কিন্তু যেখানে আমরা নিজেরা জিততে পারি, সেখানে আমরা এই রাজনীতি করব না কেন?”’

এ প্রসঙ্গে শারজিল ইমাম কংগ্রেসসহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোরও সমলোচনা করেন। তিনি লেখেন, ‘অন্যদিকে, যে দলগুলো গত ৩০-৪০ বছর ধরে শুধু আবেগপ্রবণ স্লোগান আর ভাষণের ওপর চলছে, তারা কখনো সংবিধানের ত্রুটিগুলো নিয়ে কথা বলার সাহস করেনি। এই সময়ে তাদের রাজনীতি থেকে কী অর্জন হয়েছে? পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আপনারা যে ব্যক্তিকে বিধায়ক বানিয়েছেন তাঁদের আবেগপ্রবণ বক্তৃতা শুনে— তাঁরা দল বদলেছে দুদিন পর। এমন মানুষ কি ভরসার যোগ্য হতে পারে? যখন কোনো পরিকল্পনা থাকে না, শুধু আবেগপ্রবণ স্লোগান আর লোভ থাকে, তখন এমন মানুষই জনতার প্রতিনিধি হতে চায়।‘

চিঠিতে ইমাম আরও লেখেন, ‘আমি যাদের বিরুদ্ধে লিখছি, তারা নিশ্চয়ই বলবে আমি ভোট কাটার কাজ করছি, বলবে পাগল, আরও নানা তকমা জুটবে! পাগল তো আমি বটেই— চাকরি করলে এতদিনে আমার বেতন কোটি টাকায় পৌঁছে যেত। সেই চাকরি ছেড়ে, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে আমি আমার সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো বোঝার জন্য বেরিয়েছি, আর এখন সাড়ে পাঁচ বছর ধরে জেলের কুঠুরিতে বন্দি আছি, যেখানে শুধু আল্লাহ আমার সঙ্গী আর কিছু বই, যা অন্ধকারে আলোর মতো। আমি মুম্বই থেকে নির্বাচন লড়ছি না যে টাকা রোজগার হবে। আমি ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা থেকে নির্বাচন লড়ছি। বিজেপি তো সেখানে লড়েই না।‘

ইমাম বাহাদুরগঞ্জের মানুষকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে ভয়-ভিত্তিক রাজনীতি অতিক্রম করে প্রান্তিকীকরণের মূল কারণগুলো মোকাবিলার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি লিখেছেন, ‘যতক্ষণ না আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করব এবং পরিবর্তনের বীজ বুনব, ততক্ষণ আমরা আমাদের ভোট নষ্ট করছি।’ তিনি সীমাঞ্চলকে কাশ্মীর থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত অন্যান্য প্রান্তিক অঞ্চলের জন্য একটি মডেল হিসেবে কল্পনা করেন, যেখানে প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকার দাবি করতে পারে।

ইমামের বার্তা স্পষ্ট— লড়াই শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে নয়, বরং সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা কয়েক দশক ধরে মুসলিম জনগোষ্ঠীসহ প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোকে ব্যর্থ করেছে। বাহাদুরগঞ্জ থেকে নির্বাচনে লড়ার মাধ্যমে তিনি পুরো ভারতের জন্যই এক নতুন রাজনীতির সূচনা করতে চান। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আমি বিধানসভায় আপনাদের প্রতিনিধিত্ব করব এমনভাবে, যেমনটি আর কেউ পারবে না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত