leadT1ad

হাডসনের অলৌকিকতা

একজন পাইলট, এক নদী, আর ১৫৫ প্রাণের বেঁচে ফেরার গল্প

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৬: ৩৬
ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়া মানেই প্রাণহানি, হাহাকার ফলাফল হয় শোকাবহ। তবে এতসব হাহাকারের বাইরেও আছে এক ‘অলৌকিক’ গল্প। ২০০৯ সালের এক শীতের বিকেল। নিউইয়র্কের আকাশে হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে একটি যাত্রীবাহী বিমান—ইউএস এয়ারওয়েস ফ্লাইট ১৫৪৯। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে যা ঘটেছিল, তা আজও ইতিহাসে পরিচিত ‘হাডসনের অলৌকিকতা’ নামে। একজন পাইলট, এক নদী, আর ১৫৫ প্রাণের বেঁচে ফেরা।

হাডসনের অলৌকিকতা

২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। নিউইয়র্কের শীত জমে আছে হাডসন নদীর গায়ে। আকাশে উড়ছিল একটি বিমান—ইউএস এয়ারওয়েস ফ্লাইট ১৫৪৯ । গন্তব্য ছিল নর্থ ক্যারোলিনার শার্লট শহর। প্লেনের পাইলট চেসলি সালেনবার্গার, ডাকনাম সালি। সঙ্গে ছিলেন কো-পাইলট জেফরি স্কিলস। প্লেনের কল নেইম ছিলো ‘ক্যাকটাস ১৫৪৯’। কিন্তু সেই ফ্লাইটটি কখনো পৌঁছায়নি তার নির্ধারিত গন্তব্যে।

কারণ, কয়েক মিনিট পরেই ঘটে এমন এক ঘটনা, যা ইতিহাসে জায়গা করে নেবে ‘মিরাকল অন দ্য হাডসন’ নামে।

এই আশ্চর্য ঘটনা ঘটার আগে অন্যসব প্লেনের মতোই ইউএস এয়ারওয়েস ১৫৪৯ ছেড়েছিল নিউইয়র্কের লা গার্দিয়া বিমানবন্দর থেকে। বিমানটিতে ছিলেন ১৫১ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু । শীতের ধকল থেকে বাঁচতে গরম জায়গার খোঁজে আকাশে উড়ে যচ্ছিল একদল কানাডিয়ান হাঁস। সেই ঝাঁক ধাক্কা খায় বিমানটি আর তাদের কয়েকটি ঢুকে যায় ইঞ্জিনের ভেতর।

প্রচন্ড গতিতে উড়ে যাওয়া বিমানের সঙ্গে সামান্য খড়কুটোর ধাক্কাও ঘটাতে পারে বিশাল দুর্ঘটনা। এক ঝাঁকের হাসেঁর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যায় ফ্লাইট ১৫৪৯-এর। আকাশে, জনবহুল শহরের ওপর, জ্বলন্ত ইঞ্জিন নিয়ে উড়তে থাকা একটি যাত্রীবাহী বিমান। আকাশজুড়ে আগুনের ফুলকি! প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য।

ক্যাপ্টেন চেসলি ‘সালি’ সুলেনবার্গার ও সহ-পাইলট জেফ স্কাইলস বুঝতে পারছিলেন তিনিসহ বিমানের প্রত্যেকটি যাত্রীর প্রাণ বিপন্ন প্রায়। শুধু তাই নয়, নিচে আছে ঘনবসতিপুর্ণ শহর। যেখানে আছড়ে পড়লে আরও কতজনের প্রাণ যাবে কে জানে! কিন্তু প্রায় ৪০ বছর বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা সালির। এরমধ্যে বিপদে যে পড়েননি এমন নয়। কিন্তু এমন বিপদ এই প্রথম।

ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর বিমানের অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছিল। হাতে সময় মাত্র তিন মিনিট। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় নামানো হবে বিমানটি? হাতে বিকল্প খুব বেশি ছিল না। কাছেই ছিল টেটেরবোরো বিমানবন্দর, আবারও লা গার্ডিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু বিমানটির উচ্চতা এবং গতি বিবেচনায় ক্যাপ্টেন সালি বুঝে ফেলেছিলেন—এই জলন্ত ইঞ্জিন নিয়ে শহরের মধ্যে কোনও বিমানবন্দরে অবতরণ অসম্ভব।

দুটি ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বিমানটি প্রায় ১৯ সেকেন্ড আকাশে উড়েছিল। যাত্রীরা ছিলেন আতঙ্কিত। ইঞ্জিন দুটি যখন বন্ধ হয় তখন বিমানটি ছিল ৩০৬০ ফুট উচ্চতায় ৭৮ টন ওজনের একটা বিশাল বিমান দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে গ্রাভিটির নিয়মে।

সামনে জনবসতিপূর্ণ শহর আর সালির হাতে ১৫৪ জন মানুষের প্রাণ। দ্রুত কল করলেন কন্ট্রোল রুমে। জানালেন, ইঞ্জিন বিকল হয়েছে, তারা ফিরে যাবে লা গার্ডিয়াতে। যদিও ট্রাফিক কন্ট্রোলার লা গার্ডিয়ার রানওয়ে ১৩তে নামার কথা বলেন, সালি তাতে সম্মতি দেননি।

সালির চোখ তখন নদীর দিকে। নিউইয়র্ক ও নিউ জার্সির মধ্য দিয়ে বয়ে চলছে হাডসন নদী। নির্জন, প্রশস্ত আর আশপাশে কোনও গাছপালা বা দালানের ঝুঁকি নেই। মৃত্যুর হাত থেকে ১৫৫ জন যাত্রীকে বাঁচাতে তিনি বেছে নেন এই নদীকেই।

তবে ভাবা মাত্রই সালি ব্যবস্থা নিতে পারলেন না। সামনে হাজির নতুন বাঁধা, ৬০০ ফুট উঁচু জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ। সালির দেখালেন অভিজ্ঞতার চমৎকারিত্ব। পার হলেন প্রায় ৯০০ ফুটঁ ওপর দিয়ে।

ব্রেস ফর ইম্প্যাক্ট

বিমানে চড়া লোকদের জন্য সবচেয়ে আতঙ্কের সংকেত ব্রেস ফর ইম্প্যাক্ট। একে বলা যায় প্লেন ক্রাশ করার আগ মুহূর্তের প্রস্তুতি সংকেত। এই সংকেত পেলে যাত্রীরা একটি বিশেষ শারীরিক অবস্থান গ্রহণ করেন। এই শারীরিক অবস্থানের ফলে দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়ার শঙ্কা কিছুটা কমে।

এই সংকেতের পরপরই হাডসনের জলের দিকে ধেয়ে যায় বিমানটি। বিমান যখন হাডসনের জলে নামল, তখন ঘড়ির কাঁটা ৩টা ৩১ মিনিটে। পুরো ঘটনাটি ঘটেছিল মাত্র ৬ মিনিটে। নিউইয়র্কের আকাশে তখন বিমানের বিকল ইঞ্জিনের শব্দ। আতঙ্কিত যাত্রীদের চিৎকার। তারপর প্রচণ্ড শব্দ। বিশাল প্লেনটি আছড়ে পড়ছে হাডসনের জলে। সালি বুঝেশুনেই ফেরিঘাটের কাছাকাছি ল্যান্ড করছিলেন। ককপিটের দরজা খুলে সবাইকে বের করে দেন। বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে এক্সিট খুলে ঝাঁপ দিতে হয় নদীতে।

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফেরি, পুলিশ বোট, কাস্টমস বাহিনী, এমনকি ব্যক্তিগত বোট। শুরু হয় বিপুল উদ্ধার অভিযান। প্রত্যেক যাত্রীকে একে একে উদ্ধার করে তোলা হয় নিরাপদ নৌকায়। যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ হালকা আহত হলেও, কেউ মারা যাননি। এই ঘটনার পর নিউইয়র্কারদের মুখে মুখে শুধু একটাই শব্দ—অলৌকিকতা।

বিমান কর্তৃপক্ষ এনটিএসবি প্রথমে সন্দেহ করেছিল, সালি হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বিমানটি বিমানবন্দরে না নিয়ে পানিতে নামিয়ে ঝুঁকি নিয়েছিলেন।

তবে ব্ল্যাক বক্স (বিমানের তথ্য সংরক্ষণ করার ইলেকট্রনিক ডিভাইস) এবং যান্ত্রিক বিশ্লেষণে পরে প্রমাণিত হয়, তাঁর সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত। এর বিকল্পও ছিল না। তিনি সময়, গতি ও দূরত্বকে বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সেরা রাস্তাটি বেছে নিয়েছিলেন।

এই ঘটনার জন্য ক্যাপ্টেন সালিকে ব্রিটিশ গিল্ড অব এয়ার পাইলটস ও নেভিগেটরস কর্তৃক মাস্টার’স মেডাল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁকে নিয়ে ২০১৬ সালে হলিউডে নির্মিত হয় সিনেমা ‘সালি’। সিনেমায় সালির ভূমিকায় অভিনয় করেন টম হ্যাংকস।

Ad 300x250

মাইলস্টোন স্কুল ভবন ছিল কার্যত একটি মারাত্মক অনিরাপদ স্থাপনা

বিদেশ থেকে লোক ভাড়া করে এনে দেশ চালানো যায় না: মির্জা ফখরুল

পাখি আঁকত মাকিন, বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার ছোট্ট পাখিটা চলে গেল’

অস্ত্রের চেয়ে বড় হুমকি হলো ভুয়া তথ্য ও এআই: সিইসি

‘দিনে নাটক, রাতে আটক’, ব্লকরেইড আতঙ্কের মধ্যেই তিন সমন্বয়ককে তুলে নিল ডিবি

সম্পর্কিত