leadT1ad

ইন্দোনেশিয়ায় থামছে না বিক্ষোভ, সরকার পতনের আশঙ্কা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিক্ষোভ একটি বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। অর্থনৈতিক অসমতা, বৈষম্য ও দুর্নীতির মতো গুরুতর বিষয়গুলো এই বিক্ষোভকে তীব্র করেছে। তাদের মতে, এই বিষয়গুলোই এবারের আন্দোলনকে অন্যান্য বিক্ষোভ থেকে আলাদা করেছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ৪৫
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫২
ইন্দোনেশিয়াজুড়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সহিংস সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। সংগৃহীত ছবি

ইন্দোনেশিয়াজুড়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সহিংস সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এতে ইতিমধ্যেই অন্তত ৮ জন নিহত ও ২০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। আগুনে পুড়েছে ও লুট হয়েছে বহু সরকারি ভবন। পুলিশ হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানী জাকার্তায় দাঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়।

পরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। সোমবার জাকার্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। অন্য কয়েকটি শহরেও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। সুরাবায়া, বান্দুং, যোগ্যাকার্তা ও মাকাসারে প্রধান সড়কগুলোতেও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। জাকার্তার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মঙ্গলবার পর্যন্ত অনলাইনে ক্লাস নিয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের ঘরে বসে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই সময়ে সিভিল সমাজও সক্রিয় হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সড়ক বিক্ষোভের মাধ্যমে একটি সমবেত আন্দোলন তৈরি হয়। ডিজিটাল আহ্বান দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও ইনফ্লুয়েন্সাররা সরকারের কাছে এক সপ্তাহের মধ্যে পূরণযোগ্য দাবির তালিকা প্রচার করেন।

এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার টিকটক-এর লাইভস্ট্রিম ফিচার বন্ধ করে দেয়। এটি আন্দোলনের তথ্য শেয়ার এবং বিক্ষোভ সংগঠনের মূল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এই পরিস্থিতি প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ানতো’র জন্য বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র এক বছর হলো তিনি ক্ষমতায় এসেছেন।

বৈষম্য থেকে ক্রোধ

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন মতে, গত ২৫ আগস্ট প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়। সেদিন হাজারো মানুষ জাকার্তার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে জড়ো হয়। তাদের মূল অভিযোগ ছিল এমপিদের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়তি আবাসন ভাতা নিয়ে। এ ভাতা জাকার্তার ন্যূনতম মজুরির প্রায় দশ গুণ বেশি।

অথচ প্রেসিডেন্ট প্রাবোও জনগণের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যায়ে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন নীতি চালু করেছেন। এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গণপূর্ত খাতে বাজেট কমানো হয়েছে।

ইন্দোনেশীয় শিক্ষার্থীদের সংগঠন গেজায়ান মেমাঙ্গগিল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সরকারে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের’বিরুদ্ধেও তারা আন্দোলন করছে। তাদের মতে, সরকারি নীতি মূলত বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করছে।

বিক্ষোভ দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গত বৃহস্পতিবার ২১ বছরের এক রাইড শেয়ারকারী মোটরসাইকেল চালক জাকার্তায় নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুক্রবার তা আরও সহিংস হয়ে ওঠে।

ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দিয়ে একটি সাঁজোয়া গাড়ি চালিয়ে দেয় দেশটির অভিজাত প্যারামিলিটারি পুলিশের একটি দল। এতে ওই তরুণ বাইক চালক প্রাণ হারান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বিক্ষোভের ঢেউ দীর্ঘদিনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপের ফল। দেশটির মানুষের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা বেড়ে চলেছে। সাধারণ মানুষের সংগ্রামের প্রতি উদাসীন সরকারি নীতিগুলোও ক্রোধ বাড়িয়েছে। জনগণের প্রতি রাজনৈতিক অভিজাতদের সহমর্মিতাও শূন্য। এসব কারণে জনসমাজের অসন্তোষ তীব্র হয়েছে।

এমপিদের আবাসন ভাতা বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ২৫ আগস্ট বিক্ষোভ শুরু হয়। সংগৃহীত ছবি
এমপিদের আবাসন ভাতা বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ২৫ আগস্ট বিক্ষোভ শুরু হয়। সংগৃহীত ছবি

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ কর্মজীবি এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত। তাদের স্থায়ী আয় বা সামাজিক সুরক্ষা নেই। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ নিম্ন আয়ের শ্রেণিতে নামছে বা সম্পূর্ণ দারিদ্র্যের সঙ্গে মোকাবিলা করছে।

সেন্টার অফ ইকোনমিক অ্যান্ড ল স্টাডিজ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে প্রায় ১ কোটি ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে নিচের দিকে নেমেছে। এছাড়া খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চাকরির সুযোগ কমেছে।

২০২৫ সালের শুরুর কয়েকমাসেই ৪২ হাজারের বেশি কর্মজীবি চাকরি হারিয়েছে। পরে জুনে সরকার সরকারি চাকরি-হারানোর তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। সরকার কারণ দেখায়, এতে ‘জনমানসে আতঙ্ক’ সৃষ্টি হতে পারে।

এই বাস্তবতার মধ্যেই আগস্টে সংসদের বার্ষিক অধিবেশন চলাকালে আইনপ্রণেতাদের নাচ-গান করে ফূর্তির একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এটি দেশের বাস্তবতা থেকে অভিজাতদের বিচ্ছিন্নতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

ফলে সংসদ যখন এমপিদের জন্য মাসিক ৫০ মিলিয়ন রুপিয়া (প্রায় ২ হাজার ৬০০ ইউরো / ৩ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার) নতুন আবাসন ভাতা অনুমোদন করে, তখন জনক্রোধ আরও বেড়ে যায়। শুরু হয় বিক্ষোভ।

তার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাইড শেয়ারকারী বাইক চালক আফানের মৃত্যুতে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায়। দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম করা আফান হয়ে উঠেন ইন্দোনেশিয়ার জনগণের সংগ্রামের প্রতীক।

বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলো কী

আন্দোলনে বিভিন্ন দাবি উত্থাপিত হয়েছে। প্রধান দাবি হলো সংসদ সদস্যদের জন্য প্রস্তাবিত আবাসন ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা বাতিল করা। তবে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর সহিংসতা বেড়ে গেলে, দাবির তালিকাও বড় হয়। নাগরিকরা ‘১৭+৮’ শিরোনামে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

সরকারের কাছে ১৭টি জরুরি সমস্যা এক সপ্তাহের মধ্যে সমাধান করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে— আফান কুরনিওয়ান হত্যার বিচার, সেনাবাহিনীকে বেসামরিক নিরাপত্তা থেকে সরানো, আটক বিক্ষোভকারীদের মুক্তি, সহিংসতার দায়ে কর্মকর্তাদের বিচার এবং পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করা।

নাগরিকরা আরও আটটি কাঠামোগত দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে সংসদ, রাজনৈতিক দল ও জাতীয় পুলিশ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের মতো দাবিও রয়েছে। তারা সরকারকে এক বছরের মধ্যে এই দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য সময় বেধে দিয়েছে।

নাগরিকরা ১৭টি জরুরি সমস্যা সমাধানসহ ৮টি কাঠামোগত দাবি তুলেছেন। সংগৃহীত ছবি
নাগরিকরা ১৭টি জরুরি সমস্যা সমাধানসহ ৮টি কাঠামোগত দাবি তুলেছেন। সংগৃহীত ছবি

সরকারের প্রতিক্রিয়া

আন্দোলনের প্রথম থেকেই নিরাপত্তাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে। প্রেসিডেন্ট প্রাবোও রবিবার তার উচ্চপর্যায়ের চীন সফর বাতিল করে বড় এক সামরিক সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। বিক্ষোভের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, ‘প্রচুর আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রতি আমি আইন অনুযায়ী সরকারি স্থাপনা ধ্বংস, রাজনীতিবিদদের বাড়ি ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র লুটপাটের বিরুদ্ধে যতটা সম্ভব কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।’

তবে তিনি ঘোষণা করেন, সংসদ সদস্যদের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা কমানো হবে। বিদেশ সফরও সীমিত করা হবে। এটি বিক্ষোভকারীদের কিছুটা শান্ত করতে পারে।

প্রাবোও আরও বলেন, পুলিশ মোটর সাইকেল চালকের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। তিনি দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে জনগণ তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। নিহত বাইক চালকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণাও দেন।

সরকার পতনে বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা?

বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়ায় চলমান এই বিক্ষোভ কতদূর গড়াবে তা নিশ্চিত নয়। তবে ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটি প্রাবোও সুবিয়ান্তোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রাবোও টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করেছিলেন। অথচ বিক্ষোভ দমনে সেই তরুণদের উপরই ব্যাপক নির্যাতন করা হচ্ছে।

প্রাবোওকে অনেকে সেনাশাসক সুহার্তোর জামাতা হিসেবে মনে রেখেছেন। সুহার্তোর শাসনের অবসানও ঘটেছিল গণবিক্ষোভের মাধ্যমে। তাই প্রাবোও এই বিক্ষোভ সামলাতে সতর্ক থাকবেন।

পুরো জাকার্তাজুড়ে পুলিশ চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে, সেনাবাহিনী শহরে টহল দিচ্ছে এবং বিভিন্ন স্থানে স্নাইপার মোতায়েন করা হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো। সংগৃহীত ছবি
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো। সংগৃহীত ছবি

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিক্ষোভ একটি বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। অর্থনৈতিক অসমতা, বৈষম্য ও দুর্নীতির মতো গুরুতর বিষয়গুলো এই বিক্ষোভকে তীব্র করেছে। তাদের মতে, এই বিষয়গুলোই এবারের আন্দোলনকে অন্যান্য বিক্ষোভ থেকে আলাদা করেছে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ইন্দোনেশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ওয়ারবার্টন বিবিসেক বলেন, ‘গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার গণ আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এবারের বিক্ষোভ ভিন্ন। মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ অনেক গভীর এবং অর্থনৈতিক অনিরাপত্তাবোধ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’

অনেক বিক্ষোভকারী মনে করেন, এই বিক্ষোভ ইন্দোনেশিয়ার সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনতে পারে। ১৯৯৮ সালে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে সুহার্তোর পতনের পর যেভাবে সংস্কার হয়েছিল।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, ডয়চে ভেলে

Ad 300x250

ডাকসু নির্বাচনে নারীবিদ্বেষী সাইবার বুলিং: নারীর আত্মবিশ্বাসে আঘাত

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি বন্ধে কাজ করবে ইউজিসি ও ইউএন উইমেন

হাসিনা-ঘনিষ্ঠদের পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ: তিনটি রাজি, দুটি সময় চাইছে

স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য: নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকব না

কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ এক হলো

সম্পর্কিত