যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি। মামদানি চলতি মাসের শুরুর দিকে মেয়র নির্বাচিত হন। মামদানি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এই প্রথম এই দুই রাজনীতিকের মধ্যে মুখোমুখি বৈঠক হতে যাচ্ছে।
গতকাল বুধবার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প একথা জানান। ট্রাম্প জানান, তিনি শুক্রবার (২১ নভেম্বর) হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ট্রাম্প তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘নিউইয়র্ক শহরের কমিউনিস্ট মেয়র জোহরান মামদানি বৈঠক করতে চেয়েছেন। শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বৈঠকটি করার বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’
নবনির্বাচিত মেয়রের মুখপাত্র ডোরা পেকেকও এক বিবৃতিতে ট্রাম্প-মামদানির মধ্যকার অনুষ্ঠেয় বৈঠকের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এক বিবৃতিতে ডোরা পেকেক বলেন, প্রথা অনুযায়ী, নবনির্বাচিত মেয়র হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা করছেন।
বৈঠক নিয়ে ট্রাম্পের কাছ থেকে ঘোষণা আসার আগে মামদানি নিজেও বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি এমএস নাউকে বলেন, তার দল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক আয়োজনের জন্য হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
এটি দুজনের প্রথম সরাসরি বৈঠক, যদিও গত কয়েক মাস ধরে তাদের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ চলেছে। ট্রাম্প তাকে বহুবার ‘কমিউনিস্ট’ বলে আক্রমণ করেছেন এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। শহরের ফেডারেল তহবিল, অভিবাসন নীতি এবং নগর শাসন নিয়ে টানাপোড়েনের মাঝেই এই বৈঠক হতে যাচ্ছে।
জোহরান মামদানি (৩৪) একজন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট ও নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের অ্যাসেম্বলি সদস্য। গত ৪ নভেম্বরের ভোটে তিনি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এবং ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিলে তিনি হবেন শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম মেয়র। তিনি ভারতীয় অভিবাসী দম্পতির সন্তান। বাড়ির ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, পুলিশ সংস্কার এবং ফিলিস্তিনি অধিকারসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ইস্যুতে তিনি সোচ্চার। তার প্রচারণায় আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজসহ প্রগতিশীল নেতারা সমর্থন দিয়েছেন।
তবে তার উত্থান ঘিরে বিতর্কও রয়েছে। তিনি বিডিএস আন্দোলনকে সমর্থন করায় তাকে ‘ইসরায়েলবিরোধী’ বলা হয়। ট্রাম্প একসময় বলেছেন যে মামদানি ‘আমেরিকাকে ঘৃণা করেন’ এবং তাকে দেশ ছাড়তে হবে—যদিও তিনি জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক।
দ্বন্দ্বের পটভূমি
মেয়র নির্বাচনের পুরো সময়জুড়েই তাদের বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। নির্বাচনে জয়ের পর ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে মামদানিকে আক্রমণ করে বলেন যে তিনি নিউইয়র্ককে ‘নরক’ বানিয়ে ফেলবেন। মামদানি পাল্টা অভিযোগ করেন যে ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে বিভাজন তৈরি করছেন এবং তিনি কোনো ধরনের ফেডারেল চাপ মানবেন না।
দু’জনের বিরোধের মূল ক্ষেত্রগুলো হলো:
অভিবাসন ও ‘স্যাংকচুয়ারি সিটি’ নীতি:
নিউইয়র্ক একটি স্যাংকচুয়ারি সিটি। ফলে এখানে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর বহিষ্কার নীতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হয়। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, এর কারণে নিউইয়র্কের ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। মামদানি নথিহীন অভিবাসীদেরও সুরক্ষা দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন।
পুলিশিং ও জননিরাপত্তা:
মামদানি এনওয়াইপিডির কমিশনার জেসিকা টিশকে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকেই এটিকে ট্রাম্পপন্থী ‘আইন-শৃঙ্খলা’ ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করছেন।
অর্থনৈতিক চাপ:
নিউইয়র্কে বাসস্থান সংকট ও কোভিড-উত্তর অর্থনৈতিক চাপ এখনও রয়ে গেছে। মামদানি প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য তহবিল কাটছাঁট শহরের পুনরুদ্ধারে বড় বাধা হতে পারে।
সমঝোতার ইঙ্গিত?
ওভাল অফিসে আমন্ত্রণকে অনেক বিশ্লেষক একটি সাময়িক সমঝোতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ফেডারেল সহায়তা নিয়ে আলোচনা:
নিউইয়র্ক প্রতিবছর অবকাঠামো, বাসস্থান এবং সামাজিক সেবার জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফেডারেল তহবিল পায়। ট্রাম্প এই তহবিলকে চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। অন্যদিকে মামদানি শহরের স্বার্থ নিশ্চিত করতে এই বৈঠককে কাজে লাগাতে চান।
রাজনৈতিক কৌশল:
ট্রাম্পের কাছে এটি রাজনৈতিকভাবে লাভজনক। একজন মতাদর্শিক প্রতিপক্ষকে ডেকে এনে তিনি নিজের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ দেখাতে পারেন। মামদানি একইভাবে দেখাতে চাইবেন যে তিনি শহরের স্বার্থে বাস্তববাদী পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
নীতি আলোচনার সম্ভাবনা:
অপরাধ দমন বা নগর উন্নয়ন নিয়ে কিছু সম্ভাব্য সমন্বয় হতে পারে। তবে ফিলিস্তিন প্রশ্নে দুজনের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে বৈঠকটি দ্বন্দ্বও বাড়াতে পারে।
সম্ভাব্য ফলাফল
এই বৈঠক ইতোমধ্যে জনমনে আগ্রহ ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কেউ এটিকে বাস্তবসম্মত রাজনীতির দিকে একটি পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। আবার অনেকে মনে করছেন এটি একটি নতুন সংঘাতের সূচনা হতে পারে।
প্রগতিশীল মহল আশঙ্কা করছে যে মামদানি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে আপস করতে পারেন। অন্যদিকে ট্রাম্প সমর্থকরা মনে করছেন যে একজন ‘সোশ্যালিস্টের’ সঙ্গে বৈঠক করা অপ্রয়োজনীয়।
অবশেষে, বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরে—যেখানে স্থানীয় ও ফেডারেল স্বার্থ প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সাক্ষাৎ সেই সংঘর্ষ কতটা বাড়াবে বা কমাবে, তা নির্ভর করবে পরবর্তী কয়েক মাসের রাজনৈতিক অগ্রগতির উপর।