leadT1ad

ঘরের মেয়ে দুর্গার আগমনী

ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। প্রাচীন মাতৃপূজা থেকে আজকের দুর্গাপূজা, কেন দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের ঘরের উৎসব? মাতৃপূজার হাজার বছরের যাত্রা কীভাবে এগিয়েছে?

রাতুল আল আহমেদ
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩: ২২
ঘরের মেয়ে দুর্গার আগমনী। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার কথা। তখনো কাগজ আবিষ্কার হয়নি। মিশরীয়রা তখন প্যাপিরাসে লিখত। সে সময় প্রাচীন মিশরের সেরাপিয়াস নামে এক নারী, প্যাপিরাসের এক টুকরোয় চিঠি লিখে পাঠালেন তাঁর জামাই এরমিনোসের কাছে।

সেরাপিয়াস লিখলেন, ‘বাছা এরমিনোস, আমার কন্যা সন্তানসম্ভবা হওয়ার খবর পেয়ে মা হিসেবে আমি গভীর উদ্বেগে আছি। তুমি যদি মেয়েটিকে বাপের বাড়ি পাঠাও, তবে আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’

যাত্রাপথের খরচ নিয়ে জামাইকে আশ্বস্ত করে সেরাপিয়াস আরও জানালেন, পথের গাধার ভাড়া তিনিই দেবেন। তবু যেন কন্যাকে বাপের বাড়ি পাঠাতে কার্পণ্য না করে এরমিনোস।

কন্যা উমাকে কৈলাসে পাঠিয়ে মা মেনকা চিন্তায় উদ্বিগ্ন। কেননা, উমা রাজার কন্যা। এখন বিয়ে করে শ্মশানচারী সংসার বিবাগী শিবের সঙ্গে সংসার করেন। এ যেন বাঙালি মায়েদের দৈনন্দিন দুশ্চিন্তা। কেমন আছে তাঁর মেয়ে?

বিবাহিতা কন্যার জন্য মায়ের এ উৎকণ্ঠা আসলে সর্বজনীন। নাহলে কেন-ই বা শরতের এক প্রভাতে পর্বতরাজ মহিষী মেনকা খারাপ স্বপ্ন দেখে গিরিরাজকে তাগাদা দেবেন কন্যা উমাকে কৈলাস থেকে বাপের বাড়ি আনার জন্য? আর কেন-ই বা সেই তাগাদার অনুরণন যুগ যুগ ধরে গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত বাঙালি হিন্দু মায়েদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হবে?

হিন্দু পুরাণ মতে, দেবতা ব্রহ্মার পুত্রসন্তান প্রজাপতি দক্ষ কঠোর তপস্যায় আদিশক্তি দেবী দুর্গাকে তুষ্ট করে দেবীকে নিজ কন্যারূপে পাওয়ার বর প্রার্থনা করেন। দেবী দক্ষগৃহে জন্ম নেন সতী নামে। শিববিরোধী দক্ষের কন্যা সতী প্রেমে পড়েন সংসার বিবাগী শিবের।

পিতা দক্ষের অমতেই বিয়ে হয়ে যায় শিব ও সতীর। পরবর্তী সময়ে দক্ষ এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেন, যা দক্ষযজ্ঞ নামে পরিচিত। অনেকেই সেখানে আমন্ত্রিত হলেও শিব ছিলেন ব্রাত্য। কন্যা সতী সে যজ্ঞে উপস্থিত হলে, পতি শিবের নিন্দা শুনে অপমানে দেহত্যাগ করেন। সংবাদ পেয়ে শিব তাঁর অনুচরসমেত ধ্বংস করেন দক্ষের যজ্ঞ। সংকল্প নেন, এ পৃথিবী তিনি ধ্বংস করে দেবেন। বিষ্ণু তখন তাঁকে থামান। এরপর শোকাভিভূত শিব মগ্ন হন গভীর তপস্যায়।

দক্ষের যজ্ঞ (প্রতীকী ছবি)। উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি
দক্ষের যজ্ঞ (প্রতীকী ছবি)। উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি

এদিকে সতী পুনরায় জন্ম নেন পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যা হয়ে। এবারে তাঁর নয় পার্বতী। এ জন্মেও পার্বতী শিবকে পতি হিসেবে পেতে গভীর তপস্যায় রত হন। সে তপস্যার অধ্যবস্যায় দেখে মা মেনকা তাকে নাম দেন ‘উমা’। তপস্যার ফলে অবশেষে মিলন হয় শিব-পার্বতীর। পার্বতী পতি শিবের সঙ্গে কৈলাস চলে যান।

কন্যা উমাকে কৈলাসে পাঠিয়ে মা মেনকা চিন্তায় উদ্বিগ্ন। কেননা, উমা রাজার কন্যা। এখন বিয়ে করে শ্মশানচারী সংসার বিবাগী শিবের সঙ্গে সংসার করেন। এ যেন বাঙালি মায়েদের দৈনন্দিন দুশ্চিন্তা। কেমন আছে তাঁর মেয়ে?

সেই আকুতি ও তাগিদই ধরা দেয় আগমনী গানে, যা বাংলা ভাষার এক অমূল্য সম্পদ। দুর্গাপূজার আরম্ভে দেবী দুর্গাকে আহ্বান করে যে শাক্ত পদাবলি গাওয়া হয়ে থাকে তাকেই আগমনী গান বলা হয়।

আগমনী গানে মা মেনকার বয়ানে কখনও গিরিরাজের প্রতি, কখনো বা দুর্গার প্রতি আকুতি প্রকাশ পায়। কিন্তু আদতে, এ আকুতি যেন বাংলার মায়েদেরই কণ্ঠস্বর। যেমন এক জায়গায় মা মেনকা গিরিরাজকে বলছেন—

‘কামিনী করিল বিধি/ তাই যে তোমারে সাধি/ নারীর জনম কেবল/ যন্ত্রণা সহিতে।’ এর মানে, যিনি গর্ভে ধারণ করেন স্বয়ং ঈশ্বরীকে, তাঁকেও হায় পিতৃতন্ত্রের কাছে বশ্যতা মানতে হয়।

আবার, উমা বাপের বাড়ি ফেরার পরে মা মেনকা বলেন—

‘যদি আসে মৃত্যুঞ্জয়/ উমা নেবার কথা কয়/ তখন মায়েঝিয়ে করব ঝগড়া/ জামাই বলে মানিব না।’

মায়ের কাছে মেয়ে কখনো বড় হয় না। সে থাকে চিরকালের খুকি। তাই যখন গিরিরাজ মহিষমর্দিনী দুর্গাকে ঘরে নিয়ে আসেন, মা মেনকা অবাক হয়ে বলেন—

‘মোর লীলাময়ী চঞ্চলারে ফেলে/ এ কোন দেবীমূর্তি নিয়ে এলে,/ এ যে মহীয়সী মহামায়া,/ বামা মহিষমর্দিনী।’

সেই জন্যই আজও বাংলার বহু হিন্দুবাড়িতে দুর্গা পূজিতা হন কেবল দশভূজারূপে নয়, বরং ঘরের মেয়ে ‘দ্বিভূজারূপে’।

তবে দুর্গার এই যে মহিষমর্দিনী রূপ তা প্রাচীনতর। বরং বর্তমানে এই যে সপরিবার দুর্গাপূজার প্রচলন দেখা যায়, তা জনপ্রিয় হয়েছে মধ্যযুগে। মঙ্গলকাব্য রচয়িতা, যেমন চণ্ডিমঙ্গলের কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, পাঁচালী রচয়িতা দাশরথি রায়, বা পদকর্তা রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিদের রচনাতে দেবী দুর্গার পারিবারিক জীবন স্পষ্ট ফুটে ওঠে। যা মূলত বাঙালি গৃহস্থ জীবনের প্রতিচ্ছবি।

নৃবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বলছে, তাঁরা প্রকৃতি ও মায়ের ভেতর এক অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিল।

বিশ্বে মাতৃপূজার ইতিহাস বহু প্রাচীন। এমনকি সিন্ধু সভ্যতার কালিবঙ্গান প্রত্নস্থল থেকে আবিষ্কৃত কে-৬৫ সিলে যুদ্ধরত দেবীকে অনেকে ‘প্রোটো-দুর্গা’ বলেই মনে করেন। আবার অস্ট্রিয়ায় প্রাপ্ত ‘উইলেনডর্ফের ভেনাস’ মূর্তিকে মানবসভ্যতার মাতৃকাপূজার সবচেয়ে পুরোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়। কার্বন ডেটিং জানায়, এর বয়স পঁচিশ হাজার বছরেরও বেশি।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, প্রাচীন মানুষ কেন শুরু করেছিল মাতৃপূজা? নৃবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বলছে, তাঁরা প্রকৃতি ও মায়ের ভেতর এক অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিল। প্রকৃতি যেমন শস্য জন্ম দেয়, তেমনি মাও সন্তান জন্ম দেন, লালন-পালন করেন। আবার চন্দ্রকলার ক্ষয়বৃদ্ধির সঙ্গে যেমন জোয়ার-ভাটা ওঠানামা করে, তেমনি নারীর দেহে ঘটে ঋতুচক্র। সব মিলিয়ে তখনকার বিশ্বাস ছিল, মাকে সন্তুষ্ট করলেই মেলে সভ্যতার চাবি।

ফলে প্রাচীনকাল থেকেই উর্বরতা, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার আশা থেকেই মাতৃকাপূজা প্রচলিত হয়ে আসছে।

সেই প্রাচীন বিশ্বাসেরই এক উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা দেখা যায় আজও বাংলার শারদীয়া দুর্গাপূজায়। পূজায় শস্যদেবী দুর্গাপূজায় পূজিতা হন নবপত্রিকারূপে। এছাড়াও সন্ধিপূজার বলির গ্রহণ করেন মাতৃকা চামুন্ডা। অর্থাৎ যে প্রাচীন রীতি ছিল মানুষের মধ্যে, দুর্গাপূজায় এখনও সে ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।

এদিকে পূজা শেষ হতে না হতেই অগ্রহায়ণে কৃষকের ঘরে উঠবে আমন ধান। ঠিক এই সময়েই বাংলায় মাতৃশক্তি নানারূপে পূজিত হন—দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, কাত্যায়ণী, জগদ্ধাত্রী রূপে।

তাই দেখা যায়, মাতৃশক্তি কেবল পুরাণকথা, আচার বা বিশ্বাসের বিষয় নয় বরং দেবী দুর্গা আসলে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের গৃহস্থজীবনের গভীরে গেঁথে থাকা এক আবেগ। কখনও তিনি শস্যদেবী, কখনও রুদ্রমূর্তি মহিষমর্দিনী, আবার কখনও বা বাপের বাড়ি ফেরা এক বালিকা-কন্যা।

হাজার বছরের পথচলায় রূপ বদলেছে, ব্যাখ্যা পাল্টেছে। কিন্তু মায়ের প্রতি আকুলতা, স্নেহ আর নিরাপত্তার প্রত্যাশা অটুট থেকেছে। সেই কারণেই দুর্গাপূজা আজ কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাঙালি হিন্দুর সাংস্কৃতিক প্রাণস্পন্দন। যেখানে দেবীকে একদিকে পূজিত করা হয় বিশ্বজননী রূপে, অন্যদিকে বরণ করা হয় আপন ঘরের মেয়ে বলে। এটাই দুর্গাপূজাকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা; যেখানে চিরায়ত বিশ্বাস আর মানবিক আবেগ মিলেমিশে যায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত