১৯৫২ থেকে ২০২৪
পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ অনেকগুলো গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী। এখানকার গণ আন্দোলনগুলোর ধরন এমন, নানা অনিয়ম আর পীড়নের বিরুদ্ধে জেগে উঠে শেষমেস জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই সফল হয়েছে প্রতিটি আন্দোলন ও অভ্যুত্থান। এসব গণ-অভ্যুত্থানের নিবিড় পর্যবেক্ষক ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। বাংলাদেশের প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের আগেই এটি যে বিশালাকারের রূপ নেবে, কীভাবে যেন তিনি তা বুঝতে পারতেন। গণ-অভ্যুত্থানগুলো নিয়ে কেমন ছিল সদ্যপ্রয়াত এ রাজনীতিবিদের পর্যবেক্ষণ?
তাহমীদ চৌধুরী
বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই একটার পর একটা গণসংগ্রামের উত্তাল আখ্যান। এই আখ্যানের বহুল প্রচলিত, রাষ্ট্রস্বীকৃত পাঠ আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এর সমান্তরালে বরাবরই নির্মোহ বিকল্প পাঠ হাজির করেছেন যে গুটিকতক মানুষ, সদ্যপ্রয়াত লেখক ও বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমর তাঁদেরই একজন। তিনি ছিলেন এদেশের গণ-আন্দোলনগুলোর এক নিবিড় পর্যবেক্ষক। এক্ষেত্রে তাঁকে আপসহীনও বলা চলে। জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাস বা রাজনৈতিক আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে একটিমাত্র মানদণ্ড দিয়ে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁককে তিনি পরিমাপ করতে চেয়েছেন—সেটি হলো শ্রেণি-প্রশ্ন।
বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তাঁর 'পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' গ্রন্থে। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এ গবেষণাগ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন কেবল ঢাকার ছাত্র-মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ছিল না, বরং এর শিকড় ছিল গ্রামীণ কৃষকের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে। তাঁর মতে, এটি ছিল পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সফল গণপ্রতিরোধ। কিন্তু এখানেই তিনি নিজের বিশ্লেষণের মূল সূত্রটি ধরিয়ে দেন। তিনি দেখান, এই আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত গণশক্তিকে ধীরে ধীরে সংগঠিত করে এর নেতৃত্বে চলে আসে উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যার রাজনৈতিক প্রতিনিধি ছিল আওয়ামী লীগ। এই শ্রেণিটি জনগণের শক্তিকে নিজেদের রাজনৈতিক দর-কষাকষির হাতিয়ারে পরিণত করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানী শাসক কাঠামোর অংশীদার হওয়ার পথে অগ্রসর হয়।
এই একই দ্বন্দ্বের বিস্তার তিনি লক্ষ্য করেছেন ষাটের দশকের প্রতিটি আন্দোলনে। ষাটের দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী তাঁর বইগুলো, যেমন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭) এবং ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯), সেই সময়ের ভাবাদর্শগত সংগ্রামকে বুঝতে সাহায্য করে। ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামকে বদরুদ্দীন উমর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন ছিল নেতৃত্বের শ্রেণি-চরিত্র নিয়ে। ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ হিসেবে। কিন্তু যে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রজনতা এই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি ছিল, তাদের মুক্তির সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেতৃত্বের এজেন্ডায় ছিল না। তাই আন্দোলনটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার পালাবদল—এক শাসককে হটিয়ে আরেক দেশীয় শাসক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা, যা শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অক্ষম।
উমরের এই নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ভারতের ‘দেশ’ পত্রিকার অনুরোধে তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তথ্য দিয়ে তিনি দেখান, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালের অক্টোবর থেকে কারাগারে থাকায় এবং ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়ায় ভাষা আন্দোলনে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুবলীগ এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যদিও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগও এতে অংশ নিয়েছিল। এই লেখা প্রকাশের পর শেখ হাসিনার সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং 'দেশ' পত্রিকা চাপের মুখে দুঃখপ্রকাশ করে এবং লেখাটি প্রত্যাহার করে নেয়। শুধু তাই নয়, পুরো সংখ্যাটি তারা পুনর্মুদ্রণ করে উমরের প্রবন্ধের জায়গায় অন্য লেখকের লেখা ছাপায়। বহু ঘটনার ভেতর এই ঘটনা একটি উদাহরণমাত্র যে কীভাবে সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ রাজনৈতিক আনুগত্যের কাছে পরাস্ত হতে পারে এবং গণমাধ্যমের বাণিজ্যিক স্বার্থ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কীভাবে সংকুচিত করতে পারে।
জনযুদ্ধ থেকে রাষ্ট্রগঠন: একাত্তরের ভিন্ন পাঠ
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণ তাঁকে মূলধারার বয়ান থেকে সবচেয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। 'যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ' এবং 'মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যুদ্ধের জয় পরাজয়'-এর মতো বইগুলোতে তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি প্রকৃত একটি 'জনযুদ্ধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-জনতা নিজেদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি বিপ্লবী জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা চেয়েছিল একটি নিয়ন্ত্রিত জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করে তার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের যে বিপুল বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল, তা একটি নতুন রাষ্ট্র ও নতুন শাসক শ্রেণি গঠনের প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু যে সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছিল, ক্ষমতার কাঠামোতে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
স্বাধীনতার পর এই প্রক্রিয়ারই যৌক্তিক পরিণতি ঘটে। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালকে উমর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম 'ফ্যাসিস্ট' পর্ব এবং এক নতুন 'লুটেরা শ্রেণি'র জন্মকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা তাঁর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত 'যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ' বইয়ে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। তাঁর মতে, সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে একটি নব্য-ধনীক শ্রেণির উদ্ভব হয়। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পট পরিবর্তনকে তিনি কোনো আদর্শিক সংঘাত হিসেবে দেখেননি, বরং দেখেছেন এই নবগঠিত লুটেরা শ্রেণির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার সংঘাত হিসেবে। আমাদের দেশের পরবর্তীকালের রাজনীতিও কম-বেশি সেই উত্তরাধিকার বহন করেছে।
'নাগরিক অভ্যুত্থান' ও অন্তিম পর্যবেক্ষণ
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে 'গণঅভ্যুত্থান' বলতে নারাজ ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। এই বিষয়ে তাঁর ভাবনাগুলো 'নব্বই এর নাগরিক বুর্জোয়া অভ্যুত্থান ও অন্যান্য প্রবন্ধ' গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। একে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে 'নাগরিক অভ্যুত্থান' বলে আখ্যায়িত করেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, এই আন্দোলন মূলত ঢাকা ও অন্যান্য শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, গ্রামীণ বিশাল জনগোষ্ঠী এখানে ছিল নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতো। ফলে এরশাদের পতনের পর ক্ষমতার যে পালাবদল হয়, তা ছিল ক্ষমতার হাতবদল মাত্র। এতে শাসকের মুখ বদলায়, কিন্তু শাসনব্যবস্থার শোষক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয় না।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালকে বদরুদ্দীন উমর ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ারই পূর্ণাঙ্গ ও ভয়ংকর রূপ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই অভ্যুত্থানকে তিনি ‘নজিরবিহীন গণবিস্ফোরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি অভ্যুত্থান-পরবতৃতী সময়ে নানা ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে আশাহত করেছে। চব্বিশের অভ্যুত্থানকে তিনি বাংলাদেশের সব গণ-আন্দোলনগুলের মধ্য সবচেয়ে ব্যপক বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে উমর দেখেছিলেন, বাংলাদেশের অন্য গণ-আন্দোলনগুলোর মতো এ অভ্যুত্থানে শ্রমজীবি মানুষেরা বেশি প্রাণ দিলেও এখানে শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির দাবি ততটা ছিল না। ফলে এ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, একটা আদর্শিক শূন্যতার সুযোগে দেশে দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আশঙ্কার কথাগুলো তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশ্যেই বলে গিয়েছিলেন।
গণ-অভ্যুত্থানের নিবিড় পর্যবেক্ষক ও ভাষ্যকার বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণ প্রায়ই আমাদের অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সত্য যে কঠিন! তাই হয়তো খানিকটা অস্বস্তিও লাগে আমাদের। কিন্তু এটি তো ঠিক, নিজের জীবনের সবটা জুড়ে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক সমালোচনামূলক পাঠ নির্মাণ করেছেন। তাঁর সমগ্র কাজ আমাদের একটিই মৌলিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়—এত রক্ত আর ত্যাগের পরেও কেন বারবার জনগণের প্রকৃত মুক্তি অধরা থেকে যায়?
এই প্রশ্নের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমরের চিন্তার সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিহিত।
বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই একটার পর একটা গণসংগ্রামের উত্তাল আখ্যান। এই আখ্যানের বহুল প্রচলিত, রাষ্ট্রস্বীকৃত পাঠ আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এর সমান্তরালে বরাবরই নির্মোহ বিকল্প পাঠ হাজির করেছেন যে গুটিকতক মানুষ, সদ্যপ্রয়াত লেখক ও বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমর তাঁদেরই একজন। তিনি ছিলেন এদেশের গণ-আন্দোলনগুলোর এক নিবিড় পর্যবেক্ষক। এক্ষেত্রে তাঁকে আপসহীনও বলা চলে। জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাস বা রাজনৈতিক আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে একটিমাত্র মানদণ্ড দিয়ে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁককে তিনি পরিমাপ করতে চেয়েছেন—সেটি হলো শ্রেণি-প্রশ্ন।
বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে তাঁর 'পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' গ্রন্থে। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এ গবেষণাগ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ভাষা আন্দোলন কেবল ঢাকার ছাত্র-মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ছিল না, বরং এর শিকড় ছিল গ্রামীণ কৃষকের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে। তাঁর মতে, এটি ছিল পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সফল গণপ্রতিরোধ। কিন্তু এখানেই তিনি নিজের বিশ্লেষণের মূল সূত্রটি ধরিয়ে দেন। তিনি দেখান, এই আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত গণশক্তিকে ধীরে ধীরে সংগঠিত করে এর নেতৃত্বে চলে আসে উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যার রাজনৈতিক প্রতিনিধি ছিল আওয়ামী লীগ। এই শ্রেণিটি জনগণের শক্তিকে নিজেদের রাজনৈতিক দর-কষাকষির হাতিয়ারে পরিণত করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানী শাসক কাঠামোর অংশীদার হওয়ার পথে অগ্রসর হয়।
এই একই দ্বন্দ্বের বিস্তার তিনি লক্ষ্য করেছেন ষাটের দশকের প্রতিটি আন্দোলনে। ষাটের দশকের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী তাঁর বইগুলো, যেমন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭) এবং ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯), সেই সময়ের ভাবাদর্শগত সংগ্রামকে বুঝতে সাহায্য করে। ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামকে বদরুদ্দীন উমর জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন ছিল নেতৃত্বের শ্রেণি-চরিত্র নিয়ে। ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের এক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ হিসেবে। কিন্তু যে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রজনতা এই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি ছিল, তাদের মুক্তির সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেতৃত্বের এজেন্ডায় ছিল না। তাই আন্দোলনটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার পালাবদল—এক শাসককে হটিয়ে আরেক দেশীয় শাসক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা, যা শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে অক্ষম।
উমরের এই নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রায়ই প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ভারতের ‘দেশ’ পত্রিকার অনুরোধে তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তথ্য দিয়ে তিনি দেখান, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৯ সালের অক্টোবর থেকে কারাগারে থাকায় এবং ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়ায় ভাষা আন্দোলনে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুবলীগ এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যদিও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগও এতে অংশ নিয়েছিল। এই লেখা প্রকাশের পর শেখ হাসিনার সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং 'দেশ' পত্রিকা চাপের মুখে দুঃখপ্রকাশ করে এবং লেখাটি প্রত্যাহার করে নেয়। শুধু তাই নয়, পুরো সংখ্যাটি তারা পুনর্মুদ্রণ করে উমরের প্রবন্ধের জায়গায় অন্য লেখকের লেখা ছাপায়। বহু ঘটনার ভেতর এই ঘটনা একটি উদাহরণমাত্র যে কীভাবে সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ রাজনৈতিক আনুগত্যের কাছে পরাস্ত হতে পারে এবং গণমাধ্যমের বাণিজ্যিক স্বার্থ মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কীভাবে সংকুচিত করতে পারে।
জনযুদ্ধ থেকে রাষ্ট্রগঠন: একাত্তরের ভিন্ন পাঠ
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণ তাঁকে মূলধারার বয়ান থেকে সবচেয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। 'যুদ্ধপূর্ব বাঙলাদেশ' এবং 'মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যুদ্ধের জয় পরাজয়'-এর মতো বইগুলোতে তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি প্রকৃত একটি 'জনযুদ্ধ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-জনতা নিজেদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি বিপ্লবী জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তারা চেয়েছিল একটি নিয়ন্ত্রিত জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করে তার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের যে বিপুল বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল, তা একটি নতুন রাষ্ট্র ও নতুন শাসক শ্রেণি গঠনের প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু যে সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছিল, ক্ষমতার কাঠামোতে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না।
স্বাধীনতার পর এই প্রক্রিয়ারই যৌক্তিক পরিণতি ঘটে। ১৯৭২ থেকে '৭৫ সালকে উমর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম 'ফ্যাসিস্ট' পর্ব এবং এক নতুন 'লুটেরা শ্রেণি'র জন্মকাল হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা তাঁর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত 'যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ' বইয়ে স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। তাঁর মতে, সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে একটি নব্য-ধনীক শ্রেণির উদ্ভব হয়। ১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পট পরিবর্তনকে তিনি কোনো আদর্শিক সংঘাত হিসেবে দেখেননি, বরং দেখেছেন এই নবগঠিত লুটেরা শ্রেণির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারার সংঘাত হিসেবে। আমাদের দেশের পরবর্তীকালের রাজনীতিও কম-বেশি সেই উত্তরাধিকার বহন করেছে।
'নাগরিক অভ্যুত্থান' ও অন্তিম পর্যবেক্ষণ
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে 'গণঅভ্যুত্থান' বলতে নারাজ ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। এই বিষয়ে তাঁর ভাবনাগুলো 'নব্বই এর নাগরিক বুর্জোয়া অভ্যুত্থান ও অন্যান্য প্রবন্ধ' গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। একে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে 'নাগরিক অভ্যুত্থান' বলে আখ্যায়িত করেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, এই আন্দোলন মূলত ঢাকা ও অন্যান্য শহরের মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, গ্রামীণ বিশাল জনগোষ্ঠী এখানে ছিল নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতো। ফলে এরশাদের পতনের পর ক্ষমতার যে পালাবদল হয়, তা ছিল ক্ষমতার হাতবদল মাত্র। এতে শাসকের মুখ বদলায়, কিন্তু শাসনব্যবস্থার শোষক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয় না।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালকে বদরুদ্দীন উমর ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ারই পূর্ণাঙ্গ ও ভয়ংকর রূপ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই অভ্যুত্থানকে তিনি ‘নজিরবিহীন গণবিস্ফোরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি অভ্যুত্থান-পরবতৃতী সময়ে নানা ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে আশাহত করেছে। চব্বিশের অভ্যুত্থানকে তিনি বাংলাদেশের সব গণ-আন্দোলনগুলের মধ্য সবচেয়ে ব্যপক বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে উমর দেখেছিলেন, বাংলাদেশের অন্য গণ-আন্দোলনগুলোর মতো এ অভ্যুত্থানে শ্রমজীবি মানুষেরা বেশি প্রাণ দিলেও এখানে শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির দাবি ততটা ছিল না। ফলে এ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, একটা আদর্শিক শূন্যতার সুযোগে দেশে দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আশঙ্কার কথাগুলো তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রকাশ্যেই বলে গিয়েছিলেন।
গণ-অভ্যুত্থানের নিবিড় পর্যবেক্ষক ও ভাষ্যকার বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণ প্রায়ই আমাদের অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সত্য যে কঠিন! তাই হয়তো খানিকটা অস্বস্তিও লাগে আমাদের। কিন্তু এটি তো ঠিক, নিজের জীবনের সবটা জুড়ে নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক সমালোচনামূলক পাঠ নির্মাণ করেছেন। তাঁর সমগ্র কাজ আমাদের একটিই মৌলিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়—এত রক্ত আর ত্যাগের পরেও কেন বারবার জনগণের প্রকৃত মুক্তি অধরা থেকে যায়?
এই প্রশ্নের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীন বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমরের চিন্তার সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিহিত।
লোকটা ছিল একেবারে ওজি মিনিমালিস্ট ইনফ্লুয়েন্সার। বাড়ি-ঘর নাই, ধনসম্পদ নাই, গ্ল্যামার নাই। সে মানি হাইস্ট-এর বার্লিনের মতো ক্ষমতালোভী নয়, বরং এমন এক অ্যান্টি-হিরো, যে সবার নজর কাড়ে কিন্তু কারো ধনরত্ন কাড়ে না। আপোষহীন, প্রথাভাঙা এই দার্শনিককে নিয়েই এই লেখা।
১ দিন আগেতাঁর মৃত্যুর বছর তাঁকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এক বিবৃতিতে জানান, তিনি সরকারি ও বেসরকারি কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেননি এবং এই পুরস্কার গ্রহণ করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
১ দিন আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কোনো বিশেষ কারণ ছিল না আমার। মাঝেমধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই আমি নানান জায়গায় যাই। শাহবাগের মোড় থেকে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির দিকে চলে গেলাম। বিকেলটা সুন্দর। আকাশে মেঘ আছে, আবার মেঘের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত নরম আলো এসে পড়েছে। মনে হচ্ছিলো চা খেতে ভালো লাগবে।
২ দিন আগেশুধু একক অ্যালবামই নয়, সিনেমার গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন মো. ইব্রাহীম। জানা যায়, সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার শ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। বলা ভালো, অ্যালবামের বেশির ভাগ গানই শিল্পীর নিজের লেখা ও সুর করা। তবে অন্যদের লেখা ও সুরেও কিছু গান গেয়েছেন তিনি।
২ দিন আগে