leadT1ad

‘সাধারণ মানুষের অসাধারণ শক্তি’: জাতিসংঘে তরুণদের বিষয়ে বিশ্বনেতাদের ভাবনা

আজকের বিশ্বে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা এক বিলিয়নের বেশি। এই বিশাল শক্তিই আজ রাজনীতি, জলবায়ু ও নীতি পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বব্যাপী ভবিষ্যতের নকশা নির্মাণ করছে আজকের তরুণ প্রজন্ম। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মঞ্চে বিভিন্ন দেশের নেতারা জোর দিয়ে বলেছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধা থাকলেও তরুণদের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ সম্ভাবনা। তাঁদের উদ্ভাবন, আন্দোলন ও নেতৃত্বই বিশ্বকে টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিচ্ছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২: ৪২
প্রতীকী ছবি

বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার কেন্দ্রে রয়েছে তরুণরা। বিশ্বব্যাপী তরুণ প্রজন্মের এই ভূমিকা শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশেষভাবে সামনে আনা হয়। সাধারণ পরিষদের বৈঠকে বিশ্বনেতারা জানিয়েছেন, কোটি কোটি শিশু ও তরুণ এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং রাজনৈতিক অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বাধার মুখোমুখি হলেও তাঁদের রয়েছে অসাধারণ সম্ভাবনা।

শুক্রবার এ বিষয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যম ইউএন নিউজ। প্রতিবেদন অনুসারে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী সভাপতিদের একজন আনালেনা বেয়ারবক। বেয়ারবক জোর দিয়ে বলেছেন, তরুণরাই নিজেদের ভবিষ্যতের নকশাকারী, তবে সেই ভবিষ্যত গড়ার লড়াই তাঁদের একার না।

ইথিওপিয়া থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত তরুণ নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে সাধারণ পরিষদের সভাপতি উল্লেখ করেন, আজকের তরুণরা যুদ্ধ, সংকট, সাইবারবুলিং ও বেকারত্বের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আবার একই সঙ্গে তারা ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং জলবায়ু আন্দোলনের মতো রূপান্তরমূলক পরিবর্তনও আনছে।

বাংলাদেশ: গণতান্ত্রিক নবজাগরণে তরুণদের নেতৃত্ব

কয়েক দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর এক বছর পর বাংলাদেশে তরুণদের রূপান্তরমূলক শক্তি এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

সাধারণ পরিষদের চতুর্থ দিনের সাধারণ বক্তৃতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুস এই গণ-অভ্যুত্থানকে বর্ণনা করেছেন ‘সাধারণ মানুষের অসাধারণ শক্তির স্মারক’ হিসেবে। তিনি জানিয়েছেন, দেশের তরুণ সংখ্যাগরিষ্ঠই স্বৈরাচারকে পরাজিত করেছে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক সমাজের পথ খুলে দিয়েছে।

সাধারণ বক্তৃতায় তিনি বলেন, আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এখন ১১টি স্বাধীন কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশনগুলো শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে নারী অধিকার পর্যন্ত নানা বিষয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে’তে স্বাক্ষর করেছে। দলগুলো গণতান্ত্রিক সংস্কার রক্ষার অঙ্গীকার করেছে ওই ঘোষণাপত্রে।

সুন্দর ভবিষ্যতের নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের তরুণ ও নারীদের ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘প্রতিটি তরুণ কেবল চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং চাকরিদাতা হিসেবে গড়ে উঠুক’।

গ্রিস: ডিজিটাল যুগে সুরক্ষা

সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস জোর দিয়েছেন ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ওপর ।

সাইবারবুলিং, আসক্তিকর কনটেন্ট ও অনলাইনে ক্ষতিকর উপাদানের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আসলে শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্ক নিয়ে এক বিশাল নজরদারিহীন পরীক্ষা চালাচ্ছি।‘

গ্রিস ইতোমধ্যে স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করেছে এবং চালু করেছে কিডস ওয়ালেট নামের একটি সরকারি অ্যাপ। অ্যাপটি অভিভাবকদের সহজ ও কার্যকর উপায়ে তাদের সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়।

মিৎসোটাকিস তাঁর আলাপে ইউরোপজুড়ে একটি ‘ডিজিটাল প্রাপ্তবয়স্ক সীমা’ নির্ধারণের প্রস্তাব দেন। যাতে বয়স উপযোগী অনলাইন অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা যায়। তিনি বলেন, এসব উদ্যোগ তরুণ মস্তিষ্ক রক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহারে সহায়তা করবে।

গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমাজ একসময় ধূমপান, মদ্যপান বা সিটবেল্ট ব্যবহারে কঠোর নিয়ম করেছে, তেমনি এখন আমাদের স্পষ্টভাবে এই (ডিজিটাল) চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো আর শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির বিনিময়ে মুনাফা করতে পারবে না।'

সলোমন দ্বীপপুঞ্জ: জলবায়ু আন্দোলনে তরুণদের নেতৃত্ব

সলোমন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী জেরেমায়া মানেলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল সংকটে তরুণদের নেতৃত্ব আজ সারা বিশ্বে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। মানেলে উল্লেখ করেন যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তরুণরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে— এই অঞ্চলের আসল শক্তি একতা ও ঐক্যবদ্ধতায়।

তরুণদের উদ্যোগেই আন্তর্জাতিক আদালত জলবায়ু দায়বদ্ধতা নিয়ে একটি ঐতিহাসিক পরামর্শমূলক মতামত দিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলোর জলবায়ু নীতি নির্ধারণে দিকনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই রায় শুধুমাত্র একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়; বরং এটি গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এক ধরনের নৈতিক ও বাস্তব আহ্বান। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমার মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা শুধু একটি লক্ষ্য নয়, বরং ভবিষ্যত প্রজন্মের টিকে থাকার শর্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর ওপর, যাদের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে। তাই এই দেশগুলোর তরুণরা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বকে বার্তা দিয়েছে— একসাথে না লড়লে কোনো জাতি একা টিকে থাকতে পারবে না।

তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন কেবল দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সমস্যাই নয়, বরং বৈশ্বিক সংকটকেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরেছে। তাদের কণ্ঠস্বর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে এবং প্রমাণ করেছে যে বয়স নয়, বরং সংকল্প, ঐক্য ও দূরদৃষ্টি বিশ্বকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত মানেলের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয় যে তরুণদের শক্তি কেবল প্রতিবাদে নয়, বরং বৈশ্বিক নীতি ও ভবিষ্যতকে গড়ে তোলার বাস্তব প্রয়াসেও। এই আন্দোলন দেখিয়েছে— সম্মিলিত পদক্ষেপই একমাত্র পথ, যা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখবে।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগো: ছোট দেশ, বৈশ্বিক প্রভাব

ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী কামলা প্রসাদ-বিসেসর বলেছেন, শিশু ও তরুণদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিলে ছোট দেশগুলোও বৈশ্বিকভাবে প্রভাব রাখতে পারে।

শিশু অধিদপ্তর, শিশু জীবন তহবিল, প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচিসহ তিনি নিজ দেশের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এসব উদ্যোগ আগামী প্রজন্মকে বিকশিত করার জন্য নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী কামলা আরও বলেন, টেকসই শান্তি ও উন্নয়ন থেকে লিঙ্গসমতা আলাদা করা যায় না। তাঁর মতে ‘শান্তি ও টেকসই উন্নয়নে নারী ও কন্যাশিশুরা অবশ্যই সমান অংশীদার হতে হবে।‘

মাল্টা: বহুপাক্ষিকতার প্রকৃত সুফল

মাল্টার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট অ্যাবেলা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে শুধু কথা দিয়ে সংঘাত, ক্ষুধা বা শিশু অপুষ্টি দূর করা যায় না। বরং সম্মিলিত পদক্ষেপে তা করা সম্ভব।

রবার্ট অ্যাবেলা বলেন, ১৯৪৫ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের গড় আয়ু ছিল প্রায় চল্লিশের ঘরে, আর ২০২৫ সালে জন্ম নেওয়া শিশুরা গড়ে সত্তরের ঘরে পৌঁছানো পর্যন্ত বাঁচার আশা করতে পারে। এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটা ঘটেছে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও সংকল্পের কারণে। এটা ঘটেছে প্রচেষ্টার কারণে। আর এটা সম্ভব হয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ইতিবাচক কাজের ফলেই।

এই সাফল্যগুলো উল্লেখ করে তিনি বহুপাক্ষিকতা ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা একসাথে কাজ না করলে, একে অপরের কথা না শুনলে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ না নিলে আমাদের জনগণের নিরাপত্তা, আমাদের পৃথিবীর সুরক্ষা বা আমাদের সমৃদ্ধি কোনো কিছুই টিকে থাকবে না’।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন তরুণদের আগামী দিনের রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিল। তারা কেবল অনলাইনে নয়, রাজপথে নেমে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ, নেপাল বা পূর্ব তিমুর—সব জায়গাতেই তরুণরা গণতন্ত্র, শিক্ষা ও জলবায়ু ন্যায়বিচারের মতো প্রশ্নে প্রাণ দিচ্ছে।

তবে এটি প্রমাণিত যে একটি নতুন প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে, যারা অবিচার মেনে নিতে রাজি নয়। এই শক্তিকে দিকনির্দেশনা দেওয়া, সুসংগঠিত করা এবং টেকসই আন্দোলনে রূপ দেওয়া—এটাই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ।

ইউএন নিউজ থেকে ভাষান্তর: সৈকত আমীন

Ad 300x250

সম্পর্কিত