leadT1ad

কীভাবে ছড়ায় অ্যানথ্রাক্স, মৃত্যুঝুঁকি কতটুকু

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ৩২
দেশে বেড়েছে অ্যানথ্রাক্স। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে অ্যানথ্রাক্সের (তড়কা রোগ) প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষভাবে পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। মানবদেহে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ জনে। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে আক্রান্ত গরুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রথম এর খবর আসে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অসুস্থ গবাদি পশু জবাই ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি, সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছেন, যাতে সংক্রমণ আর না ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্স বাংলাদেশে প্রায় স্থায়ী সমস্যা হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ২০১০ সাল থেকে দুয়েক বছর পরপরই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। সাধারণত উৎসবকালীন পশু জবাই বা বন্যার সময় সংক্রমণ বেড়ে যায়।

অ্যানথ্রাক্স কীভাবে ছড়ায়?

অ্যানথ্রাক্স একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ। এটি প্রধানত গরু, ভেড়া ও ছাগলের মতো প্রাণীতে দেখা যায়। সেখান থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায়। তবে এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। ব্যাকটেরিয়াটি মাটিতে বহু বছর ধরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। চারণভূমির পশু তা খেয়ে সংক্রমিত হয়।

মানুষ তিনভাবে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হতে পারে—

১. ত্বকজনিত অ্যানথ্রাক্স (সবচেয়ে সাধারণ, বৈশ্বিকভাবে প্রায় ৯৫ শতাংশ): পশুর চামড়া, উল, মাংস বা হাড় ব্যবহারের সময় হাতে ক্ষত থাকলে জীবাণু ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশে এটাই প্রধান সংক্রমণের পথ। সাধারণত আক্রান্ত পশু জবাই বা প্রক্রিয়াজাত করার সময় এটি হয়।

২. শ্বাসতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স (প্রাকৃতিকভাবে খুব বিরল): পশুর উল বা চামড়া থেকে আসা জীবাণু শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢোকে। এটি সাধারণত শিল্পাঞ্চলে হয়, গ্রামে কম দেখা যায়।

৩. পাকস্থলীর অ্যানথ্রাক্স (কম দেখা যায়): অপর্যাপ্তভাবে রান্না করা মাংস বা দূষিত পানি খাওয়ার মাধ্যমে হয়।

বর্তমান রংপুর প্রাদুর্ভাবে আক্রান্তরা মূলত ত্বকজনিত অ্যানথ্রাক্সে ভুগছেন। এর সঙ্গে অসুস্থ গরুর মাংস ধরা বা খাওয়ার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। বর্ষা ও বন্যার সময় মাটির জীবাণু সক্রিয় হয়ে ওঠায় ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

মৃত্যুঝুঁকি কতটা?

অ্যানথ্রাক্সে মৃত্যুঝুঁকি নির্ভর করে সংক্রমণের ধরন, চিকিৎসা পাওয়ার সময় এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ওপর। দ্রুত চিকিৎসা পেলে সব ধরনের সংক্রমণই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে চিকিৎসা না হলে ঝুঁকি মারাত্মক।

ত্বকজনিত অ্যানথ্রাক্স: চিকিৎসা ছাড়া ১০–২০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক পেলে মৃত্যুঝুঁকি ১ শতাংশেরও কম।

শ্বাসতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স: চিকিৎসা ছাড়া প্রায় ১০০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি। তবে অ্যান্টিবায়োটিক ও বিশেষ যত্নে প্রায় ৪৫ শতাংশ রোগী বেঁচে যান।

পাকস্থলীর অ্যানথ্রাক্স: চিকিৎসা ছাড়া ২৫–৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেসব প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, সেগুলোতে মৃত্যু খুবই কম। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংক্রমণ হয়েছে ত্বকে, যা সহজে চিকিৎসা করা যায়। রংপুরের বর্তমান প্রাদুর্ভাবে এখন পর্যন্ত মানুষের মৃত্যুর খবর নেই। তবে দুটি পশুর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।

২০২৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যানথ্রাক্স এখনো বড় হুমকি। পশুর মৃত্যুর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির চেয়েও বেশি দেখা যায়।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের মূল উপায় হলো পশুর টিকা ও জনসচেতনতা। এটিকে তাঁরা ‘ওয়ান হেলথ’ সমস্যা হিসেবে দেখছেন, যেখানে প্রাণী, মানুষ ও পরিবেশ—তিনটির স্বাস্থ্যই জড়িত।

আইইডিসিআর: পীরগাছার ১২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৮ জনের অ্যানথ্রাক্স ধরা পড়েছে। তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন অসুস্থ পশুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে। বিশেষজ্ঞরা সতর্কবার্তা দিয়েছেন, ‘অ্যানথ্রাক্স বাংলাদেশে স্থায়ী সমস্যা। হঠাৎ ফুলে যাওয়া বা রক্তপাত দেখা দিলে সেই পশু জবাই বা খাওয়া যাবে না।’ এ ছাড়া দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন।

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণা (বিকন বায়ো, এনসিবিআই): তারা বলছে গ্রামীণ এলাকায় নজরদারি দুর্বল হওয়ায় অ্যানথ্রাক্স বাংলাদেশে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে আছে। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, হঠাৎ মারা যাওয়া ৫০০ পশুর মধ্যে ৩৬৮টির মৃত্যু অ্যানথ্রাক্সে। বর্তমানে গরুর টিকা দেওয়ার হার মাত্র ৪০ শতাংশ হওয়ায় ঝুঁকি বেশি।

ডব্লিউএইচও-সমর্থিত মতামত: প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে টিকা না দেওয়া পশু বিক্রি বন্ধ করতে হবে। মৃত পশুর খবর দ্রুত কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে যাতে সংক্রমণ না বাড়ে।

পরামর্শ

আপনি যদি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকেন, সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। মৃত পশুর খবর স্থানীয় ভেটেরিনারি কর্মকর্তাকে জানান। গবাদি পশুর টিকা নিশ্চিত করাই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত