ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন যে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে প্রস্তুত। ফাঁস হওয়া ওই খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউক্রেনকে পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্ক অঞ্চলে এখনো যে এলাকাগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলোর একটি বড় অংশ ছেড়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর আকার কমাতে এবং ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এসব প্রস্তাব ইউক্রেন এর আগে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
হোয়াইট হাউস দাবি করেছে যে ইউক্রেনকে পরিকল্পনা প্রণয়নের বাইরে রাখা হয়নি। এই পরিকল্পনা আসে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং রাশিয়ার প্রতিনিধি কিরিল দিমিত্রিয়েভের বৈঠকের পর। খসড়া পরিকল্পনার বেশ কিছু অংশ স্পষ্টভাবেই রাশিয়ার স্বার্থের দিকে ঝুঁকে আছে। এ কারণে ইউক্রেন কূটনৈতিকভাবে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর গভীরভাবে নির্ভর করে এসেছে। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাল্টে দিয়েছেন। নতুন নীতিতে বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ সহায়তা ন্যাটো মিত্রদের অর্থায়নের ওপর নির্ভর করবে এবং শান্তিচুক্তি অর্জন এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
উইটকফ–দিমিত্রিয়েভ পরিকল্পনা প্রকাশিত হয় এমন সময়, যখন রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে নতুন করে কিছুটা অগ্রগতি দাবি করেছে। একই সঙ্গে জেলেনস্কি তার সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জড়িয়ে ১০০ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি কেলেঙ্কারি নিয়ে অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে পড়েছেন।
রাতের ভাষণে জেলেনস্কি বলেন যে কিয়েভে অবস্থানরত মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা পরিকল্পনার ‘মূল প্রস্তাব ও যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা’ তার কাছে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই ইউক্রেনের অবস্থান ছিল খুব সরল—ইউক্রেন শান্তি চায়। তবে এমন শান্তি, যা তৃতীয়বারের মতো কোনো আগ্রাসনের ঝুঁকিতে ভাঙবে না।
ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে ‘ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই’ শান্তির পক্ষে। তাদের লক্ষ্য রাশিয়া যেন ইউক্রেনের আর কোনো অংশ দখল করতে না পারে। রাশিয়া ইতোমধ্যে ক্রিমিয়া এবং বর্তমান আগ্রাসনে দখল করা চারটি অঞ্চল নিজের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
তবে ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনার বাইরে রয়েছেন। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ভাডেফুল বলেন, তার দৃষ্টিতে এটি এখনো পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা নয়। বরং এটি ‘বিষয়বস্তুর একটি তালিকা ও কিছু সম্ভাব্য বিকল্প’, যা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর মন্তব্যের প্রতিফলন।
ফাঁস হওয়া খসড়ায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ৬ লাখ সদস্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব রয়েছে। ইউরোপীয় যুদ্ধবিমানগুলো প্রতিবেশী পোল্যান্ডে অবস্থান করবে বলে উল্লেখ আছে। কিয়েভকে ‘বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা’ দেওয়ার কথা বলা হলেও তা কীভাবে দেওয়া হবে তার বিস্তারিত নেই। সেখানে বলা হয়েছে, রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে আর আগ্রাসন চালাবে না এবং ন্যাটোও আর সম্প্রসারিত হবে না— ‘এটাই প্রত্যাশিত।’
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, রাশিয়াকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে এবং রাশিয়াকে আবার বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর জোট জি-সেভেনে (যা তখন জি এইট) আমন্ত্রণ জানানো হবে।
জেলেনস্কি জানিয়েছেন যে তিনি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ট্রাম্পের সঙ্গে এই প্রস্তাব নিয়ে কথা বলবেন। খসড়ায় ইউক্রেনকে উল্লেখযোগ্যভাবে অস্ত্র ত্যাগের প্রস্তাবও রয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, এই প্রস্তাবগুলো ইউক্রেনের বড় ধরনের ছাড় নয়। তিনি দাবি করেন যে যুক্তরাষ্ট্র ‘উভয় পক্ষের সঙ্গেই সমানভাবে’ আলোচনা করেছে।
লেভিট আরও বলেন যে উইটকফ এবং রুবিও প্রায় এক মাস ধরে শান্তি-প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছিলেন। তারা দুই পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করেছেন, যাতে জানা যায় কোন দেশ কী প্রতিশ্রুতি দিতে পারে একটি ‘দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই শান্তি’ অর্জনের জন্য।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ‘প্রস্তাবটি উভয় পক্ষের জন্যই একটি ভালো পরিকল্পনা।’ তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি উভয় পক্ষের জন্যই তা গ্রহণযোগ্য হবে। এবং আমরা এটা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন সিনিয়র কর্মকর্তা সিবিএস নিউজকে বলেন, পরিকল্পনাটি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রশাসনের অন্যতম উচ্চপদস্থ সদস্য রুস্তেম উমেরভের সঙ্গে আলোচনার পরই প্রস্তুত করা হয়েছিল। উমেরভ পরিকল্পনার বেশির ভাগ অংশে সম্মতি দেন এবং কিছু সংশোধনের পর তা প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির কাছে উপস্থাপন করেন।
ইউক্রেনের এক সংসদ সদস্য বিবিসিকে জানান যে কিয়েভ প্রাথমিক আলোচনায় যুক্ত ছিল না, তবে পরে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বৃহস্পতিবার জেলেনস্কির দপ্তর এক সতর্ক ভাষায় বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নে পরিকল্পনাটি ‘কূটনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়ক’ হতে পারে।
গত আগস্টে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন, তবে কোনো অর্জন ছাড়াই ফিরে আসেন। এরপর ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় ক্রমশ হতাশ হন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম তেল কোম্পানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যা শুক্রবার থেকে কার্যকর হচ্ছে।
জেলেনস্কি পরিকল্পনাটিকে প্রকাশ্যে সমালোচনা বা প্রত্যাখ্যান করা থেকে বিরত রয়েছেন। তিনি বলেন যে ইউরোপে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার দলের প্রচেষ্টাকে তিনি মূল্যায়ন করছেন।’ এটি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার একটি কৌশল, যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের রাশিয়া-সংক্রান্ত অবস্থান তুলনামূলকভাবে নরম।
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইউক্রেন একটি ‘যোগ্য শান্তি’ চায়। এবং ইউক্রেনের জনগণের ‘মর্যাদা’ অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
এই বিবৃতি আসে বৃহস্পতিবার কিয়েভে জেলেনস্কির সঙ্গে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠকের পর। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর সচিব ড্যান ড্রিসকল, সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল র্যান্ডি জর্জ এবং ইউরোপে মার্কিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল ক্রিস ডোনাহিউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান কাজা কালাসকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে ইউরোপ কি পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল কি না, তিনি বলেন, ‘আমার যতদূর জানা আছে, না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ইউক্রেন ও ইউরোপীয়দের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।’
ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা এখন কিয়েভের সামরিক ও আর্থিক সহায়তার বড় অংশ বহন করছে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ শান্তি বজায় রাখতে প্রয়োজন হলে বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
অন্যদিকে, মস্কো ২৮ দফার এই পরিকল্পনার গুরুত্ব কমিয়ে দেখাচ্ছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো প্রক্রিয়া নেই যা ‘পরামর্শ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন যে যে কোনো শান্তিচুক্তিতে অবশ্যই সংঘাতের ‘মূল কারণ’ সমাধান করতে হবে। রাশিয়া এই বাক্যাংশটি সাধারণত তাদের সব দাবি বোঝাতে ব্যবহার করে, যা ইউক্রেনের কাছে আত্মসমর্পণের সমতুল্য।
এ বছরের শুরুতে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার পর থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। তার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মস্কোতে বেশ কয়েকবার সফর করেছেন। তিনি জেলেনস্কি এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।
তবে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের চার বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে দুই পক্ষ এখনো যুদ্ধ শেষ করার পথে গভীর মতভেদে রয়েছে। ইউক্রেন দীর্ঘ-পাল্লার ড্রোন দিয়ে রুশ সামরিক অবকাঠামো ও জ্বালানি স্থাপনাকে দক্ষতার সঙ্গে লক্ষ্যবস্তু করছে। অন্যদিকে রাশিয়ার হামলা অব্যাহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়া শহরে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে আঞ্চলিক গভর্নর জানিয়েছেন। কয়েক ঘণ্টা পর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করে যে তারা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ৩৩টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ধ্বংস করেছে।
সপ্তাহের শুরুতে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তেরনোপিলে এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হয়। জেলেনস্কি জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এখনো ১৭ জন নিখোঁজ রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি