leadT1ad

কী স্মৃতি নিয়ে বড় হচ্ছে বারান্দা-বন্দী শিশুরা

এআই জেনারেটেড ছবি

আমাদের বারান্দার শিশুটার সঙ্গে পাশের বারান্দার শিশুটার বন্ধুত্ব পুরোনো হতে চলল। তাদের আলাদা খাঁচা। শহরগুলোতে তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলে ঘরে বন্দী থাকে। বারান্দা থেকে আকাশ দেখে। তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে। আমাদের বাসার বাবুটা পাশের বাসার পিচ্চির কান্না শুনে বলে, বাবা, বাবু কান্না করে। তাঁর সঙ্গে সে সম্পর্কের সুতা বোনে নিতান্ত শব্দ দিয়ে। একে অন্যকে দেখে। আমাদের বাড়ির বা পাশের বাড়ির শিশুটা কি ভাগ্যবান? ঢাকা বা এইসব মেট্রোপলিটনে কাজ থেকে ফেরা ক্লান্ত মা-বাবার একক পরিবারের সন্তানেরা কী বিচ্ছিন্ন এক বারান্দা-বন্দী জীবন কাটাচ্ছে?

বারান্দায় এইসব বিষণ্ণ বাচ্চারা কী স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠছে? ভূতের ভয়ের চেয়ে বেশি করে কি তাদের গ্রাস করে একাকিত্বের ভয়? তাদের রিয়ালিটির ভেতর আরেক রিয়ালিটি খেলা করে। তাদের ক্লান্ত করে।

এই শহরের একক পরিবারগুলোর অনেকেই ‘চাইল্ড কেয়ার’ এফোর্ট করতে পারেন না। আবার যারা একটু বড় হচ্ছে, প্রাথমিক শেষ করছে, উচ্চ মাধ্যমিকে যাওয়া শুরু করছে—তাদের কাঁধে আরও বেশি চাপ। এইসব শিশুদের এমনকি নিজের যত্নের দায়িত্বও নিজেকেই নিতে হচ্ছে।

তাদের স্মৃতিতে কাজলা দিদি নেই, ফুলের গন্ধে ঘুম না আসা নেই। আর জোনাক? হা হা, জোনাক! কোথায়? দুনিয়া যেভাবে আমরা বিষে ভরেছি, শহর কী, গ্রামেও জোনাক নেই? তবু তো ফোটে ফুল, ধুলা-দূষণে ঘোলাটে আকাশে ওঠে চাঁদ, (পাশের বারান্দা থেকে) কত পাখি গায়! যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে মনে রেখে বলাই যায়—

ফ্লাটগুলোর মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই

মাগো আমার সঙ্গ দেওয়ার মানুষ কই?

২.

এখনকার বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ঝুঁকিগুলোর কথাও আমি ভাবি। একদম সাধারণ ভাবনা হিসেবেই। আমরা যারা গ্রামে বা একটু খোলামেলা শহরে কাটিয়েছি, তারা কী এখনকার দিনের শিশুদের পুরোপুরি বুঝতে পারি? এমন কী হতে পারে, তারাও নস্টালজিক হবে এইসব বারান্দার স্মৃতি নিয়ে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে? তাদের আকাঙ্ক্ষার সীমা নিশ্চয়ই আল মাহমুদের ‘আমি না হয় পাখিই হবো,/ পাখির মতো বন্য’-এর মতো নয়। এই শিশুটি তাঁর কল্পনাকে নিয়ে বসে যাচ্ছে কম্পিউটারের সামনে। তাঁর আকাশ ভ্রমণ সে বাস্তব করতে এক নতুন রিয়ালিটি নির্মাণ করে। যেখানে তাঁর বানানো কোনো কার্টুন চরিত্র আকাশে ওড়ে সুপারম্যান হয়ে। আকাশে উড়তে পারা সে বানাতে শিখছে অনায়াসে, কিন্তু নানান জটিলতায় তার বেড়ে ওঠা; নিজে বাইরেও যেতে পারছে না। শারীরিক কসরত নেই, খেলাধুলার নেই; ক্লান্তি নেই—তারাও রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে থাকে। তারাও আক্রান্ত অবিসিটিতে। সাঁতার জানে না, সাইকেল চালাতে জানে না, গাছে ওঠা শেখে নাই—এগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োজনও হয়তো নেই। এই শিশুরা বেড়ে উঠছে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে। পড়ছে অনেক পড়া। বইছে বইয়ের বোঝা। ডিজিটালি করছে অনেক কাজ। কিন্তু জীবনকে শিখছে কই?

অক্ষয় মালবেরিতে মণীন্দ্র গুপ্তের দাদা বলছিলেন, কলকাতার স্কুলে তাঁকে কী শেখাবে, সে অক্ষর জানে, হিসাব করতে জানে, বাজার করে হিসাব করে পয়সা দিতে-নিতে পারে, একা চলে আসতে পারে, আর কী শেখাবে কলকাতার স্কুল? মণীন্দ্রের দাদার মূল কথাটা হলো, স্কুল কী শেখায় অক্ষর আর গণিতের সূত্রে অভিযোজন ক্ষমতা ছাড়া?

হুমায়ূন আহমেদের ১৯৮৬ সালে বিটিভিতে দেখানো ‘একদিন হঠাৎ’ নামে নাটক আছে, যেখানে কাজল নামের এক বাচ্চাকে তার দাদা স্কুলে যেতে দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। স্কুলের বদলে পাগলাটে এক গৃহশিক্ষক নেয় পরিবারটি। হুমায়ুন ফরীদি সেই শিক্ষকের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন। কাজল নামে ছেলেটিকে শিক্ষার অংশ হিসেবে ঢাকার একটি অংশে ছেড়ে দিয়ে শিক্ষক বাসায় চলে আসেন। সেটা নিয়ে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিবারের, হুমায়ূন আহমদীয় উইট-সহ গল্প এগোয়। শেষে ছেলেটা ঠিকই ঢাকার ‘শিক্ষা সফর’ শেষে ঘরে ফিরে আসে। আপনারা জানেন কাজল নামটি হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম। আর যারা তাঁর শৈশব নিয়ে লেখাগুলো পড়েছেন, তাঁরা জানেন কী বর্ণীল ছিল হুমায়ূনের ছেলেবেলা।

৩.

মানুষ না কি তাঁর শৈশবে বাঁচে। বার বার ফিরতে চায়, ফিরে আসে শৈশবে। বয়স যত বাড়ে, তারা তত স্মৃতিচারণা করে। মিলেনিয়ালরা সম্ভবত স্মৃতিচারণার বয়সে পা রেখেছে। আমার এক বন্ধুর কথা আমি স্মরণ করি, যিনি বলেন, স্মৃতিচারণাকে ‘শিল্পের মর্যাদা’ দিতে। মা-বাবা, গেজেট, বাসার খেলনা… যাদের ভাগ্য ভালো, বারান্দা থেকে আকাশ দেখা, এইসব স্মৃতি নিয়ে যারা বড় হচ্ছে—না না, বড় হচ্ছে বলছি কেন, আমরা বড় করছি, তারা কী স্মৃতি নিয়ে বড় হচ্ছে? ডিজিটাল পর্দা, পড়ার চাপ, ঘর, বারান্দা, একাকিত্ব এবং বন্দিত্ব! আমাদের বারান্দার শিশুটার সঙ্গে পাশের বাসার শিশুটার বন্ধুত্ব পুরোনো হতে চলল। তাঁদের আলাদা খাঁচা। তাদের জমা হতে থাকা স্মৃতি এক, তারা কী চারণা করবে?

Ad 300x250

সম্পর্কিত