leadT1ad

প্রয়াস: সেনাবাহিনীর যে প্রতিষ্ঠানে বিশেষ শিশুরা খুঁজে পায় স্বাভাবিক জীবনের স্পন্দন

সুমন সুবহান
সুমন সুবহান

২০০৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় পথচলা শুরু করে ‘প্রয়াস’। ছবি: সংগৃহীত

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতা এবং তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ—এই দুই কঠিন বাস্তবতার মাঝে শক্তিশালী সেতুবন্ধন তৈরি করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আমাদের সমাজে এখনো পর্যাপ্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক সহায়তার অভাব রয়েছে। ফলে সন্তানের সঠিক পরিচর্যা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন কর্মজীবী বাবা-মায়েরা দিশেহারা, সেই সন্ধিক্ষণে ‘প্রয়াস’ নামক বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি হাজারো পরিবারের জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছে।

২০০৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ছোট্ট উদ্যোগ হিসেবে এর পথচলা শুরু হলেও, আজ এটি কেবল একটি গতানুগতিক স্কুল নয়; এটি একটি সম্পূর্ণ সমন্বিত কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রয়াসের লক্ষ্য শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান নয়, বরং বিশেষ শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা, আন্তর্জাতিক মানের থেরাপি এবং সমাজের মূলধারায় সফলভাবে অন্তর্ভুক্ত করার একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বাস করে ‘বিশেষ শিশু, বিশেষ অধিকার’ মূলমন্ত্রে, যা প্রতিটি শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে। প্রয়াস তার নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম, বিশেষায়িত ক্লিনিক সেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করে সমাজের এই স্পর্শকাতর অংশটিকে স্বাবলম্বী করে তুলছে। এটি কেবল একটি মানবিক সহায়তা নয়, এটি আসলে একটি টেকসই মডেল যা প্রমাণ করে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও আন্তরিকতা থাকলে বিশেষ শিশুরা সমাজের জন্য বোঝা না হয়ে, তাদের নিজস্ব সক্ষমতা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনের স্পন্দন খুঁজে পেতে পারে। এই মডেলটি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির পথকে সুগম করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ ২০২১ অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের হার প্রায় ২ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী দেশের শিশু জনসংখ্যার প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ কোনো না কোনো কার্যক্ষম শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই হারটি শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা, থেরাপি এবং সহায়ক সেবার প্রয়োজনীয়তাকে জোরালোভাবে তুলে ধরে। এই ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হারকে যদি দেশের আনুমানিক শিশু জনসংখ্যার (প্রায় ৬ দশমিক ৮ কোটি) ওপর প্রয়োগ করা হয়, তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ লাখেরও বেশি। এই বিপুল সংখ্যক শিশুদের জন্য প্রয়োজন সুসমন্বিত সরকারি পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং কার্যকর সামাজিক অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ, যাতে তারা তাদের নাগরিক অধিকার এবং সুযোগ থেকে কখনো বঞ্চিত না হয়।

ক. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বলতে কাদের বোঝানো হয়

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বলতে এমন শিশুদের বোঝানো হয় যাদের শারীরিক, মানসিক, সংবেদনশীল, আবেগীয় বা শিক্ষণ ক্ষেত্রে এমন কিছু পার্থক্য বা চ্যালেঞ্জ থাকে যা তাদের সমবয়সী সাধারণ শিশুদের তুলনায় অতিরিক্ত বা বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন করে। এই শিশুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার-এ আক্রান্ত শিশুরা, যারা সামাজিক যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়ায় ভিন্নতা দেখায়। এছাড়াও রয়েছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুরা, যাদের শেখার ক্ষমতা সীমিত; নির্দিষ্ট শিখন অক্ষমতাতে (যেমন- ডিসলেক্সিয়া) ভোগা শিশুরা এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী (যেমন-সেরিব্রাল পালসি) বা শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার বা অন্যান্য আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুরাও এই শ্রেণীভুক্ত।

এই বিশেষ চাহিদাগুলো পূরণের জন্য তাদের ব্যক্তিগত শিক্ষণ পরিকল্পনা, নিয়মিত থেরাপিউটিক সেবা (যেমন-স্পিচ বা অকুপেশনাল থেরাপি) এবং সহায়ক প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়। সমাজের মূল উদ্দেশ্য হলো এই শিশুদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা, যাতে তারা তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী নিজেদের বিকশিত করতে পারে এবং সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বাভাবিক জীবনের স্পন্দন খুঁজে নিতে পারে।

খ. প্রয়াস-এর জন্ম ও মূলমন্ত্র

দেশের বিপুল বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন এবং সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম তৈরির অঙ্গীকার নিয়ে সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘প্রয়াস’ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। তবে ১৮ জুলাই ২০০৬ তারিখে অপেক্ষাকৃত সীমিত পরিসরে ‘সেনা সহায়ক স্কুল’ নামেই এটি আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরবর্তীতে সমাজের চাহিদা এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আরও ভালোভাবে প্রতিফলিত করার জন্য এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘প্রয়াস’। এই নামকরণের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটি তার মূল ভাবটিকে প্রতিষ্ঠিত করে, আর তা হলো বিশেষ শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা। প্রয়াসের এই মানবিক উদ্যোগের মূলমন্ত্র হলো, ‘বিশেষ শিশু, বিশেষ অধিকার’ (Special Child, Special Right)। এই মন্ত্রটি কেবল একটি স্লোগান নয় বরং এটি প্রতিষ্ঠানটির সকল কার্যক্রমের ভিত্তি, যা প্রতিটি শিশুকে তার জন্মগত অধিকার অনুযায়ী মানসম্মত শিক্ষা ও থেরাপি প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়।

গ. পরিচালনা, কাঠামো ও শিক্ষার্থী নির্বাচন

‘প্রয়াস’ একটি সুশৃঙ্খল এবং বিস্তৃত পরিচালনা কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর প্রধান ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি ঢাকা সেনানিবাসে ৫ দশমিক ৪৪ একরের বিশাল জায়গাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। সেনাবাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধান এবং পৃষ্ঠপোষকতা এটিকে উচ্চমানের এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষায়িত সেবার চাহিদা বাড়ায় প্রয়াস দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাসে তার কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। বর্তমানে রংপুর, চট্টগ্রাম, যশোর, কুমিল্লা, সাভার, ঘাটাইল, সিলেট, রাজশাহী, রামু ও বগুড়া সেনানিবাসে ‘প্রয়াস’-এর শাখা কার্যকর রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘প্রয়াস’ কেবল সেনা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ‘প্রয়াস’ বরং সমাজের সকল স্তরের শিশুদের অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাসী। সেজন্য মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ শতাংশ আসন বেসামরিক পরিবারের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিকারেই একটি জাতীয় মডেল এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

‘প্রয়াস’-এর সবকটি শাখায় বর্তমানে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু শিক্ষা গ্রহণ করলেও দেশের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সর্বমোট সংখ্যার অনুপাতে তা আসলেই নগণ্য। এজন্য শুধু সেনাবাহিনী একা নয়; সরকারি, বেসরকারি, এনজিও মিলে সমাজের সব পর্যায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে। কেন না বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি নিবন্ধিত বিশেষ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই লাখ শিশু শিক্ষা নিচ্ছে, যা মোট সংখ্যার মাত্র ৪০ শতাংশ। অথচ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ইউনিসেফের ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ ২০২১’ অনুযায়ী ৫-১৭ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রায় ৬০ শতাংশ এখনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘প্রয়াস’ মডেলটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে প্রচলিত মডেলগুলোর তুলনায় এক অদ্বিতীয় সমন্বয় নিয়ে এসেছে। এটি উন্নত দেশগুলোর মতো খণ্ড খণ্ড সেবার পরিবর্তে (শিক্ষা, থেরাপি ও ক্লিনিক) একই ছাদের নিচে সমস্ত প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করে একটি ‘ওয়ান-স্টপ সলিউশন’ প্রদান করে। মডেলটি শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার উপর জোর না দিয়ে, বিশেষ স্কুল এবং মূলধারার অন্তর্ভুক্তিমূলক বিদ্যালয়-এর একটি কার্যকর দ্বৈত রূপ প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেনাবাহিনীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা এই প্রতিষ্ঠানকে শৃঙ্খলা, উচ্চ নিরাপত্তা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা দিয়েছে যা কর্মজীবী বাবা-মায়েদের জন্য সর্বোচ্চ আস্থার প্রতীক। সব মিলিয়ে ‘প্রয়াস’ কেবল শিক্ষা দেয় না, এটি জীবনমুখী দক্ষতা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেশের বিশেষ শিক্ষা খাতে একটি স্বতন্ত্র ও অনুসরণীয় মডেল তৈরি করেছে। নিচে এপ্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হলো:

ক. বহুমুখী সেবার সমন্বয়

‘প্রয়াস’-এর মডেলটি বিদেশের অনেক উন্নত বিশেষ শিক্ষা মডেলের চেয়েও একটি স্বতন্ত্র সুবিধা প্রদান করে, একই ছাদের নিচে বহুমুখী সেবার সমন্বয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে (যেমন- ইউএস বা ইউকে) সাধারণত শিক্ষা (স্কুল) এবং থেরাপি (ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি) সেবাগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা বাহ্যিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর মাধ্যমে দেয়া হয়। কিন্তু ‘প্রয়াস’ মডেলটি স্পিচ, অকুপেশনাল, সেনসরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি এবং বিশেষায়িত ইন্টারভেনশন ক্লিনিক, সবকিছুকে একটি কেন্দ্রীয় কাঠামোর মধ্যে এনেছে। এটি কর্মজীবী বাবা-মায়েদের জন্য সময় ও আর্থিক সাশ্রয়ের একটি অনন্য উদাহরণ, যা বিদেশের অনেক মডেল অর্জন করতে পারেনি। উন্নত দেশে যেখানে বিভিন্ন সেবার জন্য বিভিন্ন অ্যাপয়েন্টমেন্টের পেছনে ছুটতে হয়, সেখানে ‘প্রয়াস’ একটি ‘ওয়ান-স্টপ সলিউশন’ হিসেবে কাজ করে।

খ. অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার দ্বৈত রূপ

অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে মতবাদ হলো, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের যতটা সম্ভব সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্রোতে রাখা। এর বিপরীতে ‘প্রয়াস’ বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি দ্বৈত মডেল অনুসরণ করে, একদিকে 'বিশেষ বিদ্যালয়সমূহ' (অটিজম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ইত্যাদি)-এর মাধ্যমে তীব্র প্রয়োজন থাকা শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় নিবিড় পরিচর্যা নিশ্চিত করা হয়। আবার অন্যদিকে ‘প্রত্যয় ইনক্লুসিভ স্কুল’-এর মাধ্যমে হালকা বা মাঝারি চ্যালেঞ্জ থাকা শিশুদের প্লে গ্রুপ থেকে ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়। এই সমন্বিত ও নমনীয় পদ্ধতি উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত কার্যকর, যেখানে অনেক শিশুর জন্য সরাসরি মূলধারার ক্লাসে স্থানান্তরিত হওয়া অসম্ভব। এটি প্রতিটি শিশুর সক্ষমতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, যা বিদেশের অনেক কঠোর ‘ফুল ইনক্লুশন’ নীতিতে অনুপস্থিত।

গ. জীবনমুখী দক্ষতা ও কর্মসংস্থান

বিদেশের বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব থাকলেও প্রায়শই তা উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজ স্তরে সীমিত থাকে। কিন্তু ‘প্রয়াস’ তার পাঠ্যক্রমের শুরু থেকেই বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং প্রাক-শৈশবকালীন বিকাশমূলক কার্যক্রমের উপর জোর দেয়। শিল্প পণ্য উৎপাদন, কারুশিল্প, সেলাই এবং বাগান করার মতো জীবনমুখী দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ‘প্রয়াস’ নিশ্চিত করে যে শিশুরা কেবল শিক্ষিতই হচ্ছে না, বরং তারা ভবিষ্যতের জন্য স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। এই ব্যবহারিক এবং কর্মসংস্থান কেন্দ্রিক পদ্ধতিটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদ হওয়ার পথে তাদের সহায়তা করে।

ঘ. পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা

‘প্রয়াস’ মডেলের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনা। উন্নত দেশের বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সরকারি বা স্থানীয় শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত ও অর্থায়িত হয়। কিন্তু ‘প্রয়াস’-এর সামরিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রতিষ্ঠানটিকে শুধু আর্থিক স্থিতিশীলতাই দেয়নি, বরং এটি শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো বেসরকারি বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্যতা এনেছে। এই সামরিক সুরক্ষা কর্মজীবী বাবা-মায়েদের মধ্যে যে গভীর আস্থার জন্ম দিয়েছে, তা বিদেশের সাধারণ সরকারি স্কুলগুলোতে অনুপস্থিত। এই বিশেষ ব্যবস্থাটি একটি মডেল হিসেবে প্রমাণ করে যে, সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে সেনাবাহিনীর মতো একটি সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কতটা কার্যকর হতে পারে।

বিশেষ শিক্ষা ও থেরাপি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই যোগ্য শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্টের তীব্র ঘাটতি ছিল, যা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের মানসম্পন্ন সেবা পাওয়ার পথে একটি প্রধান বাধা। এই জাতীয় সংকট নিরসনের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই ‘প্রয়াস’ প্রতিষ্ঠা করেছে ‘প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।’ এটি কেবল একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নয়, বরং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের অধিভুক্ত একটি পূর্ণাঙ্গ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ৪ বছর মেয়াদী অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্সসহ বিভিন্ন সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। এই কোর্সগুলোর পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে তৈরি করা হয়েছে যেখানে কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার উপরও জোর দেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সরাসরি ‘প্রয়াস’-এর বিভিন্ন বিশেষায়িত স্কুলে এবং থেরাপি সেন্টারে হাতে-কলমে কাজ করার সুযোগ পায়। ফলে এখান থেকে উত্তীর্ণ পেশাদাররা বিশেষ শিশুদের প্রয়োজন বোঝা ও তাদের জন্য কার্যকর শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। এভাবে এই প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ‘প্রয়াস’-এর চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং দেশের বিশেষ শিক্ষা খাতে একটি টেকসই ও গুণগত মানসম্পন্ন জনবল সরবরাহ নিশ্চিত করে সামগ্রিক মানোন্নয়নে এক মৌলিক ভূমিকা রাখছে।

কর্মজীবী বাবা-মায়েদের জন্য ‘প্রয়াস’ প্রতিষ্ঠানটি যে স্বস্তি এনেছে, তা কেবল একটি শিক্ষাকেন্দ্রের পরিষেবার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এই পরিবারগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সময়, আর্থিক সংস্থান এবং নির্ভরতাযোগ্য পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব। ‘প্রয়াস’ এই তিনটি ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ সমাধান নিয়ে এসেছে। ‘প্রয়াস’ তুলনামূলকভাবে স্বল্প ব্যয়ে আন্তর্জাতিক মানের থেরাপি (যেমন- স্পিচ, অকুপেশনাল, সেনসরি ইন্টিগ্রেশন) এবং বিশেষায়িত শিক্ষা প্রদান করে। বেসরকারি থেরাপি সেন্টারগুলোতে একটি সেশনের জন্য যেখানে বিপুল অর্থ খরচ হয়, সেখানে ‘প্রয়াস’-এর সাশ্রয়ী প্যাকেজ কর্মজীবী বাবা-মায়েদের আর্থিক বোঝা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, বিশেষ করে যারা নিয়মিত থেরাপি দিতে বাধ্য। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু একই ছাদের নিচে শিক্ষা ও মাল্টিপল থেরাপি সেবা প্রদান করে, তাই বাবা-মায়েদের ভিন্ন ভিন্ন সেবার জন্য একাধিক স্থানে ছুটতে হয় না, ফলে দামী কর্মঘণ্টা বেঁচে যায়। সেনানিবাসের ভেতরে অবস্থিত হওয়ায় ‘প্রয়াস’-এর নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ বাবা-মায়েদের মনে গভীর আস্থা তৈরি করে। তারা নিশ্চিন্ত থাকেন যে, তাদের সন্তান একটি সুরক্ষিত ও নিবেদিতপ্রাণ পরিবেশে শিখছে ও বড় হচ্ছে। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি সেই বাবা-মায়েদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সাপোর্ট সিস্টেম, যা তাদের পেশাগত জীবন বজায় রেখেও সন্তানের বিশেষ চাহিদা পূরণের সুযোগ করে দেয়।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘প্রয়াস’ উদ্যোগটি শুধুমাত্র একটি কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি দেশের বিশেষ শিক্ষাখাতের জন্য একটি গতিশীল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে যে, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব, যদি সঠিক দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। ‘প্রয়াস’ তার সুসমন্বিত থেরাপি, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিজস্ব প্রশিক্ষক তৈরির মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত ধারণা ‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা সমাজের জন্য বোঝা’-কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এরফলে এই শিশুরা তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনের স্পন্দন খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। এই মডেলটি দেশের অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে অনুপ্রাণিত করে দেখিয়েছে যে, একটি সম্পূর্ণ সমন্বিত, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব, যা কর্মজীবী বাবা-মায়েদেরও জীবনযাত্রা সহজ করে। সবমিলিয়ে ‘প্রয়াস’ কেবল শিশুদের সেবা করছে না, বরং এটি সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং মানবিক উন্নয়নের একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে, যা ভবিষ্যতে এই বিশেষ গোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে যুক্ত করার পথকে আরও প্রশস্ত করবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত