leadT1ad

ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ্ব বিভক্ত: জাতিসংঘের ওয়াকআউট কি নতুন মোড় আনছে

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০: ৫৩
নেতানিয়াহু মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কয়েকজন কূটনীতিককে কক্ষ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। ছবি: সংগৃহীত

ফিলিস্তিন প্রশ্ন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে দীর্ঘদিনের এক অমীমাংসিত ইস্যু। একদিকে রয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার জবাবে গণহত্যা, অন্যদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি। এই প্রশ্নে বিশ্ব জনমত ও রাষ্ট্রগুলো প্রায় সবসময়ই বিভক্ত থেকেছে। শুক্রবারে (২৬ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের অধিবেশনে পশ্চিমা ও কিছু আঞ্চলিক শক্তির ওয়াকআউট (সম্মিলিতভাবে অধিবেশন ত্যাগ) বিষয়টিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। প্রশ্ন হলো—এই ওয়াকআউট কি ফিলিস্তিন ইস্যুতে কূটনৈতিক ভারসাম্যে নতুন কোনো মোড় আনছে?

বিংশ শতকের প্রথম ভাগে শুরু হয় ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সংঘাত। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ইসরাইলের। এরপর থেকেই ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি, শরণার্থী সংকট ও দখলকৃত ভূখণ্ড নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ৬ জুন পর্যন্ত ছয়দিনের যুদ্ধ ফিলিস্তিন প্রশ্নকে আরও জটিল করে তোলে। গাজা ও পশ্চিম তীর দখল ইস্যুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে জোরালো করেছে। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি এক সময় আশার আলো দেখালেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংঘাতের তীব্রতা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ঘন ঘন সংঘর্ষ, অবরোধ এবং প্রাণহানির ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতির বিভক্তি

ফিলিস্তিন প্রশ্নে বৈশ্বিক বিভাজন স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় অংশ ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের নিরাপত্তা প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যদিও ইউরোপের ভেতরে ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। শুক্রবার জাতিসংঘের অধিবেশনে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘এই সপ্তাহে ফ্রান্স, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং অন্যান্য দেশের নেতারা নিঃশর্তভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তারা এটি করেছেন অক্টোবর ৭-এ হামাসের বর্ববরতার পর।’ কঠোর ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তিনি। প্রায় দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

বরাবরের মত মুসলিম ও আরব বিশ্ব ইসরায়েলের দখলদার নীতি বন্ধের দাবি ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশ ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে এবং ইসরায়েলি দখলনীতির সমালোচক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানালেও নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন ভেটো প্রক্রিয়া ফিলিস্তিন প্রশ্নে সিদ্ধান্তকে প্রায় অচল করে রেখেছে।

ওয়াকআউট

সম্প্রতি জাতিসংঘের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর বক্তব্যের সময় বাংলাদেশসহ ৫০টি দেশের একশ জন প্রতিনিধি ওয়াকআউট করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের নির্মম হামলার প্রতিবাদ স্বরূপ অধিবেশন থেকে বের হয়ে যান তারা। এই ওয়াকআউট কূটনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আলোচনার পরিবেশ তৈরি করবে বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ। বৈশ্বিক চাপ বাড়ার পরেও পশ্চিমা শক্তি এখনও ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তবে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকে আর ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে না। ফিলিস্তিনপন্থী দেশগুলো দেখাতে চাইছে, বিশ্বজনমত তাদের পক্ষে ঝুঁকছে। এই ওয়াকআউট সেই চিত্রকেই আংশিকভাবে প্রমাণ করে। তবে অনেকেরে ধারণা, এ ধরনের পদক্ষেপ সংলাপের সুযোগকে সংকীর্ণ করে এবং সমাধানের পথে তৈরি করে অচলাবস্থা।

এর আগে ব্রিটিশ নেতা কিয়ার স্টারমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য ক্রমবর্ধমান ভয়াবহতার মুখে, আমরা শান্তির সম্ভাবনা এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করছি। এর অর্থ হলো একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরায়েল এবং একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র। এই মুহূর্তে আমাদের কোনটিই নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, বিশ্ব এখন ফিলিস্তিনের জন্য একত্রিত হয়েছে।

নতুন মোড়ের সম্ভাবনা আছে কি

ওয়াকআউট কোনো নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা বিভক্ত। কেউ বলছেন, ওয়াকআউট দেখাচ্ছে, পশ্চিমা ব্লক আগের মতো একক অবস্থানে নেই। ইউরোপের কিছু দেশ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওয়াকআউটের মাধ্যমে যে বিভাজন সামনে এসেছে, তা ভবিষ্যতে নতুন জোটবদ্ধতার পথ তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা নতুন গতি পেতে পারে। আবার এর বিপক্ষেও কেউ কেউ বলেছেন, ওয়াকআউট কেবল একটি কূটনৈতিক কৌশল। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো শক্তি বহাল থাকায় বাস্তব সিদ্ধান্তে কোনো বড় পরিবর্তন হবে না। বরং ওয়াকআউট সংলাপকে জটিল করে তুলতে পারে।

ইসরায়েলি সাংবাদিক ও লেখক গিডিয়ন লেভি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে এখন স্বীকৃতি দেওয়া আসলে এক ভ্রান্তি, প্রায় পাগলামি। দুই রাষ্ট্র সমাধানের কোনো অংশীদার নেই; না ইসরায়েলে, না ফিলিস্তিনে। গাজা তো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম তীরে কোনো রাষ্ট্র গঠনের উপায় নেই। আপনি কি গাজার টিকে থাকা নগণ্য অংশকে রক্ষা করতে চান? তাহলে এক্ষুনি ইসরায়েলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। আপনি কি দীর্ঘমেয়াদি কিছু করতে চান? তাহলে জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সব মানুষের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ্ব বরাবরই বিভক্ত ছিল। সাম্প্রতিক ওয়াকআউট সেই বিভাজনকে নতুন করে স্পষ্ট করেছে। যদিও অনেকেই এটিকে ‘নতুন মোড়’ হিসেবে অভিহিত করছেন। তবে ওয়াকআউট প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি সমাধানের পথ খুলে দেবে—এর নিশ্চয়তা নেই বলে মন্তব্য করেছেন অনেক বিশ্লেষক। তবুও এই ঘটনা দেখিয়ে দিলো, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আর নেই। বিশ্ব যতই বিভক্ত থাকুক, ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ এখনও বৈশ্বিক কূটনীতির কেন্দ্রীয় বিতর্ক হিসেবে বহাল রয়েছে।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, হারেৎজে

Ad 300x250

সম্পর্কিত