বিশ্ব শিশু দিবসের আলোচনায় আমরা সচরাচর ‘শিশু’ বলতে খুব অল্পবয়সী সন্তানদের কথা বুঝি। কিন্তু আইন ও আন্তর্জাতিক শিশুঅধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। তাদের কেউ শিশু, কেউ অল্পবয়সী কিশোর, আবার কেউ কিশোর-তরুণ। এই বয়সসীমাটি শুধু একটি আইনি সংজ্ঞা নয়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এর গভীর তাৎপর্য আছে। কারণ আমাদের স্বাধীনতা, ভাষা, গণতন্ত্র—এ সবকিছুর মাটিতে লেগে আছে অগণিত শিশু-কিশোরের রক্ত। যাদের কেতাবি ভাষায় ‘শিশু’ হিসেবেই চিহ্নিত করতে হয়। ক্ষুদিরাম থেকে অহিউল্লাহ, মতিউর, ‘৭১-এর লালু-টিটুরা এবং সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের শত শত শহীদ—এই পুরো ধারাই প্রমাণ করে, বাংলার ইতিহাসে শিশু-কিশোরেরা কখনোই কেবল ভবিষ্যৎ নয়; তারা বারবার হয়ে উঠেছে জাতির তৎকালীন লড়াইয়ের সম্মুখসারির সৈনিক।
ক্ষুদিরাম বসু। সংগৃহীত ছবিপ্রথম স্ফুলিঙ্গ: ক্ষুদিরাম বসু
উনিশ শতকের শেষভাগ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসছে বাংলা। সেই আগুনেরই এক স্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন মেদিনীপুরের এক অকুতোভয় কিশোর, ক্ষুদিরাম বসু। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসিকাষ্ঠে জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন তিনি। তার ‘অপরাধ’ ছিল, অত্যাচারী ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, নিহত হয়েছিলেন দুজন নিরপরাধ ইংরেজ নারী। কিন্তু ক্ষুদিরামের দুঃসাহসিক পদক্ষেপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত।
বিচারের নামে প্রহসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ক্ষুধিরাম ছিলেন অবিচল। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে তার মুখে লেগে থাকা সেই কিংবদন্তীর হাসি ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি এক কিশোরের চূড়ান্ত অবজ্ঞার প্রতীক। ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগ বাংলার তরুণদের মধ্যে যে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তা আর কখনোই নেভেনি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার প্রথম ও আদি শিশুবিপ্লবী, যার দেখানো পথেই হেঁটেছে ভবিষ্যতের অগণিত সংগ্রামী।
অহিউল্লাহ। সংগৃহীত ছবিভাষার জন্য প্রাণ: অহিউল্লাহ
ক্ষুদিরামের ফাঁসির কয়েক দশক পর, বাংলার তরুণদের লড়তে হয়েছিল এক ভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে। এবার লড়াইটা ছিল নিজের পরিচয়ের জন্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করে বাংলা ভাষার দাবিকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল ছাত্র-জনতার উত্তাল মিছিল। সেই মিছিলেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো তরুণেরা। কিন্তু এই শহীদের তালিকায় লুকিয়ে আছে এক কিশোরের নাম। অহিউল্লাহ। মাত্র দশ বছর বয়সী এই শিশু সেদিন নবাবপুর রোডে তার বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাষার জন্য লড়তে থাকা বড় ভাইদের মিছিলে পুলিশের গুলি এসে কেড়ে নেয় তার প্রাণ। অহিউল্লাহর কচি বুকের রক্তে লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষার অক্ষর। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে কনিষ্ঠ শহীদ—এক নীরব বিপ্লবী শিশু।
মতিউর রহমান মল্লিক। সংগৃহীত ছবিগণতন্ত্রের জন্য মতিউর
৫২-এর পথ ধরে ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান। এবার লড়াই আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামের এক অবিনশ্বর নাম মতিউর রহমান মল্লিক। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির এই মেধাবী ছাত্রটি বিজ্ঞান বিভাগে পড়ত। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি তার কিশোর মনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। পরিবারের সদস্যদের না জানিয়েই তিনি চুপিচুপি যোগ দিতেন বড়দের মিছিলে।
২০ জানুয়ারি আসাদ হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার পর তার ভেতরের প্রতিবাদের আগুন আরও তীব্র হয়েছিল। ফলে ২৪শে জানুয়ারি, নিজের জন্মদিনের উৎসবকে উপেক্ষা করেই মতিউর নেমে এসেছিলেন রাজপথে। বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে মতিঝিলে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার রক্তমাখা শার্ট নিয়ে সহযোদ্ধারা যে মিছিল বের করেছিল, তা গণ-অভ্যুত্থানের আগুনে নতুন করে ঘি ঢালে। এক কিশোরের এই আত্মদান আইয়ুবের পতনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল।
আবু সালেক। সংগৃহীত ছবি৭১-এর বিপ্লবী শিশুরা
এর ঠিক দুই বছর পর, ১৯৭১ সালে, বাংলার কিশোরেরা আর শুধু মিছিলে নামেনি, হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। এবার লড়াইটা ছিল চূড়ান্ত মুক্তির, স্বাধীনতার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মিশে আছে শহীদুল ইসলাম লালু, আবু সালেকের মতো অসংখ্য শিশুবিপ্লবীর বীরত্বগাথা। মাত্র ১৩ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম লালু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বকনিষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত বীর প্রতীক। গোপালগঞ্জের এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করত, শত্রুর অবস্থান চিহ্নিত করত এবং সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নিত।
আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেকের বয়স ছিল মাত্র ১১ বা ১২। টাঙ্গাইলের এই দুঃসাহসী বালক মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্নার কাজ থেকে শুরু করে অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল। টিটু নামের আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা গ্রেনেড বহন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেন নির্ভয়ে। তার ছোট শরীরকে পাকিস্তানি সেনারা সন্দেহ করত না, আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বহুবার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র ও তথ্য পৌঁছে দিয়েছেন।
লালু, সালেক, টিটু বা অনুরা প্রমাণ করেছিল, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কাছে বয়স কেবলই একটি সংখ্যা।
শহীদুল ইসলাম লালু। সংগৃহীত ছবি২০১৮ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
২০১৮ সালে ঢাকার রাজপথ আবারও দখলে নেয় কিশোরেরা। এবার তাদের হাতে কোনো অস্ত্র বা রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না। ছিল স্কুলব্যাগ আর দাবি ছিল নিরাপদ সড়কের। দুই সহপাঠীর নির্মম মৃত্যুর প্রতিবাদে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা হাজার হাজার শিশু-কিশোর রাস্তায় নেমে আসে। তারা কেবল স্লোগানই দেয়নি, নিজেরাই শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই আন্দোলন ছিল এক নতুন ধরনের বিপ্লব—দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলার বিপ্লব, যার নেতৃত্বে ছিল কোমলমতি শিশুরা।
সাফকাত সামির। সংগৃহীত ছবিজুলাই অভ্যুত্থানে নজিরবিহীন শিশুহত্যা
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের যে স্ফুলিঙ্গ, তা যেন দাবানল হয়ে জ্বলে ওঠে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন, হাসিনার সরকারের নির্মম দমন-পীড়নের মুখে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। কিন্তু এবার শিশুদের আত্মত্যাগের পরিমাণ ছিল ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ এবং নির্মম। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই গণ-অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ১৮ বছরের নিচে ১৩৩ জন শিশু-কিশোর শহীদ হয়েছে।
এই নির্মমতার সবচেয়ে মর্মান্তিক প্রতীক হয়ে থাকবে চার বছর বয়সী আবদুল আহাদ। ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে নিজ বাসার আটতলার বারান্দায় বাবা-মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। নিচে তখন হেলমেট পরা অস্ত্রধারীরা আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি ছুড়ছিল। সেই বুলেটই এসে লাগে আহাদের চোখে, যা মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। পরদিন হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
আহাদের মতোই নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে আরও তিন শিশু: মিরপুরে ১০ বছর বয়সী সাফকাত সামির, উত্তরায় ১৫ বছর বয়সী নাঈমা সুলতানা এবং নারায়ণগঞ্জে ৬ বছর বয়সী রিয়া গোপ।
রিয়া গোপ। সংগৃহীত ছবিএই অভ্যুত্থানে প্রথম শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৭ জুলাই। ভোলা থেকে ঢাকায় বেড়াতে আসা ১৫ বছর বয়সী মো. সিয়াম যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। শহীদ হওয়া ১৩৩ শিশুর মধ্যে ১১৭ জনই গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। এই শিশুদের মধ্যে ৯১ জন ছিল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আর ৪১ জন ছিল বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত শিশু।
পুরান ঢাকার ১৬ বছর বয়সী দশম শ্রেণির ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাস ৫ই আগস্ট বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের জন্য একটি চিঠি লিখে গিয়েছিল: ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না... গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।’ ওই দিনই চানখাঁরপুলে গুলিতে তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, ১৭ বছর বয়সী ফারহান ফাইয়াজ মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে ফেসবুকে লিখেছিল, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’ ১৮ই জুলাই গুলিবিুদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়।
নাঈমা সুলতানা। সংগৃহীত ছবিএই কিশোরদের ওপর চালানো নৃশংসতার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া (১৭)-এর ঘটনায়। ২০শে জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের খুব কাছ থেকে একের পর এক গুলিতে তার শহীদ হওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আশুলিয়ায় দশম শ্রেণির ছাত্র আস সাবুরের (১৪) অর্ধদগ্ধ লাশ পেয়েছিল তার পরিবার। তার বড় ভাই রিজওয়ানুল ইসলামের কণ্ঠেই যেন ধ্বনিত হয় পুরো দেশের দাবি, ‘ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমন করতে গুলি করার নির্দেশ শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন... আমরা চাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’
ক্ষুদিরাম থেকে আহাদ—মাঝে পেরিয়ে গেছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়। বদলেছে শাসকের চেহারা, বদলেছে প্রতিবাদের ধরণ। কিন্তু একটি জিনিস বদলায়নি—বাংলার বুকে যখনই নেমে এসেছে অন্ধকার, তখনই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে তার সন্তানেরা। এই শিশুবিপ্লবিদেরর রক্তস্নাত পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, ভাষা, গণতন্ত্র এবং সর্বশেষ, ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি। তাদের অসমাপ্ত স্বপ্নগুলোই হয়তো আগামীর বাংলাদেশকে পথ দেখাবে।