leadT1ad

তামিল ‘সিনেমার লোক’ থেকে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রী

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রী সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাঁরা রাজ্য শাসন করেছেন। এছাড়া, গত কয়েক দশকে আরও অনেক তারকা রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন সুপারস্টার থালাপতি বিজয়। এই লেখায় উঠে এসেছে তামিল সিনেমার পর্দা থেকে পাঁচজনের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার গল্প।

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১১: ০০
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১১: ২৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

ভারতের তামিলনাড়ুর রাজনীতি আর সিনেমার সম্পর্ক বহু দিনের। এই রাজ্যের পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রী সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাঁরা রাজ্য শাসন করেছেন। এ ছাড়া, গত কয়েক দশকে আরও কিছু জনপ্রিয় তামিল অভিনেতা রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন সুপারস্টার থালাপতি বিজয়।

২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিজয় তাঁর রাজনৈতিক দল ‘তামিলাগা ভেটরি কাজাগাম (টিভিকে)’—এর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। গত বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) টিভিকের রাজ্য সম্মেলনে তিনি জানান, দলটি ২০২৬ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে একা লড়বে। একই সঙ্গে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দলকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যা দিয়েছেন।

এই ঘটনা থেকে আবার পরিষ্কার হয়ে যায়, তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে সিনেমা এবং জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রভাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আগের মতো আন্নাদুরাই, করুণানিধি, এমজিআর ও জয়ললিতার ক্ষেত্রেও এই প্রভাব খুব স্পষ্ট ছিল।

আন্নাদুরাই: তামিল জাতীয়তাবাদের জোরালো কণ্ঠস্বর

১৯৬৭ সালে আন্নাদুরাই ‘দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘম’ (ডিএমকে) দলের হয়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এর মধ্য দিয়ে রাজ্যে দীর্ঘদিনের কংগ্রেস শাসনের অবসান ঘটে। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল মোড় ঘোরানো ঘটনা।

আন্নাদুরাই: তামিল জাতীয়তাবাদের জোরালো কণ্ঠস্বর। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি
আন্নাদুরাই: তামিল জাতীয়তাবাদের জোরালো কণ্ঠস্বর। ফেসবুক থেকে নেওয়া ছবি

ডিএমকের মূল লক্ষ্য ছিল জাতপাত ও ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। এই ভাবধারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আন্নাদুরাই সিনেমাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি নিজে ‘নাল্লাথাম্বি’ (১৯৪৮) ও ‘ভেল্লাইকারি’ (১৯৪৯) ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। এসব ছবিতে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের প্রায়ই খলনায়ক বা বোকা চরিত্রে দেখানো হতো। আর সাধারণ মানুষের চরিত্রগুলোকে সাহসী ও বুদ্ধিমান হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।

শুধু সিনেমায় নয়, আন্নাদুরাই মঞ্চনাটকেও ব্যবহার করেছিলেন রাজনৈতিক প্রচারের জন্য। আন্নাদুরাই ছিলেন তামিল জাতীয়তাবাদের জোরালো কণ্ঠস্বর। এই অবস্থান তাঁকে তামিল জনতার কাছে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।

করুণানিধি: চিত্রনাট্য থেকে ক্ষমতার চূড়ায়

আন্নাদুরাইয়ের পর ডিএমকের নেতৃত্বে আসেন এম করুণানিধি। তিনি শুধু রাজনীতিবিদই নন, ছিলেন গল্পকার, চিত্রনাট্যকার ও নাট্যকার। তামিল চলচ্চিত্রে যে রাজনৈতিক ভাষা তৈরি হয়েছিল, তার বড় অংশই এসেছে করুণানিধির কলম থেকে।

করুণানিধি: চিত্রনাট্য থেকে ক্ষমতার চূড়ায়। সংগৃহীত ছবি
করুণানিধি: চিত্রনাট্য থেকে ক্ষমতার চূড়ায়। সংগৃহীত ছবি

করুণানিধি ১৯৬৯ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচ বার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সিনেমা ও নাটকের মাধ্যমে দলীয় নীতি প্রচারে সক্রিয় ছিলেন।

১৯৫২ সালে মুক্তি পাওয়া বিখ্যাত তামিল সিনেমা ‘পরাশক্তি’—এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন করুণানিধি। এই সিনেমাতেই জনপ্রিয় অভিনেতা শিবাজি গণেশনের অভিষেক ঘটে। ছবির কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত পুরোহিত, ধর্মীয় ভন্ডামি, কুসংস্কার ও সমাজের অন্যায়-অত্যাচারের সমালোচনা। ছবিতে একটি সংলাপ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। রক্ষণশীল মহল ছবিটিকে ধর্মানুভূতিতে আঘাত হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

করুণানিধি জীবনে ৫০টিরও বেশি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। এগুলোর অনেকগুলোই সরাসরি ডিএমকের নীতি ও আদর্শ প্রচার করত। আন্নাদুরাই যেভাবে সিনেমা ও নাটকের মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়েছিলেন, করুণানিধি সেই পথকে আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর করে তুলেছিলেন। হিন্দিকে বাধ্যতামূলক ভাষা করার সরকারি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র অবস্থান নেন।

সিনেমার পর্দায় রামচন্দ্রন (এমজিআর)। সংগৃহীত ছবি
সিনেমার পর্দায় রামচন্দ্রন (এমজিআর)। সংগৃহীত ছবি

এমজি রামচন্দ্রন (এমজিআর): পর্দার নায়ক থেকে জনতার প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী

এমজি রামচন্দ্রন (এমজিআর) ছিলেন তামিল চলচ্চিত্রের সুপরিচিত ও জনপ্রিয় অভিনেতা। রাজনীতি জীবনের শুরু হয়েছিল ডিএমকের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে, তবে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে তার বিশাল জনপ্রিয়তা। ভক্তরা তাঁকে শুধু অভিনেতা নয়, জীবনের নায়ক হিসেবেও দেখতো। এমজিআর এই ভালোবাসার প্রতিদানও দিতেন। তিনি নিয়মিত এতিমখানায় অনুদান দিতেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ করতেন এবং দরিদ্রদের চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন।

১৯৭২ সালে করুণানিধির সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে এমজিআর ডিএমকে থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি নিজের নতুন দল গড়ে তোলেন। নাম দেন ‘অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘম (এআইএডিএমকে)’। রাজনীতির বার্তা ছড়াতে তিনি সিনেমার শক্তি ব্যবহার করতেন। ‘নেত্রু ইন্দ্রু নালাই’ (১৯৭৪) এবং ‘ইধায়াক্কানি’ (১৯৭৫) সিনেমাতে তিনি নিজের নতুন দলের দর্শন প্রচার করেন।

১৯৭৭ সালের নির্বাচনে এমজিআর বিপুল জয়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন। পরপর তিনবার তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় বসেন। ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

ভি এন জানকি রামচন্দ্রন: স্বামীর ছায়া থেকে ক্ষমতায়

১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর এমজি রামচন্দ্রন (এমজিআর) মারা গেলে তামিল রাজনীতিতে বড় সংকট তৈরি হয়। তাঁর মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছিল, দলের নেতৃত্ব কে নেবেন। তখন এআইএডিএমকের ভেতরে বিভাজন দেখা দেয়। একদিকে ছিলেন এমজিআরের স্ত্রী ভি এন জানকি রামচন্দ্রন, আর অন্যদিকে এমজিআরের রাজনৈতিক উত্তরসূরী হয়ে ওঠা জনপ্রিয় অভিনেত্রী জে জয়ললিতা। দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব অনেকটা ব্যক্তিগত লড়াইয়ের মতো, স্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শিষ্য।

সিনেমার পর্দায় জানকি রামচন্দ্রন। সংগৃহীত ছবি
সিনেমার পর্দায় জানকি রামচন্দ্রন। সংগৃহীত ছবি

জানকি রামচন্দ্রন চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও এমজিআরের মতো বড় তারকার খ্যাতি পাননি। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তেমন ছিল না। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর সহানুভূতি এবং দলের একাংশের সমর্থনের কারণে তিনি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন।

১৯৮৮ সালের ৭ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর সরকার রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা এবং দলের ভেতরের দ্বন্দ্বের কারণে মাত্র ২৩ দিন টিকে ছিল।

জয়ললিতা : রুপালি পর্দা থেকে রাজনৈতিক আইকন

জয়ললিতা তামিল সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তিনি খুবই কম বয়সে অভিনয় শুরু করেন। অল্প সময়েই হয়ে ওঠেন তামিল সিনেমার শীর্ষ নায়িকা। এমজি রামচন্দ্রনের (এমজিআর) সঙ্গে তাঁর জুটি ছিল তামিল সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটিগুলোর মধ্যে একটি। ‘আয়িরাথিল অরুভান’ (১৯৬৫) এবং ‘নাম নাডু’ (১৯৬৯) সিনেমার মাধ্যমে জয়ললিতা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে ওঠেন।

এমজিআরের জনপ্রিয়তা এবং নেতৃত্ব জয়ললিতার রাজনৈতিক জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। তিনি এমজিআরের নেতৃত্বাধীন এআইএডিএমকে দলে যোগ দেন। রাজনীতির ক্যারিয়ারের শুরুতে কেউ তাঁকে এমজিআরের রাজনৈতিক উত্তরসূরী হিসেবে ভাবেননি, তবে এমজিআরের মৃত্যুর পর তিনি আলোচনায় আসেন।

জয়ললিতা: রুপালি পর্দা থেকে রাজনৈতিক আইকন
জয়ললিতা: রুপালি পর্দা থেকে রাজনৈতিক আইকন

ভি এন জানকি রামচন্দ্রনের পদত্যাগের পর জয়ললিতা ও তাঁর অনুসারীরা ‘প্রকৃত’ এআইএডিএমকে হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভুত হন। ১৯৯১ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জয়ললিতা ও তাঁর দল নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। তিনি প্রথমবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন। এরপর তিনি আরও চারবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।

তবে জয়ললিতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল সমালোচনায় ভরা। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে বসতে পারেননি। পরে আদালতের রায়ে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। ২০০৬ সালের নির্বাচনে তিনি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী পদ হারান।

পাঁচ বছর পর ২০১১ সালের নির্বাচনে জয়ললিতা আবারও বড় জয় পান এবং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ফেরেন। কিন্তু ২০১৪ সালে আবারও দুর্নীতির মামলায় সাজা হয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। কিছুদিন পর আদালতের রায়ে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হন।

জয়ললিতার শেষ রাজনৈতিক অধ্যায় ছিল ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে তাঁর দল এআইএডিএমকে আবারও নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। তবে নির্বাচনের কয়েক মাস পর তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর জয়ললিতা মারা যান।

Ad 300x250

যে ছয় মাস আছি, প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইডের ব্যবস্থা করে যাব: আইন উপদেষ্টা

মুসলমানি-বাংলা থেকে বাংলাদেশি: ভাষার রাজনৈতিক বিভাজন

রোহিঙ্গারা অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে প্রস্তুত: খলিলুর রহমান

ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পাটশিল্পে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা

‘রোহিঙ্গা সংকট স্থবির হয়ে আছে, সমাধানে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সক্রিয়তা জরুরি’

সম্পর্কিত