leadT1ad

আফিমের দোকান

পুরান ঢাকায় চন্ডুর নেশার অজানা কাহিনি

ঢাকায় একসময় আফিম থেকে তৈরি নেশাদ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ফেসবুকে পুরান ঢাকার একটি আফিমের দোকানের ছবি মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা, 'আফিমের দোকান'। চার শ বছরের ঐহিত্যবাহী শহর ঢাকায় প্রথম কাদের হাত ধরে এসেছিল আফিম নামের নেশাদ্রব্য? কোন স্বার্থে কারা এর বিস্তার ঘটালেন?

ঢাকায় আফিম উৎপাদনের অনালোচিত ইতিহাস।

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ৩১
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ২৩
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘চরশ মেশা চণ্ডুর নেশা মুণ্ডু ঝিমঝিম’ গানে বলেছিলেন, ‘মদের নেশা, গাঁজার নেশা এর কাছে একদম পাঁজা’। ১৯৪০ সালে প্রথম রের্কড হয়েছিল গানটি। নজরুলের গান কিংবা পুরোনো দিনের ঢাকাবিষয়ক বিভিন্ন লেখাপত্র বলছে, আমাদের এ অঞ্চলে সে সময় চন্ডুর নেশার প্রভাব ছিল প্রবল।

ঢাকায়, বিশেষ করে পুরান ঢাকায় আফিমের নেশাদ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন ছিল। পপি গাছের কাঁচা ফলের রস থেকে তৈরি হওয়া আফিম থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় যে নেশাদ্রব্য প্রস্তুত করা হতো তার নাম চন্ডু। সেকালে তাই ঢাকায় আফিম খাওয়াকে বলা হতো ‘চন্ডু সেবন’।

কারা এই চন্ডুওয়ালা

খাঁটি আফিমের গন্ধ খুব তীব্র ও ঝাঁঝালো। তাই সরাসরি খাওয়া যেত না। ফলে একে খাওয়ার উপযোগী করতে অনুসরণ করা হতো এক বিশেষ প্রক্রিয়া। আর এ কাজ করতেন চন্ডুওয়ালারা। মূলত তাঁরাই আফিম দোকানের কর্মচারী।

ঢাকায় নবাবপুরের আফিমের দোকান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
ঢাকায় নবাবপুরের আফিমের দোকান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘কিংবদন্তির ঢাকা’সহ বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ঢাকায় প্রথম আফিম আসে ১৮৩০ সালের দিকে। এই ভয়ানক নেশার প্রচলন হয় রোকনপুরের সোনাউল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। আফিমের দোকান খোলার জন্য তিনি এক চীনা নাগরিককে কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন এ নেশা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ঢাকার ভোগবিলাসী মুসলমানদের মধ্যে এর প্রচলন ছিল বেশি।

পুরান ঢাকার নবাবপুর, সূত্রাপুর, সদরঘাট, রথখোলা, টিকাটুলী, আরমানিটোলার মতো এলাকায় এ দ্রব্য সহজেই মিলত।

নবাবপুরের সেই আফিমের দোকান

ঢাকার একটি আফিমের দোকানের ছবি মাঝেমধ্যেই আমরা ফেসবুকে দেখতে পাই। যার সাইনবোর্ডে লেখা, ‘আফিমের দোকান, ২৬২ নং, নবাবপুর রোড, ঢাকা।’

পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডের এ আফিমের দোকানটির আশেপাশে ছিল বেশ কয়েকটি গন্ধবণিকের দোকান। সঙ্গে ছিল তাল বা খেজুরের রস দিয়ে বানানো একপ্রকার রসের দোকান; আর মিষ্টির দোকানও ছিল। আফিমের দোকান লাগোয়া ছিল ‘মেসার্স শাহ বণিকের দোকান’ আর রাস্তার উল্টোদিকের ‘আদি মরণচাঁদ ঘোষ অ্যান্ড সন্স’।

দুই শ বছরের পুরোনো শাহ বণিকের দোকানে তিন হাজারের ওপর কবিরাজি, হেকিমি ও বনজ ওষুধ আর উপাদান পাওয়া যায়। আর দেড় শ বছরের পুরোনো মিষ্টির দোকান আদি মরণচাঁদ অ্যান্ড সন্স এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

১৮৬০-এর দশকে পূর্ব বাংলার আফিমসেবীদের একটি ছবি। ছবি: উইকিমিডিয়া
১৮৬০-এর দশকে পূর্ব বাংলার আফিমসেবীদের একটি ছবি। ছবি: উইকিমিডিয়া

নবাবপুরের রথখোলার এই আফিমের দোকানটা ছিল বেশ ছোট। ভেতরটা আলো-আঁধারি। আর সামনের কাউন্টারে পিতলের শিক দেওয়া ছিল। কাউন্টারের ওপরের অংশে টানানো থাকত সাইনবোর্ড। সেখানে ইংরেজি-বাংলা দুই ভাষায় লেখা ছিল: ‘আফিমের দোকান’।

আফিম দোকানগুলোর নিয়মিত দৃশ্য

ঢাকার আফিমের দোকানগুলোতে কখনো ক্রেতার অভাব হয়নি। সবসময়ই দু-একজনকে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। অনেক সময় এমনও হতো যে আফিমখোরদের লাইন গিয়ে ঠেকেছে রাস্তায়।

তবে সবাই কিন্তু আফিম কিনতে পারত না। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যাঁদের অনুমতি (পারমিট) দিতেন, শুধু তাঁরাই ছিলেন ক্রেতা। তা-ও আবার নির্দিষ্ট দিনে। আর ক্রেতাদের এটি দেওয়াও হতো নির্দিষ্ট পরিমাণে।

কিন্তু যাঁরা ছিলেন পরিচিত মুখ, তাদের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম অনেক সময় মানা হতো না। আফিম বিকিকিনির এমন মজার বর্ণনা আছে মীজানুর রহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’ বইয়ে।

মীজানুর রহমান বলছেন, তখন আফিম ক্রেতাদের মধ্যে সব ধর্মের মানুষকেই দেখা যেত। ধুতি-ফতুয়া পরা হিন্দু বনেদি বাবুদেরকেও দেখা যেত মাঝেমধ্যে। তবে অনেক সময় তাঁরা নিজেরা কিনতে না এসে অন্য কাউকে পাঠাতেন।

নিয়মিত আফিম ক্রেতাদের অধিকাংশের স্বাস্থ্যই ছিল রুগ্ন। আর আফিমের দোকানে বিক্রি হতো গাঁজাও। তবে খুব দরকার না পড়লে ভদ্রলোকেরা এ দোকানের আশেপাশে ঘেঁষতেন না। ‘ঢাকা পুরাণ’ বইয়ে মীজানুর রহমান সে সময়ের যে বর্ণনা তুলে ধরেন, সেখানে আছে, দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগত।

আদতে তখন ঢাকার আফিমখোরদের নিয়ে অনেক মজার গল্প চালু ছিল বাজারে।

আফিম যেভাবে ঢাকায়

ইমরান উজ-জামানের ‘ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন’ বইয়ের সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে ভারতবর্ষে প্রথম শুরু করেছিল আফিম চাষ ও ব্যবসা। এই নেশাজাতীয় পণ্যের চাষাবাদ নির্বিঘ্ন রাখতে কোম্পানি কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করত এবং ‘আফিম এজেন্ট’ নিয়োগ দিত। সে সময় ঢাকায় উৎপাদিত আফিম চীনসহ বিশ্বের নানা দেশে রপ্তানিও হতো।

মেসার্স শাহ বণিকের দোকানের পাশের দোকানটাই ছিল নবাবপুরের সেই আফিমের দোকান। বর্তমান সময়ে তোলা ছবি। ছবি: গুগল ম্যাপ
মেসার্স শাহ বণিকের দোকানের পাশের দোকানটাই ছিল নবাবপুরের সেই আফিমের দোকান। বর্তমান সময়ে তোলা ছবি। ছবি: গুগল ম্যাপ

পরে চীনে ব্যাপক হারে আফিমের অপব্যবহার শুরু হলে ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে দুটি যুদ্ধও হয়।

প্রথম আফিম যুদ্ধ চলে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত। আর দ্বিতীয়টি ঘটে ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে। দুই যুদ্ধেই পরাজিত হয় চীন। ফলে ব্রিটিশদের আফিম ব্যবসা আরও প্রসারিত হয়। ঢাকা শহরে বেড়ে যায় আফিমের ব্যবহার।

জেমস ওয়াইজের লেখা থেকে

ঢাকায় আফিমের বিস্তারের একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় এ শহরের সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজের লেখায়। ১৮৬০ সালের দিকে তিনি ঢাকা শহরে বসবাস করতেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ১৮৩০ সালে ঢাকায় আফিমের ব্যবহার শুরু হয়। এর পরের ২০ বছরে শহরে আফিমের দোকান বেড়ে দাঁড়ায় ২০টিতে। এ সময়ের সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, শহরে আফিম বেশি সেবন করতেন মুসলমানেরা। আর গ্রামে গাঁজার ব্যবহার বেশি ছিল।

বেশির ভাগ আফিম দোকানের মালিক হিন্দু ব্যবসায়ীরা হলেও মজার ব্যাপার হলো, লোকলজ্জার ভয়ে সামনে আসতেন না তাঁরা। দোকান চালাতেন ‘চন্ডুওয়ালা’ নামে পরিচিত মুসলমান কর্মচারীরা।

আফিম কি শুধুই নেশা ছিল

পান, হুঁকা, গাঁজা আর আফিমকে তখন খুব সাধারণ নেশা হিসেবে গণ্য করা হতো। একপর্যায়ে এটি আর নেশা থাকল না, হয়ে উঠল একধরনের সামাজিক অভ্যাসের অংশ।

শোনা যায়, সে সময় অনেক নবজাতকের মুখে আফিম দিয়ে তাকে ‘পৃথিবীতে স্বাগত’ জানানো হতো। আবার শিশুর ঠান্ডা সারাতেও ব্যবহৃত হতো আফিম।

তখন প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বয়স্কদের আফিম খেয়ে ঝিম ধরা পুরোনো ঢাকার কিছু গলির দৃশ্য ছিল অনেকেরই পরিচিত। কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন, আফিম খেলে শক্তি বাড়ে। তাই খাবার পর তাঁরা দুধে মিশিয়ে আফিম খেতেন।

ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল ব্যবহার

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার আফিম ব্যবসা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ১৮৭৮ সালে ‘আফিম অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে গঠন করা হয় ‘আফিম বিভাগ’। একই সময়ে গাঁজা ও মদের ওপরও কর বসিয়ে রাজস্ব আদায় শুরু হয়। এই আইনের পর বন্ধ হয়ে যায় অনেক আফিমের দোকান। দোকানের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১১টিতে। এরপর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল আফিমের নেশা। সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে সরকার আফিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

Ad 300x250

রোববার শহীদ মিনারে এনসিপির সমাবেশ: ‌‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে দ্বিধা

৫ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপিত হবে: প্রেস সচিব

২০ শতাংশ কমানোর পর বাংলাদেশি পণ্যে মোট শুল্ক এখন কত হবে

গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে

মেদভেদেভের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প, রাশিয়ার কাছাকাছি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের নির্দেশ

সম্পর্কিত