.png)
কোনো সমাজে গুজব কেন ছড়ানো হয়? গুজব আর গালগল্প কেন মানুষের এত প্রিয়? চলুন, ভ্রমণ করা যাক গুজবমুখর এক ব্যাঙ্গের দুনিয়ায়…

সৈকত আমীন

গুজবপ্রিয় লোকেরা ইশপের গল্পের মতো রোজই বিশ্বাস করে গেছে, ‘রাখাল বালককে তুলে নিয়ে যেতে এই বুঝি বাঘ এল।’ কিন্তু আফসোস, জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারি আসে, মাঘের পর ফাল্গুন, দেশলাই কাঠি জ্বালালে আগুনও আসে, প্রিপেইড মিটারে হুদাই বিদ্যুৎ বিল অনেক বেশি আসে, তবু গুজবের রাখাল বালককে ধরতে আর বাঘ আসে না।
এই বাস্তবতায় একদিন ঘুম থেকে উঠে জনৈক ইনফ্লুয়েন্সার আবিষ্কার করলেন, তিনি একজন ‘গুজবরাজ’ হয়ে গেছেন! গত ১০ দিনে ফেসবুকে ও ইউটিউবে তিনি অন্তত ১০ বার দেশের সরকার ফেলে দিয়েছেন। প্রথম যেদিন তিনি ইউটিউবে সরকার ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেদিন অবশ্য অনেকেই বিশ্বাস করেছিল। এয়ারপোর্টের বাইরে আপা বাহিনী, বট বাহিনী, কট বাহিনী, এমনকি যে হারকিউলিস বাহিনীকে দিয়ে তিনি সরকার ফেলে দিতে চান, সেই বাহিনীরও কেউ কেউ উপস্থিত হয়েছিল তাঁর আগমন দেখতে। কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আর আসেননি। আর বিপ্লবের বিমান কারও জন্যই যেহেতু অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকে না, তাই ‘উত্তেজিত জনতাকে নিরাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল সেদিন।
কিন্তু তাতে দমে যাননি জনাব ইনফ্লুয়েন্সার। পরে টানা ছয় দিনে ৯ বার সরকার ফেলার ঘোষণা দিয়ে তিনি তাঁর আগের সব রেকর্ডও ভেঙে ফেলেছেন। ব্যক্তিগত অলিম্পিকে এ যেন এক স্বর্ণপদক জয়ের সমান ঘটনা।
অবশ্য সরকার ফেলে দেওয়াসংক্রান্ত ইস্যুতে ইনফ্লুয়েন্সার গুজবরাজের ব্যক্তিগত কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। তা ছাড়া গুজবরাজ হওয়া নিয়ে তিনি বিশেষ গর্বিতও নন। কারণ, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা বিভাগের প্রধান রবিন ডানবারের লেখায় পড়েছেন, যেসব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিস্কের নিওকর্টেক্সট তুলনামূলক বড়, তাঁরা সবাই-ই গুজব রটাতে পারে। এমনকি বানর বা শিম্পাঞ্জিও পারে। ইউটিউবে নিয়মিত বিবর্তনবিরোধী বয়ান দিলেও গুজবরাজ আসলে বিবর্তনের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখেন। নিয়মিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই বেলা চেক করেন, তাঁর চেহারা কোনোভাবে বানর বা শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কি না!
ব্যক্তিগত কোনো লাভ ক্ষতি না থাকলেও এগুলো তিনি করেন বাজারের স্বার্থে। কারণ তিনি জানেন, তাঁর গুজব শিলাজিতের শরবত বা কলিকাতা হারবালের বড়ির চেয়েও অধিক উত্তেজক। এক ফাইলই যথেষ্ট। কেউ এক ফাইল সেবন করলে মাধ্যাকর্ষণ বলও তাঁদের আর আটকে রাখতে পারবে না।
একই সঙ্গে তাঁর ফাইলগুলো সংক্রামক। কারণ, নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারম্যানের ‘মেনুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ বইটি তাঁর পড়া আছে। তাই তিনি জানেন, মূলধারার গণমাধ্যম যখন নীরব থাকে, তখন শূন্যস্থান পূরণ করতে গুজবের জুড়ি নেই। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, সে তথ্য জানতে চায়। তবে তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস যখন থাকে না, সেক্ষেত্রে বিকল্প সূত্রই তো ভরসা।
চমস্কির যেমন বলেছেন, ক্ষমতাধরেরা প্রায়ই বিভ্রান্তি তৈরি করে জনমতকে ভিন্নখাতে ঘোরাতে চান। এ কাজ তাঁরা করেন আংশিক সত্য, নির্বাচিত তথ্য, বা গুজব ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। ফলে গুজব কে বা কারা ছড়াচ্ছে, তা বোঝা অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। আর কোনো গুজবকে বাতাসের বেগে প্রবাহিত করার জন্য বর্তমান সময়ে ‘মব’-এর চেয়ে ক্ষমতাবান আর কেউই-বা আছে!
তো ইনফ্লুয়েন্সারের যে ক্ষমতার কথা বলছিলাম, এবার আবার সেখানেই ফেরা যাক। এই ক্ষমতা দিয়ে ‘গুজবরাজ’ উপাধিপ্রাপ্ত ইনফ্লুয়েন্সার কিই-বা করেন? করেন মূলত বাজার ব্যবস্থাপনা। কারণ, তিনি জানেন বঙ্গবাজারের লুঙ্গি ব্যবসায়ীদের যদি উত্তেজনার তুঙ্গে উঠানো যায়, তাতে লাভ মূলত মুম্বাইয়ের হাফপ্যান্ট ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এই পৃথিবীতে যেহেতু হাফপ্যান্ট ব্যবসায়ীদের তুলনায় আন্ডারওয়ার ব্যবসায়ীদেরই বেশি প্রভাব, ফলে ইনফ্লুয়েন্সার সাহেবকে রিপ্লেস করতেও গুজব কমিউনিটির খুব বেশি সময় লাগল না।
শেষমেশ গুজবরাজ ইনফ্লুয়েন্সার নিজেই গুজবে আক্রান্ত হলেন। একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করলেন, ‘আগামীকাল সরকার পড়ে যাবে।’ জনতা সঙ্গে সঙ্গে তা বিশ্বাস করল।
এরপর অ্যাকাউন্টে লগইন করতে গিয়ে দেখলেন, অ্যাকাউন্টটি ‘মেমোরিয়াল মুড’-এ চলে গেছে। তিনি বুঝতে পারেননি যে তিনিই ধীরে ধীরে গুজববাজদের সরকার হয়ে উঠেছিলেন! এবার তিনি বসে বসে হাততালি দিলেন। কারণ এই প্রথম, তাঁর নিজের গুজবই সত্যি হলো।
২.
উগান্ডায় বিপ্লবের তিন মাস পর ফেসবুকে ঢুকেই সুপ্ত মিয়ার মনে পড়ল সেই দূর অতীতের কথা, যখন তিনি অনলাইনে প্রথম ‘বট আইডি’ আবিষ্কার করেছিলেন। এক যুগের বেশি সময় আগের কথা, সেদিন ছিল চাঁদ সওদাগরের চন্দ্র-আহরণের দিন। মগবাজারের হাজার হাজার বট সেদিন চাঁদে দেখতে পেয়েছিল তাঁদের বড় মিয়া চাঁদ সওদাগরকে। ফেসবুকে তাঁরা বুস্ট করে প্রচার করেছিল সে সংবাদ।
তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ থেকে রকেট ছাড়াই চন্দ্র-বিজয়ের কথা শুনে ভ্যবাচ্যাকা খেয়েছিল নাসার বিজ্ঞানীরাও। কৌতূহলে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল তাঁরা। চাঁদের দিকে বিশাল টেলিস্কোপ তাক করে তাঁরাও ‘সহমত’-এ নত হয়েছিল। কারণ, টেলিস্কপে তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন চাঁদের কলঙ্ক।
সুপ্ত মিয়ার এখনো মনে পড়ে, চাঁদ সওদাগরের চন্দ্র-বিজয়ের খবর শুনে চাঁদের মা বুড়িকে নিয়ে সেদিন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
কিন্তু সুপ্ত মিয়ার এখন এত কিছু ভাবার সময় নেই। বিপ্লবের তিন মাস পর একে একে তিনি বট আইডিগুলোকে প্রকাশিত হতে দেখছেন। আর অবাক হয়ে ভাবছেন, এই বটগুলো তো রিয়েল লাইফে ‘সহমত ভাই’ হয়ে এত দিন ‘ছাএ’ লীগের লুঙ্গির তলায় ছিল!
সুপ্ত মিয়া জানেন, টানা ১৬ বছর কারও লুঙ্গির তলায় লুকিয়ে থাকার যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ আর অমানবিক হতে পারে। তিন দিন গোসল না করলেই শরীর থেকে যা বাজে গন্ধ আসে! আর ১৬ বছর তো অনেক দিন। তবে সুপ্ত মিয়া অবাক হয়েছেন বট আইডিগুলোর মালিকদের রিয়েল লাইফে অত্যন্ত নাদুসনদুস সুরত দেখে।
গত তিন মাসে মিস্টার সুপ্ত মিয়া গুপ্ত বটগুলোকে রিয়েল লাইফে আইডেন্টিফাই করার একটা ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
প্রথমে বটদের জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘আপনি কি বট?’
যদি তাঁরা বলে, ‘না, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী।’
এরপর তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘আপনি দুপুরে ভাত খাবেন?
তখন উত্তরে যদি বলা হয়, ‘খাবো। তবে নির্বাচন চাই না।’
তখন তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন নির্বাচন চান না?’
এ প্রশ্নের জবাবেও যদি দেখা যায়, সারা দুনিয়ার ইতিহাস বলেলেও তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন না চাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ বলতে পারছেন না, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এই ব্যাটা অনিবার্যভাবেই বট।
একেবারে শেষ পর্যায়ে সব সংশয় থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে আরও দুটি প্রশ্ন:
এক. ‘১৯৭১-এর গণহত্যায় কার কার ভূমিকা ছিল?’
সে সময় যদি সারা দুনিয়ার ইতিহাস জানা ‘মেধাবী’রা বলে বসে, ‘তখন তো আমার জন্ম হয় নাই, ছোট ছিলাম।’ তবে আপনাদের যা বোঝার বুঝে নেবেন। তার পরও সতর্কতাবশত করতে পারেন ‘লাস্ট কোশ্চেন’, ‘আপনারা কী চান?’
শেষ উত্তরেও যদি তাঁরা বলে, ‘১, ২, ৩, ৪ অমুক নেতার *** মার’, তাহলে খেল খতম, আর সংশয় নিচে বাঁচার দরকার নেই। গুপ্ত নির্ধারণে সুপ্ত মিয়ার ফর্মুলা সফল।
অবশ্য সুপ্ত মিয়া জানে, কেন নির্বাচন চায় না বট বাহিনী। একেকটি বট আইডি থেকে ২০টি করে নির্বাচনবিরোধী পোস্ট, ৩০টি কমেন্ট, দুইবার হারকিউলিসদের শাসনের পক্ষে ওকালতির পোস্টগুলো প্রায়ই সুপ্ত মিয়ার চোখে পড়ে।
মজার বিষয় হলো, এই বট বাহিনী যেভাবে ফেসবুকে সক্রিয় থাকে, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেই তারা প্রথমে চেক করে, আজ কী গুজব ছড়ানো যায়। তখন কেউ হয়তো বলল, ‘অমুক নেতা নাকি পানিতে হেঁটে গিয়েছেন,’ সঙ্গে সঙ্গে সদলবলে তাঁরা হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করে: #একেই বলে প্রকৃত নেতা_। বিকেলে কেউ যদি বলে, ‘নির্বাচন হলে আকাশ থেকে আগুন পড়বে’, তখনো সঙ্গে সঙ্গে ২০০ বট একযোগে তা শেয়ার দিয়ে বসে।
সুপ্ত মিয়া এদের ভালোভাবেই জানেন। বটদের এই অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ অন্য কিছু নয়, বরং উগান্ডার নয়া সরকারের সময়ে পাওয়া বিশেষ সুবিধা। এ সুবিধার ঝরনাধারা দেখে যে কেউই বুঝে যাবে, এরা কেন নির্বাচন চায় না। কারণ, নির্বাচন মানেই অনিশ্চয়তা। আর অনিশ্চয়তায় কোন আহাম্মক থাকতে চায়! আর যা-ই হোক, মগবাজার কলোনীর বাসিন্দারা আর যা-ই হোক, আহাম্মক হতে পারে না।
৩.
আরব্য রজনীর এক দেশে ছিল এক অন্তর্বর্তীকালীন চেরাগ। কেউ বলে, ওটা ছিল আন্দোলনের উত্তরাধিকার, কেউ বলে অভ্যুত্থানের পরের রাজনৈতিক জাদু। কিন্তু আসলে তা ছিল এক পুরোনো মলিন চেরাগ, যেটি ঘষলেই বেরিয়ে আসে বিশাল এক দৈত্য। নাম: ‘সহমত কমিশন’।
এখন চেরাগটি পড়েছে নতুন এক আলাদিনের হাতে। দেশজুড়ে যে ইস্যুই হোক—অর্থনীতি, শিক্ষা, দুর্নীতি বা স্রেফ বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে যাওয়া—আলাদিন আর কিছুই দেখে না। আলাদিন বরং চেরাগ ঘষে দৈত্যকে কান্নাকণ্ঠে বলেন: ‘আমাকে দাও নির্বাচন! আমাকে দাও নির্বাচন! আমাকে দাও নির্বাচন!’
দৈত্য প্রথমে ভেবেছিল, আলাদিনের মতো মানি লোকের নিশ্চয় অনেক বড় স্বপ্ন রাখবে। হয়তো প্রথমে চাইবে টেকসই অর্থনীতি, হয়তো চাইবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি, চাইবে দুর্নীতি মুক্ত ও শ্রমিকবান্ধব এক সমাজ। কিন্তু না—এই আলাদিনের একটাই ডায়লগ, যেন পুরোনো ক্যাসেটে টেপ আটকে গেছে।
আলাদিনের প্রথম ইচ্ছা হলো, ‘হে দৈত্য, আমাকে এমন একটি নির্বাচন দাও, যেখানে আমি নিশ্চিতভাবে জিতব।’
তাঁর কথা শুনে বেচারা দৈত্য হেসেই ফেলল। বলল, ‘আরে মিয়া, নির্বাচন মানেই তো অনিশ্চয়তা। তাতে তুমি জিততেও পার, হারতেও পার।’
আলাদিন তৎক্ষণাত তেড়ে উঠলেন, ‘না না, আমি যে নির্বাচন চাই, সেখানে হারার সুযোগ থাকবে না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল দৈত্য, ‘তাহলে তো সেটা নির্বাচন নয়, বরং বাকশাল-সিন্ড্রম।’
এবার আলাদিনের দ্বিতীয় ইচ্ছা: তিনি বললেন, ‘হে দৈত্য ভাই, আমাকে তুমি এমন এক নির্বাচন দাও, যেখানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তেমনভাবে থাকবে না।’
দৈত্য বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তাহলে তো ভোটারদের আর দরকার নেই। আয়না রেখে দাও, তাতে অন্তত নিজের মুখে ভোট পড়বে।’
কথাটি আলাদিনের পছন্দ হলো কি না, ঠিক বোঝা গেল না। কারণ, বেশির ভাগ সময় আলাদিন ঠিকঠাক কথা বলারই প্রাক্টিস করেন। তবে যখন বেশি কথা বলে তখনই খান ধরা। তাই বেশি কথায় না গিয়ে দৈত্যের কাছে তৃতীয় ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন আলাদিন: ‘দৈত্য হে, এবার আমার শেষ ইচ্ছা—আমাকে এমন এক নির্বাচন দাও, যেখানে আমি অনেক দিন ক্ষমতায় থাকব।’
আলাদিনের কথায় প্রথমে হায় হায় করে উঠল দৈত্য। পরে মাথায় নিদ্রাকুসুম তেল দিয়ে বলল, ‘হায় রে! ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিল না!
নটেগাছ মুড়িয়ে আলাদিনের তিন ইচ্ছা এভাবেই ফুরোল। দৈত্য বুঝল, আসলে আলাদিনের কোনো কল্পনা নেই, নেই কোনো বিশেষ বক্তব্য। তাঁর শুধু একটাই মন্ত্র: ‘নির্বাচন চাই।’ এটা কি চিনির সামনে পিঁপড়ার ছটফটানি?
মানুষ প্রথমে ভেবেছিল, আলাদিনের চেরাগ হয়তো নতুন সূর্য আনবে। কিন্তু দেখা গেল, চেরাগ আসলে টর্চলাইটও নয়। শুধু কুয়াশার ভেতর একধরনের নেশা তৈরি করে। আর প্রতিবার নতুন সংকটে চেরাগ ঘঁষে চেচিয়ে ওঠেন আলাদিন,‘নির্বাচন চাই।’
নামহীন অরব্য রজনীময় দেশটির জীবন ও রাজনৈতিক কৌতুকময় বাস্তবতা এখন এতটাই অদ্ভুত যে সবাই জানে—যদি কালকে মহাসড়কে গরু হারায় অথবা বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ে, তবুও চেরাগ ঘষা হবে। আর স্লোগান সেই একই: ‘নির্বাচন চাই, নির্বাচন…’
দেশে নির্বাচন না হলে কী কী ভয়ংকর পরিণতি আসবে, তা নিয়ে আলাদিনের আলাপ এত নাটকীয় যে আরব্য রজনীর নিষ্ঠুর ভূতেরাও কেঁদে ফেলে।
এদিকে এমন সব অদ্ভুত দৃশ্যপট এঁকে আলাদিন নিজেকেই আনন্দ দেয়, যেন শিশুদের জন্য লেখা হয়েছে এই সব রূপকথা।
তবে এই গল্পের শেষে উপসংহার কোথায়? কী বলা যাবে শেষে? চরিত্রদের সব গুজবই কি কাল্পনিক? আসলে গুজবপ্রিয় মানুষ জেনে এবং না জেনে যেমন গুজবই ছড়ায়, তেমনি কেউ কেউ ছড়ায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তাই একটা প্রশ্ন দিয়ে এই কাল্পনিক লেখার ইতি টানা যাক। ধরা যাক, নামহীন কোনো এক দেশে নির্বাচন হয়েই গেল, এরপর কথাকাহিনি আর গুজবের ‘চেরাগরাজ্য’টা কি হাতছাড়া হয়ে যাবে, নাকি তখন বাজারে চাউর হবে নতুন গুজব! সে সময় কী নিয়ে কথা বলবে সবাই?

গুজবপ্রিয় লোকেরা ইশপের গল্পের মতো রোজই বিশ্বাস করে গেছে, ‘রাখাল বালককে তুলে নিয়ে যেতে এই বুঝি বাঘ এল।’ কিন্তু আফসোস, জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারি আসে, মাঘের পর ফাল্গুন, দেশলাই কাঠি জ্বালালে আগুনও আসে, প্রিপেইড মিটারে হুদাই বিদ্যুৎ বিল অনেক বেশি আসে, তবু গুজবের রাখাল বালককে ধরতে আর বাঘ আসে না।
এই বাস্তবতায় একদিন ঘুম থেকে উঠে জনৈক ইনফ্লুয়েন্সার আবিষ্কার করলেন, তিনি একজন ‘গুজবরাজ’ হয়ে গেছেন! গত ১০ দিনে ফেসবুকে ও ইউটিউবে তিনি অন্তত ১০ বার দেশের সরকার ফেলে দিয়েছেন। প্রথম যেদিন তিনি ইউটিউবে সরকার ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেদিন অবশ্য অনেকেই বিশ্বাস করেছিল। এয়ারপোর্টের বাইরে আপা বাহিনী, বট বাহিনী, কট বাহিনী, এমনকি যে হারকিউলিস বাহিনীকে দিয়ে তিনি সরকার ফেলে দিতে চান, সেই বাহিনীরও কেউ কেউ উপস্থিত হয়েছিল তাঁর আগমন দেখতে। কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আর আসেননি। আর বিপ্লবের বিমান কারও জন্যই যেহেতু অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকে না, তাই ‘উত্তেজিত জনতাকে নিরাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল সেদিন।
কিন্তু তাতে দমে যাননি জনাব ইনফ্লুয়েন্সার। পরে টানা ছয় দিনে ৯ বার সরকার ফেলার ঘোষণা দিয়ে তিনি তাঁর আগের সব রেকর্ডও ভেঙে ফেলেছেন। ব্যক্তিগত অলিম্পিকে এ যেন এক স্বর্ণপদক জয়ের সমান ঘটনা।
অবশ্য সরকার ফেলে দেওয়াসংক্রান্ত ইস্যুতে ইনফ্লুয়েন্সার গুজবরাজের ব্যক্তিগত কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। তা ছাড়া গুজবরাজ হওয়া নিয়ে তিনি বিশেষ গর্বিতও নন। কারণ, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা বিভাগের প্রধান রবিন ডানবারের লেখায় পড়েছেন, যেসব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিস্কের নিওকর্টেক্সট তুলনামূলক বড়, তাঁরা সবাই-ই গুজব রটাতে পারে। এমনকি বানর বা শিম্পাঞ্জিও পারে। ইউটিউবে নিয়মিত বিবর্তনবিরোধী বয়ান দিলেও গুজবরাজ আসলে বিবর্তনের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখেন। নিয়মিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই বেলা চেক করেন, তাঁর চেহারা কোনোভাবে বানর বা শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কি না!
ব্যক্তিগত কোনো লাভ ক্ষতি না থাকলেও এগুলো তিনি করেন বাজারের স্বার্থে। কারণ তিনি জানেন, তাঁর গুজব শিলাজিতের শরবত বা কলিকাতা হারবালের বড়ির চেয়েও অধিক উত্তেজক। এক ফাইলই যথেষ্ট। কেউ এক ফাইল সেবন করলে মাধ্যাকর্ষণ বলও তাঁদের আর আটকে রাখতে পারবে না।
একই সঙ্গে তাঁর ফাইলগুলো সংক্রামক। কারণ, নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারম্যানের ‘মেনুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ বইটি তাঁর পড়া আছে। তাই তিনি জানেন, মূলধারার গণমাধ্যম যখন নীরব থাকে, তখন শূন্যস্থান পূরণ করতে গুজবের জুড়ি নেই। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, সে তথ্য জানতে চায়। তবে তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস যখন থাকে না, সেক্ষেত্রে বিকল্প সূত্রই তো ভরসা।
চমস্কির যেমন বলেছেন, ক্ষমতাধরেরা প্রায়ই বিভ্রান্তি তৈরি করে জনমতকে ভিন্নখাতে ঘোরাতে চান। এ কাজ তাঁরা করেন আংশিক সত্য, নির্বাচিত তথ্য, বা গুজব ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। ফলে গুজব কে বা কারা ছড়াচ্ছে, তা বোঝা অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। আর কোনো গুজবকে বাতাসের বেগে প্রবাহিত করার জন্য বর্তমান সময়ে ‘মব’-এর চেয়ে ক্ষমতাবান আর কেউই-বা আছে!
তো ইনফ্লুয়েন্সারের যে ক্ষমতার কথা বলছিলাম, এবার আবার সেখানেই ফেরা যাক। এই ক্ষমতা দিয়ে ‘গুজবরাজ’ উপাধিপ্রাপ্ত ইনফ্লুয়েন্সার কিই-বা করেন? করেন মূলত বাজার ব্যবস্থাপনা। কারণ, তিনি জানেন বঙ্গবাজারের লুঙ্গি ব্যবসায়ীদের যদি উত্তেজনার তুঙ্গে উঠানো যায়, তাতে লাভ মূলত মুম্বাইয়ের হাফপ্যান্ট ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এই পৃথিবীতে যেহেতু হাফপ্যান্ট ব্যবসায়ীদের তুলনায় আন্ডারওয়ার ব্যবসায়ীদেরই বেশি প্রভাব, ফলে ইনফ্লুয়েন্সার সাহেবকে রিপ্লেস করতেও গুজব কমিউনিটির খুব বেশি সময় লাগল না।
শেষমেশ গুজবরাজ ইনফ্লুয়েন্সার নিজেই গুজবে আক্রান্ত হলেন। একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করলেন, ‘আগামীকাল সরকার পড়ে যাবে।’ জনতা সঙ্গে সঙ্গে তা বিশ্বাস করল।
এরপর অ্যাকাউন্টে লগইন করতে গিয়ে দেখলেন, অ্যাকাউন্টটি ‘মেমোরিয়াল মুড’-এ চলে গেছে। তিনি বুঝতে পারেননি যে তিনিই ধীরে ধীরে গুজববাজদের সরকার হয়ে উঠেছিলেন! এবার তিনি বসে বসে হাততালি দিলেন। কারণ এই প্রথম, তাঁর নিজের গুজবই সত্যি হলো।
২.
উগান্ডায় বিপ্লবের তিন মাস পর ফেসবুকে ঢুকেই সুপ্ত মিয়ার মনে পড়ল সেই দূর অতীতের কথা, যখন তিনি অনলাইনে প্রথম ‘বট আইডি’ আবিষ্কার করেছিলেন। এক যুগের বেশি সময় আগের কথা, সেদিন ছিল চাঁদ সওদাগরের চন্দ্র-আহরণের দিন। মগবাজারের হাজার হাজার বট সেদিন চাঁদে দেখতে পেয়েছিল তাঁদের বড় মিয়া চাঁদ সওদাগরকে। ফেসবুকে তাঁরা বুস্ট করে প্রচার করেছিল সে সংবাদ।
তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ থেকে রকেট ছাড়াই চন্দ্র-বিজয়ের কথা শুনে ভ্যবাচ্যাকা খেয়েছিল নাসার বিজ্ঞানীরাও। কৌতূহলে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল তাঁরা। চাঁদের দিকে বিশাল টেলিস্কোপ তাক করে তাঁরাও ‘সহমত’-এ নত হয়েছিল। কারণ, টেলিস্কপে তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন চাঁদের কলঙ্ক।
সুপ্ত মিয়ার এখনো মনে পড়ে, চাঁদ সওদাগরের চন্দ্র-বিজয়ের খবর শুনে চাঁদের মা বুড়িকে নিয়ে সেদিন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
কিন্তু সুপ্ত মিয়ার এখন এত কিছু ভাবার সময় নেই। বিপ্লবের তিন মাস পর একে একে তিনি বট আইডিগুলোকে প্রকাশিত হতে দেখছেন। আর অবাক হয়ে ভাবছেন, এই বটগুলো তো রিয়েল লাইফে ‘সহমত ভাই’ হয়ে এত দিন ‘ছাএ’ লীগের লুঙ্গির তলায় ছিল!
সুপ্ত মিয়া জানেন, টানা ১৬ বছর কারও লুঙ্গির তলায় লুকিয়ে থাকার যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ আর অমানবিক হতে পারে। তিন দিন গোসল না করলেই শরীর থেকে যা বাজে গন্ধ আসে! আর ১৬ বছর তো অনেক দিন। তবে সুপ্ত মিয়া অবাক হয়েছেন বট আইডিগুলোর মালিকদের রিয়েল লাইফে অত্যন্ত নাদুসনদুস সুরত দেখে।
গত তিন মাসে মিস্টার সুপ্ত মিয়া গুপ্ত বটগুলোকে রিয়েল লাইফে আইডেন্টিফাই করার একটা ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
প্রথমে বটদের জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘আপনি কি বট?’
যদি তাঁরা বলে, ‘না, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী।’
এরপর তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘আপনি দুপুরে ভাত খাবেন?
তখন উত্তরে যদি বলা হয়, ‘খাবো। তবে নির্বাচন চাই না।’
তখন তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন নির্বাচন চান না?’
এ প্রশ্নের জবাবেও যদি দেখা যায়, সারা দুনিয়ার ইতিহাস বলেলেও তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন না চাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ বলতে পারছেন না, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এই ব্যাটা অনিবার্যভাবেই বট।
একেবারে শেষ পর্যায়ে সব সংশয় থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের জিজ্ঞেস করতে হবে আরও দুটি প্রশ্ন:
এক. ‘১৯৭১-এর গণহত্যায় কার কার ভূমিকা ছিল?’
সে সময় যদি সারা দুনিয়ার ইতিহাস জানা ‘মেধাবী’রা বলে বসে, ‘তখন তো আমার জন্ম হয় নাই, ছোট ছিলাম।’ তবে আপনাদের যা বোঝার বুঝে নেবেন। তার পরও সতর্কতাবশত করতে পারেন ‘লাস্ট কোশ্চেন’, ‘আপনারা কী চান?’
শেষ উত্তরেও যদি তাঁরা বলে, ‘১, ২, ৩, ৪ অমুক নেতার *** মার’, তাহলে খেল খতম, আর সংশয় নিচে বাঁচার দরকার নেই। গুপ্ত নির্ধারণে সুপ্ত মিয়ার ফর্মুলা সফল।
অবশ্য সুপ্ত মিয়া জানে, কেন নির্বাচন চায় না বট বাহিনী। একেকটি বট আইডি থেকে ২০টি করে নির্বাচনবিরোধী পোস্ট, ৩০টি কমেন্ট, দুইবার হারকিউলিসদের শাসনের পক্ষে ওকালতির পোস্টগুলো প্রায়ই সুপ্ত মিয়ার চোখে পড়ে।
মজার বিষয় হলো, এই বট বাহিনী যেভাবে ফেসবুকে সক্রিয় থাকে, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেই তারা প্রথমে চেক করে, আজ কী গুজব ছড়ানো যায়। তখন কেউ হয়তো বলল, ‘অমুক নেতা নাকি পানিতে হেঁটে গিয়েছেন,’ সঙ্গে সঙ্গে সদলবলে তাঁরা হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করে: #একেই বলে প্রকৃত নেতা_। বিকেলে কেউ যদি বলে, ‘নির্বাচন হলে আকাশ থেকে আগুন পড়বে’, তখনো সঙ্গে সঙ্গে ২০০ বট একযোগে তা শেয়ার দিয়ে বসে।
সুপ্ত মিয়া এদের ভালোভাবেই জানেন। বটদের এই অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ অন্য কিছু নয়, বরং উগান্ডার নয়া সরকারের সময়ে পাওয়া বিশেষ সুবিধা। এ সুবিধার ঝরনাধারা দেখে যে কেউই বুঝে যাবে, এরা কেন নির্বাচন চায় না। কারণ, নির্বাচন মানেই অনিশ্চয়তা। আর অনিশ্চয়তায় কোন আহাম্মক থাকতে চায়! আর যা-ই হোক, মগবাজার কলোনীর বাসিন্দারা আর যা-ই হোক, আহাম্মক হতে পারে না।
৩.
আরব্য রজনীর এক দেশে ছিল এক অন্তর্বর্তীকালীন চেরাগ। কেউ বলে, ওটা ছিল আন্দোলনের উত্তরাধিকার, কেউ বলে অভ্যুত্থানের পরের রাজনৈতিক জাদু। কিন্তু আসলে তা ছিল এক পুরোনো মলিন চেরাগ, যেটি ঘষলেই বেরিয়ে আসে বিশাল এক দৈত্য। নাম: ‘সহমত কমিশন’।
এখন চেরাগটি পড়েছে নতুন এক আলাদিনের হাতে। দেশজুড়ে যে ইস্যুই হোক—অর্থনীতি, শিক্ষা, দুর্নীতি বা স্রেফ বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে যাওয়া—আলাদিন আর কিছুই দেখে না। আলাদিন বরং চেরাগ ঘষে দৈত্যকে কান্নাকণ্ঠে বলেন: ‘আমাকে দাও নির্বাচন! আমাকে দাও নির্বাচন! আমাকে দাও নির্বাচন!’
দৈত্য প্রথমে ভেবেছিল, আলাদিনের মতো মানি লোকের নিশ্চয় অনেক বড় স্বপ্ন রাখবে। হয়তো প্রথমে চাইবে টেকসই অর্থনীতি, হয়তো চাইবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি, চাইবে দুর্নীতি মুক্ত ও শ্রমিকবান্ধব এক সমাজ। কিন্তু না—এই আলাদিনের একটাই ডায়লগ, যেন পুরোনো ক্যাসেটে টেপ আটকে গেছে।
আলাদিনের প্রথম ইচ্ছা হলো, ‘হে দৈত্য, আমাকে এমন একটি নির্বাচন দাও, যেখানে আমি নিশ্চিতভাবে জিতব।’
তাঁর কথা শুনে বেচারা দৈত্য হেসেই ফেলল। বলল, ‘আরে মিয়া, নির্বাচন মানেই তো অনিশ্চয়তা। তাতে তুমি জিততেও পার, হারতেও পার।’
আলাদিন তৎক্ষণাত তেড়ে উঠলেন, ‘না না, আমি যে নির্বাচন চাই, সেখানে হারার সুযোগ থাকবে না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল দৈত্য, ‘তাহলে তো সেটা নির্বাচন নয়, বরং বাকশাল-সিন্ড্রম।’
এবার আলাদিনের দ্বিতীয় ইচ্ছা: তিনি বললেন, ‘হে দৈত্য ভাই, আমাকে তুমি এমন এক নির্বাচন দাও, যেখানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তেমনভাবে থাকবে না।’
দৈত্য বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তাহলে তো ভোটারদের আর দরকার নেই। আয়না রেখে দাও, তাতে অন্তত নিজের মুখে ভোট পড়বে।’
কথাটি আলাদিনের পছন্দ হলো কি না, ঠিক বোঝা গেল না। কারণ, বেশির ভাগ সময় আলাদিন ঠিকঠাক কথা বলারই প্রাক্টিস করেন। তবে যখন বেশি কথা বলে তখনই খান ধরা। তাই বেশি কথায় না গিয়ে দৈত্যের কাছে তৃতীয় ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন আলাদিন: ‘দৈত্য হে, এবার আমার শেষ ইচ্ছা—আমাকে এমন এক নির্বাচন দাও, যেখানে আমি অনেক দিন ক্ষমতায় থাকব।’
আলাদিনের কথায় প্রথমে হায় হায় করে উঠল দৈত্য। পরে মাথায় নিদ্রাকুসুম তেল দিয়ে বলল, ‘হায় রে! ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিল না!
নটেগাছ মুড়িয়ে আলাদিনের তিন ইচ্ছা এভাবেই ফুরোল। দৈত্য বুঝল, আসলে আলাদিনের কোনো কল্পনা নেই, নেই কোনো বিশেষ বক্তব্য। তাঁর শুধু একটাই মন্ত্র: ‘নির্বাচন চাই।’ এটা কি চিনির সামনে পিঁপড়ার ছটফটানি?
মানুষ প্রথমে ভেবেছিল, আলাদিনের চেরাগ হয়তো নতুন সূর্য আনবে। কিন্তু দেখা গেল, চেরাগ আসলে টর্চলাইটও নয়। শুধু কুয়াশার ভেতর একধরনের নেশা তৈরি করে। আর প্রতিবার নতুন সংকটে চেরাগ ঘঁষে চেচিয়ে ওঠেন আলাদিন,‘নির্বাচন চাই।’
নামহীন অরব্য রজনীময় দেশটির জীবন ও রাজনৈতিক কৌতুকময় বাস্তবতা এখন এতটাই অদ্ভুত যে সবাই জানে—যদি কালকে মহাসড়কে গরু হারায় অথবা বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ে, তবুও চেরাগ ঘষা হবে। আর স্লোগান সেই একই: ‘নির্বাচন চাই, নির্বাচন…’
দেশে নির্বাচন না হলে কী কী ভয়ংকর পরিণতি আসবে, তা নিয়ে আলাদিনের আলাপ এত নাটকীয় যে আরব্য রজনীর নিষ্ঠুর ভূতেরাও কেঁদে ফেলে।
এদিকে এমন সব অদ্ভুত দৃশ্যপট এঁকে আলাদিন নিজেকেই আনন্দ দেয়, যেন শিশুদের জন্য লেখা হয়েছে এই সব রূপকথা।
তবে এই গল্পের শেষে উপসংহার কোথায়? কী বলা যাবে শেষে? চরিত্রদের সব গুজবই কি কাল্পনিক? আসলে গুজবপ্রিয় মানুষ জেনে এবং না জেনে যেমন গুজবই ছড়ায়, তেমনি কেউ কেউ ছড়ায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তাই একটা প্রশ্ন দিয়ে এই কাল্পনিক লেখার ইতি টানা যাক। ধরা যাক, নামহীন কোনো এক দেশে নির্বাচন হয়েই গেল, এরপর কথাকাহিনি আর গুজবের ‘চেরাগরাজ্য’টা কি হাতছাড়া হয়ে যাবে, নাকি তখন বাজারে চাউর হবে নতুন গুজব! সে সময় কী নিয়ে কথা বলবে সবাই?
.png)

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ঋত্বিককুমার ঘটক একটা নাম বটে! তাঁকে যারা পছন্দ করেন কিংবা অপছন্দ করেন উভয় দলই স্বীকার করে নেবেন, ঋত্বিক এক বিশিষ্ট নাম।
৯ ঘণ্টা আগে
আজ চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের শততম জন্মদিন। তাঁর লেন্সে দেশভাগের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছাপিয়ে দাগ কেটেছিল এর গভীর মানবিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব। দেশভাগের ফলে তিনি নিজেই পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী হয়েছিলেন।
৯ ঘণ্টা আগে
আজ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের শততম জন্মবার্ষিকী। এই বিশেষ দিনে আমরা শুধু তাঁর শিল্পের বিশালতা নয়, তাঁর অস্থির জীবন, সংবেদনশীল সম্পর্ক এবং সমসাময়িকদের চোখে দেখা তাঁর বিদ্রোহী মনকেও নতুন করে পড়ার চেষ্টা করতে পারি।
১০ ঘণ্টা আগে
আজ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের শততম জন্মবার্ষিকী। নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে।’ কিন্তু এই খুনের প্রক্রিয়া কেমন?
১১ ঘণ্টা আগে