leadT1ad

বাংলাদেশ যেভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শান্তি রপ্তানিকারক’ দেশ হয়ে উঠল

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সেনা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের পরিচয় আজ শুধু একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নীরবে, নিভৃতে নতুন পরিচয় গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ; যা দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। সেই পরিচয়ের প্রতীক হলো জাতিসংঘের নীল হেলমেট।

বারুদের গন্ধের বিপরীতে শান্তির জলপাই হাতে বিশ্বের সংঘাতময় প্রান্তরে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন, তা রূপকথার মতোই। কিন্তু কীভাবে একাত্তরের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা দেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশে পরিণত হলো? এর পেছনে লুকিয়ে আছে দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি, পেশাদারিত্ব ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার জটিল কিন্তু সফল সমীকরণ।

শেকড়ের সন্ধানে

এই গৌরবময় যাত্রার সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে, ১৯৮৮ সালে। স্নায়ুযুদ্ধের বরফ তখন গলতে শুরু করেছে, আর জাতিসংঘ বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন ও উদ্যমী ভূমিকা নিতে চলেছে। ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো তার সামরিক বাহিনীকে পাঠায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। সেই প্রথম মিশন ছিল ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপে (ইউএনআইএমডিজি), যেখানে মাত্র ১৫ জন বাংলাদেশি অফিসার অংশ নিয়েছিলেন। সংখ্যায় কম হলেও, এটি ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’—এই নীতিই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার পথে চালিত করেছে। সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজের ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ ছিল সেই সুযোগেরই সার্থক ব্যবহার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিজেরা গণহত্যার শিকার হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভ করায়, শান্তি ও মানবতার প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং আন্তরিক। সেই আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে।

বর্তমান চিত্র: কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

শুরুটা মাত্র ১৫ জন অফিসার দিয়ে হলেও, আজ বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ সেনা ও পুলিশ প্রেরণকারী দেশগুলোর একটি। আফ্রিকার সংঘাতময় দেশগুলো, যেমন—গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদান, মালি ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মিশনগুলোতে হাজার হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছেন।

২০২৫-এর আগস্টের পরিসংখ্যান অনুসারে বর্তমানে ৪৪৪ নারীসহ ৫ হাজার ৬৯৬ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী পৃথিবীর ১০টি দেশে নিজেদের মিশনে নিয়োজিত আছেন। বিশ্বশান্তি রক্ষার এ যাত্রায় গত ৩৫ বছরে জীবন দিয়েছেন ১৬৮ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী।

তাদের দায়িত্বের পরিধিও এখন অনেক বিস্তৃত। তারা কেবল বিবদমান পক্ষগুলোকে আলাদা করাই নয়, বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তরে মানবিকতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাদের প্রকৌশল ইউনিটগুলো নির্মাণ করে রাস্তা আর সেতু, যা বিচ্ছিন্ন জন জুড়ে দেয় মূল স্রোতের সঙ্গে। তাদের মেডিকেল টিমগুলো ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে বিনামূল্যে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে চিকিৎসাসেবা দেয়, যা স্থানীয় জনগণের কাছে তাদের ‘ত্রাতা’র আসনে বসিয়েছে। তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করে, যা শান্তিরক্ষার সবচেয়ে কঠিন কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ—‘হৃদয় ও মন জয় করা’। বিশেষ করে, বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা তাদের দক্ষতা ও সংবেদনশীলতার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সেনা। ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সেনা। ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধ ও সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া এবং তাদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সিয়েরা লিওনের মিশন হয়তো শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অবদানের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। নব্বইয়ের দশকের শেষে দেশটি যখন ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত, বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরইউএফ-এর অত্যাচারে জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই সেখানে জাতিসংঘের পতাকাতলে পা রাখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা কেবল বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রই করেনি, বরং নিজেদের পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা ও মানবিক আচরণ দিয়ে জয় করে নিয়েছিল সিয়েরা লিওনের সাধারণ মানুষের মন। তাদের এই অসামান্য অবদানের প্রতিদান হিসেবে ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনের সরকার বাংলাকে তাদের অন্যতম সম্মানসূচক দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেয়।

এই গৌরবময় যাত্রার পেছনে রয়েছে বিরাট আত্মত্যাগের ইতিহাসও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৬৮ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের এই সর্বোচ্চ ত্যাগই নীল হেলমেটের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকারকে আরও মহিমান্বিত করেছে।

রেমিট্যান্স ও পেশাদারিত্বের সমীকরণ

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের এই ব্যাপক অংশগ্রহণের পেছনে মানবিক ও কূটনৈতিক কারণের পাশাপাশি শক্তিশালী অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিও কাজ করে। এটি কোনো গোপন বিষয় নয়, বরং বাস্তবসম্মত ও কার্যকর কৌশল। জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত প্রত্যেক সদস্য তাদের বেতন ও ভাতা পান বৈদেশিক মুদ্রা, মূলত মার্কিন ডলারে। এই অর্থ যখন সরকারি চ্যানেলে দেশে ফেরত আসে, তখন তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করে। এটি এক অর্থে সেবা রপ্তানির মতোই, যেখানে বাংলাদেশ তার সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা ও পেশাদারত্বকে বিশ্ব শান্তির জন্য ‘রপ্তানি’ করছে এবং তার বিনিময়ে অর্জন করছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস তৈরি পোশাক খাত বা প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি, শান্তিরক্ষা মিশন থেকে প্রাপ্ত এই অর্থও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি এই মিশনগুলো বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বিরাট প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রও বটে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ, অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, এবং জটিল ও সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিজ্ঞতা—এই সবকিছুই বাংলাদেশি সৈন্যদের পেশাগত দক্ষতাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছে। কঙ্গোর গহীন জঙ্গল, মালির তপ্ত মরুভূমি বা দক্ষিণ সুদানের প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: কেন এই অবদান এত গুরুত্বপূর্ণ

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এই ব্যাপক অবদান বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। এটি এখন বাংলাদেশের ‘সফট পাওয়ার’ বা নীরব কূটনীতির বিশাল হাতিয়ার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে নিজেকে দায়িত্বশীল, শান্তিপ্রিয় ও পেশাদার রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

এই ভূমিকা বাংলাদেশকে ভূ-রাজনৈতিকভাবেও লাভবান করেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে এই মিশনগুলো অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। এর চেয়েও বড় কথা, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলে, রোহিঙ্গা সংকট বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা সহজতর হয়েছে।

যখন বাংলাদেশ কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলে, তখন বিশ্বের শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে তার কণ্ঠস্বরকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে শোনা হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটি নিজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যপ্রার্থী ছিল, সেই দেশই আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শান্তি রপ্তানিকারক’-দের একজন। এই রূপান্তর এক কথায় বিস্ময়কর। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য কেবল বৈদেশিক নীতি বা অর্থনৈতিক কৌশল নয়; বরং জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা প্রমাণ করে, সঠিক নেতৃত্ব, পেশাদারিত্ব ও মানবিক অঙ্গীকার থাকলে সীমিত সম্পদের দেশও বিশ্বমঞ্চে কতটা ইতিবাচক ও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে। নীল হেলমেটের নিচে বাংলাদেশের সৈন্যরা কেবল বিশ্বের অন্য দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছেন না, তারা নিজ দেশের জন্যও বয়ে আনছেন সম্মান, সমৃদ্ধি আর নতুন পরিচয়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত